পারিবারিক বন্ধন হোক দৃঢ় (ননদ ভাবী সম্পর্ক)

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:১৩:১৩ রাত

একটি 'ভালো ঘর আর ভালো বর' প্রতিটি মেয়েরই কাম্য থাকে। কিন্তু পরিবর্তিত জীবনের সোপানে এসে দেখা যায় অনেক সময় ভালো বর মিললেও ভালো ঘর সবার ভাগ্যে জোটেনা। ২০/২২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে একটি মেয়ে এসে ঢুকে শ্বশুরবাড়ি। জীবনের আর বাদ বাকী সময় পুরোপুরি সেখানে কাটিয়ে ও সেই বউটি শ্বশুর বাড়িতে'পরের মেয়ে'ই থেকে যায়। আবার অনেক সময় একই আচরণ পাওয়া যায় বউয়ের কাছ হতে ও। কেন এমন হয়? চারপাশের মানুষগুলোর একটু উদারতা আর সহানূভুতি পেলে তো এমন হবার কথা ছিলো না। আসুন আজকে আমরা ভাবী আর ননদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলি।

ঘটনা ১. আমার এক পরিচিতা গত বছর সামারের সময় আমাকে একদিন ফোন দিয়ে বললেন- ভাবী, আপনি তো বেশ শিল্পমনা। ঘর সাজাতে আপনার ভালো দক্ষতা আছে । আমার ননদ আসবে আমেরিকা হতে। আপনি যদি ওদের থাকার বেডরুমের ডোরটি ডেকোরেশন করতে একটু হেল্প করতেন। ভাবীটি আমার খুব পছন্দের একজন। তাই তৎক্ষনাত আমি খুশী মনে রাজি হয়ে গেলাম। উনার কাছ হতে পছন্দের কালার জেনে নিয়ে বিভিন্ন কালার নেট দিয়ে আরো আনুষাঙ্গিক জিনিস দিয়ে তৈরী করে দিলাম ডোর ডেকোরেশনের কাজটি । ভাবী তো ভীষণ খুশি। বার বার ফোনে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন। আমি তখন বললাম - ভাবী, এ ধরণের কাজ গুলো আমি মনের আনন্দ হতেই করি। তবে আপনার জন্য করতে গিয়ে স্পেশালি ভালো লেগেছে আপনি আপনার ননদ আসা উপলক্ষে করছেন। সচরাচর ভাবী ননদের এই মধুর সম্পর্ক তো দেখা যায় না। তখন ভাবীটি বললেন- জানেন, আমার এই ননদের বিয়ের সমস্ত কাজ আমি নিজে এক হাতে সামাল দিয়েছি। আরো অনেক গল্প করলেন এ সংক্রান্ত। শুনে খুব ভালো লাগলো।

ঘটনা২. বেশ সিনিয়র এক ভাবী। একদিন আমাকে নিজের জীবন সম্পর্কে গল্প করতে নিয়ে বললেন - জানো, আমি যখন ইন্টার পরীক্ষা দিলাম তখন আমার বাবা মারা গেলেন। তখনো আমাদের দু'বোনের বিয়ে হয়নি। বাবা কোন[ জমা টাকা পয়সা ও রেখে যাননি। মা তো চিন্তায় শেষ। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ভাবী যেন কেমন একটা দূর দূর ভাব দেখাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এটা সেটা কারণ দেখিয়ে আমাদের কাছ হতে আলাদা হয়ে গেলেন। আম্মা তো চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। যদি ও আমার বাকী ভাইবোনরা বেশ উচ্চ শিক্ষিত। তারপর ও মা তড়িঘড়ি করে তখনই আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। ভাবী বিয়ের কথা শুনে মুখ বাঁকা করে বললেন- ওর মত মেয়ের জন্য কি আর কোন ভালো ছেলে আসবে। আলহামদুলিল্লাহ, উনার বেশ উচ্চ শিক্ষিত পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর ভাবীর হাজব্যন্ড বললেন- কি আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছো তো? ভাবী কথার সুরে অন্য রকম গন্ধ পেয়ে বললেন- তার মানে। তখন ভাই বললেন- সেই ছেলেকে ভুলতে পারবে? যার সাথে তোমার সম্পর্ক ছিলো। ভাবী তো বিস্ময়ে হাঁ। ভাই তখন বললেন- তোমাকে বিয়ে করার আগে একটি উড়ো চিঠি পেয়েছিলাম। কোন ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে। আমি যেন তোমাকে বিয়ে না করি। ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবী বললেন- তারপর..। ভাই বললেন- তারপর আর কি? তোমাকে খুব ভালো লেগেছিলো তো। তাই অভিভাবকদের কাউকে না দেখিয়ে চিঠিটি কমোডে ফ্লাশ করে দিয়েছি। ভাবী তো পুরোপুরি অবাক। এতবড় মিথ্যাচার কে করলো? পরে বছর খানেক পর উনারা প্রমাণ পেলেন সেই চিঠি উনার ভাবীর হাতের লিখা ছিলো। শুধু তাই নয়। উনার পরবর্তী বোনের বিয়ের পর সেই ভাইয়ের স্ত্রী রীতিমত ননদ জামাইয়ের কান ভারী করতে করতে ননদের সংসার ভেঙ্গে দেবার উপক্রম করেছিলেন।

ঘটনা ৩. একদিন আমার এক পরিচিতা ভাবী ফোন করে বললেন- ভাবী খুব অতীতের একটি ঘটনা আজ মনে পড়লো। আমি তখন কিশোরী। এক সকালে আমরা সবাই দেখলাম নদীর পাশ দিয়ে পুলিশ আমাদের পাশের গ্রামের একটি পরিবার হতে শাশুড়ি এবং ননদকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম -কেন ভাবী? তিনি বললেন- যৌতুকের লোভে শাশুড়ি ও ননদ মিলে বউটিকে টর্চার করতো। এক পর্যায়ে ননদটি ৩ মাসের অন্ত:সত্ত্বা ভাবীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো। শাশুড়ি তাকে সাহায্য করেছিলো।

ঘটনা ৪. এটি আমার এক পরিচিতা রিতা আপার মুখেই শোনা। রিতা আপা বিয়ের আগে ভাইয়ের সংসারে ছিলেন। ভাইয়ের বিয়ের ৮/৯ মাসের মাথায় একদিনের ঘটনা। একদিন রিতা আপার ভাবী, বাইর হতে ঘরে ফিরে কাজের মেয়ের সাথে বেশ চোটপাট। উনার বড় বড় দুটি স্বর্ণের কানের দুল খুঁজে পাচ্ছেন না। ননদকে ও জিজ্ঞেস করলেন। ভাবী ননদ মিলে সারা ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কোথাও পেলেন না। রিতা আপা বেশ বুদ্ধিমতি। তিনি বললেন- কি ব্যাপার ভাবী? ঠিক করে বলতো তুমি বাইর হতে ঘরে ফিরেই কেন কানের দুলের খোঁজ করছো? আমাদের কাজের মেয়েটি তো বেশ বিশ্বস্ত। ও তো চোর নয়। সত্যি করে বলতো তুমি বাইরে কোথাও হারাও নিতো? তখন ভাবীটি ফুঁপিয়ে ওঠে ননদকে বললেন- তুমি সত্যিই বলেছো। আসলে আমি ছিনতাই কারীর খপ্পরে পড়েছিলাম। কিন্তু তোমার ভাইয়া যে রাগী। সে তো আমাকে স্বর্ণের গহনা পরে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলো। এখন কি হবে? রিতা আপা আশ্বাস দিলেন বললেন- ভাবী, তুমি ভাইয়াকে সত্যি কথাই বলবে।

ভাই ঘরে ফিরতেই কিছুক্ষনের মধ্যেই বেশ কথা কাটাকাটির শব্দ। রিতা আপা, পা টিপে টিপে তার ভাইয়ের রুমে গেলেন। ভাই তখন তাকে বউয়ের ব্যাপারে অভিযোগ করতে লাগলেন। রিতা আপা মন দিয়ে ভাইয়ের সব কথা শুনে নিয়ে বললেন- দেখ ভাইয়া, কানের দুল তো তুমি পরনা। পরবে ভাবী। জিনিসটা যখন তার। সেটা হারিয়ে তারই বেশী খারাপ লাগছে। তুমি তার উপর বেচারীকে আরো বকা ঝকা করছো। সে তো ইচ্ছে করে ছিনতাইকারীকে দিয়ে দেয়নি। আজ যদি এমন হত গহনা সব ভাবীর কাছেই থাকতো। আর আল্লাহ না করুন ছিনতাইকারীর হাতে ভাবীর বড় ধরণের কোন একসিডেন্ট হত। তাহলে তোমার কেমন লাগতো। স্ত্রী'র কান্নারত মুখ আর বোনের কথায় ভাইয়ের টনক নড়লো। তিনি তখন স্ত্রীকে সান্তনা দিয়ে বললেন- থাক কেঁদোনা। টাকা হাতে এলে আমি তোমাকে পরে আমার বানিয়ে দেব। মনে কর এটা জানের উপর দিয়ে এসেছিলো মালের উপর দিয়ে চলে গেল।

রিতা আপা বললেন- এরপর এক ফাঁকে তার ভাবী তার রুমে এসে বললেন -রিতা, তোমার এই ইহসানের হক আমি কখনো ভুলব না। রিতা আপার বিয়েটা ছিলো নিজের পছন্দের। উনি বললেন- বিয়ের পর আমি যতবারই আমার ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম ফেরার সময় মা যেমন মেয়ের জন্য এটা ওটা পুটলি বেঁধে দিয়ে দেয়। আমার ভাবী আমার জন্য সেই মায়ের ভূমিকাই পালন করতেন।

সম্মানিত পাঠক ৪ টি সত্যি ঘটনা উল্লেখ করলাম ননদ ভাবী সম্পর্ক নিয়ে। আসলেই একজন ননদ যদি ভাবতে পারেন আমি ও একদিন কোন সংসারে ভাবী হবো। তাহলে তখন আমি আমার ননদের কাছ হতে কি রকম ব্যবহার আশা করি। আর একজন ভাবী ও যদি ভাবতে পারেন আমি ও তো একদিন ননদ ছিলাম। তখন ভাবীর কোন আচরণ গুলো আমাকে কষ্ট দিতো। আর সেই নিরিখে নিজের বর্তমান আচরণের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে পারেন তবে এই সম্পর্কের জটিলতা কিন্তু অনেক কমে যায়।

অনেক ননদ আছেন ভাবীর প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসাটা ঠিক ভালো চোখে দেখেন না। তখনো যদি তিনি ভাবতে পারেন তিনি যখন কারো স্ত্রী হবেন তখন তার স্বামীর কাছ হতে কতটা মনযোগ আশা করেন নিজের ব্যাপারে তাহলে ও কিন্তু এই দিকটি অনেক সহজ হয়ে যায়। আবার অনেক ভাবী আছেন যিনি নিজের হ্যজব্যন্ডের ভাইবোনদের মেনে নিতে পারেন না। তখনো তিনি যদি নিজকে ও একজন বোন হিসেবে বিচার করতে পারেন। তাহলে ও কিন্তু সম্পর্কের টানাপোড়ন অনেকাংশেই কমে যায়।

অথচ ভাবী ননদের জটিলতার পথ ধরে আশৈশব এক সাথে একই ছাড়ের নীচে বড় হওয়া ভাই বোনের সম্পর্কটা ও এক সময় শিথিল হয়ে যায়। বাচ্চাদের মাঝে ও ফুফু বা মামী এই সম্পর্ক গুলোর ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা তৈরী হয়। তাই আসুন আত্নবিশ্লেষণের আয়নায় নিজকে দেখি। আর নিজের অবাঞ্চিত ত্রুটি গুলো বদলে ফেলি। একটি সুন্দর পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলতে আমরা প্রতিটি নারীই সুন্দরও সক্রিয় ভূমিকা রাখি।

বিষয়: বিবিধ

৩১৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File