কাপ্তাই লেক (Kaptai Lake): দুঃসাহসিক নৌযাত্রা (শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন সত্যের পথিক ১০ মার্চ, ২০১৯, ০১:০০:৫৭ দুপুর
কাপ্তাই লেক (Kaptai Lake): দুঃসাহসিক নৌযাত্রা (পর্ব-১)
কাপ্তাই লেক (Kaptai Lake): দুঃসাহসিক নৌযাত্রা (পর্ব-২)
কতক্ষন যে বিরতি চলবে সেটাও তাৎক্ষণিক জানতে পারিনি। অনিশ্চিত অপেক্ষমান সময় সামনে রেখে আবার সবাই গাড়ী থেকে নেমে পড়ল..............
শেষ পর্বঃ
যদিও অপেক্ষা তথাপি এই সময় টুকু প্রয়োজনীয়ও বটে। সবাই রিফ্রেসমেন্ট চাইছিল বলে একটু সস্থিরও ছিল জনে জনে। যেহেতু বিরতি স্থল, এখানে বিভিন্ন পাহাড়ী ফল-মূল, ঝর্ণার পানি, বোতলজাত পানি ইত্যাদি পসর সাজিয়ে রাস্তার পাসে বসে আছে পাহাড়ী লোকজন। পানির দাম অনেক বেশী স্বাভাবিকের তুলনায়। তবে কলা, আনারস, আখ ও অন্যান্য পাহাড়ী ফল দামে যেমন কম তেমনি স্বাদেও মিষ্টি-মধুর ছিল। যাইহোক সবাই যার যার মতো সময় কাটাচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমাদের বুঝতে বাকি রইলনা যে বেলা ১.০০ টার ফেরি আর ধরতে পারছিনা। অগত্যা বিরতি স্থলেই আবার পরবর্তী করনীয় ঠিক করতে ক্ষণিকের জন্য হলেও একত্রিত হলাম। সবার মতামত নেওয়া হলো, অধিকাংশ চাইল যে কথা সেই কাজ, যদি কোন বিকল্প ব্যবস্থা থাকে তাহলে আমরা সেটি গ্রহন করবো। কি আর করা সবার মতামত নিয়েই যাত্রাবিরতি শেষে সেই লংগদুর দিকেই জিপ চলা শুরু করলো।
চেকপোস্টে অপেক্ষা
এখন সময় বেলা ১২.০০ টারও বেশী ক্লান্তি ছাড়িয়ে জিপগুলি সামনরে পানে এগিয়ে চলেছে কোথাও খাড়াভাবে উপরের দিকে উঠতে হচ্ছে আবার কোথাও খাড়াভাবে নিচে নামতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই একটি জিপ, মটোরবাইক অথবা সিএনজি আমাদের অতিক্রম করে যাচ্ছে। এভাবে বাঘাইঘাট, তারপর দীঘিনালা আর্মি চেকপোস্ট পার হতেই ঘড়ির কাটা ২.০০ টা ছুঁই ছুঁই। ড্রাইভারদের বলা হলো দুপুরের খাবারের জন্য একটা মানের খাবারের হোটেলে রাখতে। সেখানে খাওয়া হলো, জোহরের নামাজ পড়ে আবার যাত্রা সেই লংগদুর দিকে। ইতিমধ্যে খবর নিলাম লংগদু থেকে ইঞ্জিনবোর্ডে (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) রাঙামাটি যাওয়া সম্ভব কিন্তু যেতে কত সময় লাগবে বা বিকাল ৩.০০ টার পরে বোর্ড পাওয়া যাবে কিনা কিছুই জানিনা।
আমাদের জিপ ছুটছেই লংগদুর দিকে যেন রাস্তার শেষ নেই। আবার ঘড়ির দিকে যতো তাকাই মনে হচ্ছে সময়ের কোন লাগাম নেই। অনিশ্চিত গন্তব্যে এগিয়ে চলেছি দুরু দুরু মনে। মাঝে মাঝে রাস্তার অবস্থা দেখে আরও মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার দুপাশে প্রকৃতির অপার সৈন্দর্য্যগুলি যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের থেকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন কোন কালে তাদের সাথে আমাদের কোন সখ্য গড়ে উঠেনি, হায়রে সময়ের লীলা!!!
অবশেষে ৩.১০ অথবা ৩.১৫ টার দিকে জিপ এসে থামল লংগদু ঘাটে। দীর্ঘঃশ্বাষের পর একটু দম নিয়ে জিপ খেকে নেমে পড়লাম। হেলপাররা ব্যাগ নিচে নামাতে ব্যস্ত আর ড্রাইভার ব্যস্ত বিল বুঝে নিতে এর মাঝে কয়েকজন এসে বিরক্ত করছে যে, ভাই বোর্ডে যাবেন? বুঝতে বাকি রইলনা যে এরা নৌকার মাঝি। দরকষাকষি করে উঠে পড়লাম নৌকায়। কেমন বড় বলবো মাঝারি সাইজের নৌকা ৩৮ জনের জন্য দুইটি লাগলো। তারপরে দুইজন এক বোর্ডে বেশি হওয়ায় মাঝি অন্য বোর্ডের সাথে ব্যালেন্স করতে বললো। কাঠের তৈরী পাটাতনে বসার স্থান যেখানে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় । উপরে কাঠের ফ্লাট ছাদ ইচ্ছা করলে বসে ভ্রমন করা যায় তবে ওঠার কোন সিঁড়ি নেই। তবে মোটামুটি নিচু হওয়ায় উঠতে খুব বেশী কষ্ট হয়না।বিকাল ৩.৩০ টা হবে মাঝি বোর্ড ছেড়ে দিল।
বোর্ড ছাড়ার সাথে সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। প্রথমে আগে-পিছে করে চললেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বোর্ড দুটি পাশাপাশি চলতে লাগলো। অনেক ক্লান্তির পরেও সবার কাছে মনে হলো এক নতুন যাত্রা। বোর্ডের এক প্রান্তের ইঞ্জিনের শব্দ হাওয়ায় মিলিয়ে অপরপ্রান্তে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল। উচ্ছল-শৃঙ্খল উল্লসিত প্রাণগুলি নতুন জগতে পদার্পনের যে অনুভুতি প্রকাশ করছিল তা লেকের স্বচ্ছ সবুজ পানিতে আরো শতগুন ফুটিয়ে তুলছিল। যেন কাগজের দুটি নৌকা বিকালের হেলে পড়া সূর্য্যের আলোতে ছায়া-তুলির অঙ্কন এঁকে যাচ্ছিল। নিচে জন্মানো জলজ উদ্ভিদগুলি স্বচ্ছ পানিতে স্পস্ট দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন পঙ্খীরাজে উড়ে চলেছি শত গাছ-গাছালি, গুল্ম-লতা মাড়িয়ে। প্রথম যাত্রায় কাপ্তাই লেক বলতে যে ধারনা পেয়েছিলাম সময়ের সাথে সাথে তা পালটাতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে লেকের প্রশস্ততা যেমন বাড়তে শুরু করলো তেমনি ধারনা করছিলাম গভীরতাও, তার উপর বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিল বোর্ডের উপর। বড় বড় ঢেউগুলি যেন বোর্ডের পাশাপাশি মনের ভীরুতাকে পরখ করছিল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। শুরুতেই ছোট ছোট মাছ ধরা নৌকা চোখে পড়ছিল কিন্তু এখন আর তেমন দেখছিনা। দিগন্তজোড়া এই লেক শুধু অথৈ পানি; ঐ দুরে চোখের সীমানা ছাড়িয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি যেন আজব এক দুনিয়া।
সমস্ত ক্লান্তি, নতুন পথের ভ্রমনের ধকল, জড়তা ইত্যাদি কাটিয়ে সবাই এখন ছবি তুলতে ব্যস্ত। গ্রুপছবি, একা একা, হরেকরকম সেলফি, পাটাতনে বসে, ছাদের উপর উঠে, এক বোর্ড থেকে আর এক বোর্ডে এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সতর্ক করা হচ্ছিল সাবধান হওয়ার জন্য। এই পড়ন্ত বিকেলে পড়ে গেলে উঠানো পরের কথা খুজে পাওয়া মুশকিল হবে। মাঝে মাঝে লেকের বাতাসে ভেসে যাচ্ছিল একক ও ক্রস গানের তরঙ্গ। প্রকৃতির এই অপরুপ সৈন্দর্য্য দুচোখ ভরে দেখছিলাম আর উপভোগ্য মনটি সতেজ হয়ে উঠছিল। পানির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নির্মল বাতাস দেহ-মনের উপভোগের পরিপূর্ণতায় নিয়ে এসেছিল। আসর সময় পার হওয়ার আগেই লেকের পানিতে ওজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। আহ্ কি ঠান্ডা পানি! বার বার ছুতে ইচ্ছা করছিল। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল, উচ্ছল প্রানগুলি উপভোগ্য প্রকৃতির সাথে মিতালি করে পরিপূর্ণতা লাভ করছিল। আস্তে আস্তে কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ কেউ চুপচাপ বসে দিগন্তের শেষ সীমানায় অস্ত যাওয়া সূর্য্যকে অবলোকন করে যাচ্ছে।একপর্যায় আসর পেরিয়ে মাগরিবের সময় হলো নামাজ পড়ে নিলাম। এখন সবাই প্রশ্ন করে আর কতো সময় লাগবে?
ঘড়ির কাটা সাতটার কাছাকাছি, ভ্রমন সাড়ে তিন ঘন্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, চারিদিক আধার ঘনিয়ে এসেছে । আশে পাশে কোন জনমানব নাই, প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে বাড়িয়েছে আরো শতগুন, শুধু বোর্ডের ইঞ্জিনের ডুগ ডুগ শব্দ ভেসে আসছে। চারিদিক ঘন গহীন বন সমৃদ্ধ পাহাড় ঘিরে আছে আমাদের যার মাঝে সবুজ পানি এখন কৃষ্ণ আকার ধারন করেছে এরই উপর দিয়ে গাঁ ছম ছম ভেসে চলা। কি অদ্ভুদ! প্রকৃতির অপার রুপ এখন ভিতি ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিটি প্রাণে। মাঝিরা নিজেদের মধ্যে কথা সেরে নিচ্ছে- না নিস্তব্ধতা কাটানোর জন্য সরব কথোপকথন! মাঝিদের কাছে পথ চেনার জন্য ছোট ছোট টর্চ আছে যা মাঝে মাঝে অপ্রতুল আলোর ছটা দিয়ে যাচ্ছে। দুরে এরকম দুই একটা ক্ষীণ আলোর ঝলকানি বুঝিয়ে দিচ্ছিল অন্য বোর্ডের উপস্থিতি। বোর্ডে উপস্থিত প্রতিটি প্রাণ চুপচাপ প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রুপটি উপলব্ধি করছে শঙ্কিত মনে। যাই হোক আমরা অদেখা সামনের পানে এগিয়ে চলেছি সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আস্তে আস্তে চারিদিক টর্চের আলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বুঝে নিতে হলো রাঙামাটি শহরের কাছাকাছি এসেগেছি। দুর থেকে শহুরে আলো আমাদের মাঝে চাঁদনি রাতের আবোহ তৈরী করছে। ধীরে ধীরে যতই আলো আর কোলাহল বৃদ্ধি পাকনাকেন জমিনে না ভেড়া পর্যন্ত মনকে অভয়ের কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা। খানিক বাদে মনে হয় এই বুঝি বোর্ড ঘাটে ভিড়বে কিন্তু কই মাঝিরা চুপচাপ বেয়েই চলেছে, এ পথ বুঝি আর শেষ হবার নয়। শত উৎকন্ঠার পরে মাঝিরা জানতে চাইল আমরা কোন ঘাটে ভিড়তে চাই? আরে মুশকিল এখানে ঘাট কয়টি তাতো জানিনা। শুরু হলো মোবাইল যোগাযোগ। একপর্যায় জানতে পারলাম আমাদের ফিশারি ঘাটে নামলে সুবিধা হয়। মাঝিরা শুনে বললো সেতো অনেকদুর এতদুরে যেতে গেলে নাকি ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে! অবশেষে রাত্র ৮.৩০ মিনিট বা তার কিছুক্ষণ পরে বোর্ড দুটি রাঙামাটি শহরের ফিশারি ঘাটে ভিড়লো। শুকরিয়া আল্লাহর দীর্ঘ ৫ ঘন্টার দুঃসাহসিক নৌযাত্রার পরে আমরা নিরপিদে পৌছাতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ!
বিষয়: বিবিধ
৭১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন