নারীর কষ্ট যাকে ছুঁয়েছিলো
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২০ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৩:২০:২৭ দুপুর
দীর্ঘ ৯ মাসের মাতৃত্বের যাতনাটা যেন চিরস্থায়ী বিষাদের নীলিমায় ঢেকে গেল। হুনাক আজ একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। বৃদ্ধ দাঈ আর শাশুড়ির মুখ হতে খবরটা যেন মৃত্যুর পরোয়ানার মতই মনে হল হুনাকের। নারীর এই কষ্টের কথা বোঝার তো কেউ নেই এই সমাজে । হুনাকের আজ ও মনে পড়ে ওর বড় বোন হুবাইদাকে দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে যাবার দিনটি। অপূর্ব সুন্দর হুবাইদাকে যে দেখতো সেই থমকে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার চোখ তুলে তাকাতে হত। কিন্তু কি মর্মান্তিক পরিণতিই না হল ওর। এক মাঝ দুপুরে তাবুরে বাইরে একাধিক ঘোড়ার খুরের শব্দে ভয়ে আতঙ্কে মাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো হুনাক। আর ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখেছিলো মরুদস্যুরা কি রকম টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ওর বড় বোন হুবাইদাকে। আজ ও যেন হুবাইদার নিজকে বাঁচাতে সেই মর্মস্পর্শী আত্নচিৎকার আর সেই দুর্বৃদের অট্রহাসি মনে হলে গা চমকে উঠে হুনাকের।
নিজের নারী জন্মের অসহায়ত্ব নিয়ে যখন কোন মতে স্বামী গৃহে ধুঁকে ধুঁকে জীবন চলছিলো তখন এক নয় বরং তিন তিনটে অসহায় জীবনকে পৃথিবীতে আনার উপলক্ষ হতে হল তাকে। গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা অশ্রুর সিক্ততায় অতীতটা নতুন করে মনের ঘরে ফিরে আসে। ক্রমাগত কন্যা সন্তান জন্মের অপরাধে স্বামী আসগর আবার নতুন বিয়ে করেছিলো। ধীরে ধীরে সংসারে বাতিল জিনিসের মতই কোন মত টিকে ছিলো হুনাক। কিন্তু এক সময় স্বামীর মৃত্যুর পর সতীনের ছেলেরা তাকে বের করে দেয় ঘর হতে একেবারেই কপর্দক শূণ্য অবস্থায়। এদিকে বাবার মৃত্যুর পর ভাইদের সংসারে তার যাতায়াতে ভাইরা বেশ বিতৃষ্ণার ভাব দেখাত। আজ বৃদ্ধ অবস্থায় মরুভূমির প্রখর রোদে শুকনো লাকড়ি কুড়িয়ে কোন মতে দুটো রুটির ব্যবস্থা করতে প্রাণটা কষ্টে জরজর। কেউ কি নেই নারীর এই কষ্ট বুঝার?
মরুভূমির প্রতিটি বালুকণা যেন বহু দিন ধরে কার আগমনের প্রহর গুণছিলো নিরবে। সময়ের কণা গুলো যেন কোন এক মুক্তিদূতকে বরণ করতে উন্মুখ হয়ে উঠেছিলো। নির্যাতিতা, নিষ্পেষিতা নারীর অশ্রুধোয়া মুখ গুলো যেন কার পদশব্দ শুনতে ক্রমশ বেকারার হয়ে পড়েছিলো। হ্যাঁ তিনি এলেন! মরু সাইমুম তার প্রমত্ততায় জানিয়ে গেল তিনি এসেছেন।কে ছিলেন তিনি?
একদিন এক ব্যক্তি এসে তাঁর ইসলাম পূর্ব জীবনের জাহেলী যুগের স্মৃতিচারণ করছিলো। সে বলছিলো, জাহেলি যুগে খুব ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান ছিলো। কিন্তু তখনকার প্রচলিত সমাজিক মানসিকতার কারণে একদিন তিনি মেয়েকে বেড়াতে যাবার কথা বলে বাইরে নিয়ে গেলেন। চঞ্চলা শিশুটি প্রজাপতির মত নেচে নেচে বাবার হাত ধরে হেঁটে চললো। না জানি আজ কত মজাই না হবে। কিন্তু বাবার মনে তখন অসূর ভর করেছিলো। মরুভূমির এক নির্জন জায়গায় গিয়ে শিশুটির বাবা মাটি খুঁড়ে গর্ত করতে শুরু করলো। শিশুটি নিষ্পাপ মমতা ভরা চোখে তাকিয়ে দেখলো ময়লা বালি লেগে তার প্রিয় আবুইয়ার মুখ, জামা কি করে নোংরা হয়ে যাচ্ছে । সে তাঁর ছোট্র দুটি হাত দিয়ে দিয়ে ঝেড়ে দিতে লাগলো সেই ধূলোবালি। এদিকে গর্তটি যখন অনেক গভীর হয়ে গেল তখন আচানক পূর্ব পরিকল্পনা মত বাবা শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে সেই গর্তের মধ্যে ফেলে দিল। ভয়ার্ত শিশুটি পড়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তে নিজকে বাঁচাতে - বাবা ,বাবা বলে চিৎকার করে উঠেছিলো। শিশুটির সেই করুণ আর্তনাদ মরুবিয়াবানের পাথুরে পাহাড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু তা তার বাবার মনকে টলাতে পারেনি। আজ ইসলাম গ্রহণের পর সেদিনের সেই অপরাধের জন্য অনুশোচিত আত্নার রোদন ধ্বনি শোনাচ্ছিলো সাহাবীটি আল্লাহর রাসূল(সাঃ) কে। ঘটনাটি শুনে মুহাম্মদ (সাঃ) এত কাঁদলেন যে তাঁর দাড়ি ভিজে গেল। জ্বি পাঠক তিনি ছিলেন আর কেউ নন বরং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব রাসূল(সাঃ)।
যিনি হুনাকের মত লাখো নারীর জন্য স্রষ্টার পক্ষ হতে সম্মানের তাজ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ''জান্নাত মায়ের পায়ের কাছে।''
তিনি এসেছিলেন নিষ্পেষিত নারীর জন্য স্রষ্টার পক্ষ হতে সম্মানজনক জীবন যাপনের প্রত্যয়ে পিতা, স্বামী, ভাই( বিশেষ পরিস্থিতিতে)এবং ছেলের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে সুষ্ঠ উত্তরাধিকারের ঘোষণা নিয়ে। তিনি বলেছিলেন- ''যে লোকের তিনটি বা দুটি বোন আছে। অথবা দুটি কন্যা আছে । সে যদি তাদের সাথে উত্তম সাহচর্য রক্ষা করে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে , সে জান্নাত লাভ করবে।''(তিরমিযী)
মরুভূমির উষ্ণ বুকেই শুধু নয় বরং গোটা দুনিয়ার নারীদের বেদনার সুপ্ত কষ্টের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করে দিতেই স্ত্রী, কন্যা, বোন ইত্যাদি বিভিন্ন ভুমিকায় থাকা নারীদের সাথে উত্তম আচরণের জন্য ও সবাইকে সতর্ক করেছেন তিনি।
রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, এমন একটি সময় আসবে যখন মদীনা হতে হাদরা মাউত পর্যন্ত একাকী একজন নারী হেঁটে যাবে। কিন্তু তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোন চিন্তা থাকবেনা।
সেই সমাজ রাসূলের জীবদ্দশায়ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আর এটা এ জন্যই সম্ভব হয়েছিলো যখন আল্লাহর নির্দেশিত হিজাবের বিধান পরিপূর্ণ ভাবে মানুষ মেনে নিয়েছিলো। যখন নারী পুরুষের মেলামেশার ব্যাপরে ইসলামের বিধান মানুষ লংঘন করেনি। যখন নিজের নৈতিক চরিত্রকে মানুষ স্রষ্টার নির্দেশিত পথ ধরেই গড়ে তুলতে পেরেছিলো। তখনই সমাজে নারীর অধিকার, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিলো।
আজকের নারীরা আমরা যদি সেই কাঙ্খিত নিরাপত্তা আর অধিকার ফেরত পেতে চাই তবে সেই মানের একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমাদের নারী পুরুষ সবাইকে সমান ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন