"বাবা। আমাকে তু্ই কবর দিতে আসবিনা......................."?
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৯:০৬:৫৬ রাত
২৩শে জুলাই, ২০১৬। দেশে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, রমজানের ঈদের আগেই ফ্যামেলীসহ সবাই একসাথে দেশে যাবো। কিন্তু আমার যাওয়াটা হলনা। পাসপোের্ট কিছু ঝামেলার কারণে আটকে গেলাম। তবুও তেমে থাকিনি। কারণ আমাকে যে যেতেই হবে। তাই অবশেষে অতৃপ্ত মন নিয়েই ঈদের পর ১২ দিনের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম।
মায়ের বয়স এখন অনুর্ধ ৮০ বছর। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও হাটতে সমস্যা হতনা। কিন্তু রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাথরুমে পিছলে পড়ে কোমরে ব্যাথা পেল। আর তখন থেকেই মা গৃহবন্দী। হাটতে কষ্ট হয়। উঠা বসার সময় কোমরে অনেক ব্যাথা হয় । ডাক্তার বলেছে, সামান্য ফেটে যাওয়া কোমরের হা্ড্ডি ঠিক হবার মত বয়স এখন আর নেই।
প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে বাড়ীতে হাতে গোনা কয়েকটা দিন ছিলাম মাত্র। তাও এক সাথে নয়। মায়ের পাশে থাকার অনুভুতিটা এতই প্রবল ছিল যে, আসতে মন চাচ্ছিলনা। কিন্তু তবুও যে আসতে হয়। বাড়ী থেকে প্রতিবা্রই বিদায়ের সময় মেয়েদের বাবার বাড়ী হতে বিদায় নেয়ার দৃশ্যপট ভেসে উঠে। সে কি এক যাতনা। যেতে ইচ্ছে হয়না। যেখানে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছি, ইচ্ছে করলেই এখন আর এখানে আমার থাকা হয়না। আমি থাকতে চাই। কঠিন বাস্তবতা আমাকে বের করে দেয়। শৈশবের স্মৃতি জড়িত গ্রাম আর চোখ ধাধানো সভ্যতার লোভনীয় বাস্তবতার মাঝে চলে আসা নিয়মকে অনিয়ম করে অনেক সময় ছুটে গেলেও অবশেষে মানতে বাধ্য - আমি বাস্তবতার সামনে এক পরাজিত সৈনিকের মত। স্ত্রী সন্তান চাকুরি এসবের মোহমায়ায় অনুভুতিকে জলাঞ্জলি দিতে দিতে এখন "ইট পাথরের এ জীবনের" কাছে পোষ মানতে বাধ্য হয়েছি। এক কথায় - কঠিন বাস্তবতার ভেড়াজালে আটকে পড়া এক আত্মবন্দী মানুষ। দৈনন্দিন হাজারো কাজের মাঝে আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। এখন আমি আমার তাগিদে চলিনা। জীবনের তাগীদেই আমি চলি। এ অবস্থা থেকে বের হবার আর উপায নেই।
প্রতিবারই বাড়ী থেকে খুব কষ্ট নিয়ে বিদায় নেই। কিন্তু এবারের বিদায়টা যে আমার অতীতের সব বিদায়কে হার মানিয়ে দিয়েছে।
..বিদায়ের জন্য প্রস্তুত। মা শুয়ে আছে। পাশে বসে মায়েুর পানের বাটা হতে পান বানিয়ে মুখে দিলাম। অনেকক্ষন কথা বললাম। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিছ্ছিলাম বার বার। মায়ের চুলগুলো তারের মত। মাথা ভর্তি চুল। একটুও পড়েছি। খুব ভাল লাগছিল এ মুহুর্তটি।
কথা বলতে বলতে অনেক দেরী হয়ে গেল। ভাবছিলাম, মাকে হয়তবা আর দেখবোনা। এ দেখাই শেষ দেখা। তাই বললাম,
- মা আপনি কি আমার উপর রাগ?
কেন বাবা?"
- না। আমি যে আপনার পাশে থেকে সেবা করতে পারিনা।
- না বাবা। তুমি আমাকে হজ্জ করিয়েছো। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ রাখুক।
মায়ের কপালে চুমু খেলাম। বললাম - মা, এবার উঠি। দোয়া করবেন।
মাথাটা কাত করে চোখের ইশারায় মা আমাকে বিদায় দিল।
উঠোনে দাড়িয়ে মেঝো ভাই সহ গ্রামের অন্য মানুষগুলো হতে বিদায় নিচ্ছিলাম। হঠাত দেখি মা লাঠি ভর করে এসে বারান্দার সিড়িতে বসেছে।
আবারও ছুটে গিয়ে মায়ের পাশে বসলাম। মা হাটতে পারেনা। তবু্ও ছোট ছেলের বিদায়ে মনের শক্তিতে উঠে এসেছে। পাশে বসে আবারও মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মোবাইলে দুচারটা ছবি তুলে নিলাম। তার পর আরারও বিদায়ের পালা...।
১০০ হাত দুরে রাস্তা। গাড়ী দাড়িয়ে আছে। গাড়ীর পাশে দাড়িয়ে ব্যাগগুলো তুলছি। পেছন ফিরে দেখি, মা আবার ও লাঠি ভর করে আমাকে বিদায় জানাতে এসে সুস্থ মানুষের মত দাড়িয়ে আছে। মায়ের এমন করুণ অনুভুতি দেখে দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের প্রবাস জীবনে এ প্রথম, মা আমাকে বিদায় দিয়েও যেন দিছ্চিলনা।
....আবারও এগিয়ে গেলাম কোমরের ব্যাথা নিয়ে এগিয়ে আসা মাকে বিদায় জানাতে। চার সন্তানের মাঝে সব চেয়ে আদরের ছোট ছেলেকে বিদায়ের দৃশ্য দেখছিল পেছনে দাড়ানো মহিলারা।
না। আর একটু পরেই যাই। মাকে জীবনে হয়তবা আর দেখবোনা। আগামীতে আর কেউ আসবেনা আমাকে এমন করে বিদায় জানাতে। ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াবস্থায় বাবার মৃত্যু হয়। তখন থেকেই মা আমাদের বুকে জড়িয়ে এক কঠিন মুহুর্ত পার করেছে। সে স্মৃতিুুগুলো অন্য মায়েদের থেকে একেবারেই আলাদা।
মা হয়তবা আমাকে আর দেখবেনা। আগামীতে ছুটিতে আসলে সবই থাকবে। শুধু মা থাকবেনা। এ অনুভুতিটুকুর কারনেই মা হয়তবা মনের জোরে এতটুকু এগিয়ে এসেছে। তাই আমি আবার ও ফিরে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরবো এমন সময় আকুতির স্বরে মা জানতে চাইল,
"বাবা। আমাকে তু্ই কবর দিতে আসবিনা......................."?
বিষয়: বিবিধ
১৭২৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চট্টগ্রামের দিকে আসেন নি এবার?
ঈদ- মোবারক ভাইয়া ।
বৃদ্ধ দাদীর এমন করুণ আকুতি ছিল আমার বিদায় বেলায়!
আল্লাহ অনেক ভাল ও সুস্হ্য রাখুন প্রিয়-শ্রদ্ধেয়দের আমার-সবার!
আব্বা-আম্মা দুজনকেই ঐভাবে বিদায় দিয়ে/নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কারো কবরের পাশেই যাবার সুযোগ হয়নি আজো!
অথচ প্রবাসী হয়েও আমার অন্য ভাইটির সৌভাগ্য হয়েছিল উভয়ের অন্তিম সময়ে পাশে থাকার!
আপনারও যেন হয়!!
প্রবাসী হয়েও আপনার যেন সৌভাগ্য হয় অন্তিম সময়ে পাশে থাকার! Praying Praying Praying
বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০১১ তে, কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাবার জানাজায় উপস্তিত হতে পারিনি.....
প্রায় ২৪ লাখ টাকা খরচ করে ঘর বানালাম, কিন্তু আমার ঘরটা এক নজর দেখার সুযোগটাও আমাকে আওয়ামী কুত্তা বাহিনী দিচ্ছেনা.....মায়ের কাছে যখনেই ফোন করি, মা কান্নার জন্য কথা বলতে পারেন না...জানিনা জালিম সরকারের পতন কখনো হবে কিনা......
ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার মায়ের জন্য দোয়া রইলো।
শক্তিশালী লিখা। মন টা অপরাধী-অসহায় বোধ করছে।
কেউ কি আমাদেরকে সামহাউ এমন একটি শিক্ষা দেয়নি - যাতে আমরা মনের অজান্তেই অর্থবিত্ত, আর নির্ভেজাল লাইফের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে আজ দুনিয়ার দাসে পরিনত হয়েছি - যে পায়ের নিচে বেহেস্তের নিশ্চয়তা সে পা কে একটু দুরেই সরিয়ে রাখেছি। আমার মনে হয় সামহাউ আমরা প্রতারিত হয়েছি - এবং নিজেরা নিজেদের সৃষ্ট কষ্টে কষ্ট পাচ্ছি।
২৩ জুলাই দেশের আসার পর অত্র লেখাটি পোস্ট করেছেন ১৩ ই সেপ্টেম্বর। জানি না মহান আল্লাহ তায়ালা এই দুই আড়াই মাস সময়ের মধ্যে তার বান্দাদের মধ্যে থেকে কার কার দুনিয়াবী হায়াতের ডিউরেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কি পরিমান বন্দাকে উঠিয়ে নিয়েছেন।
@@ কালের বিবর্তনে কবিকে হারালে চলবে না যে। আগামি জানবে কি করে সঠিক অতীতকে? খড়তাপে মাটি যতই শুঁকিয়ে ফেটে যাক; বছর ঘুরতেই বর্ষার আগমনে মাটি নিজেকে আরো নরম করে নেয়। আন্তরিক ভাবেই চাই আপনাদের মতো কবিদের ব্লগ জগতে অবাধ বিচরন। আশা করি বিবেচনা করবেন ছোট্ট বোনের কথা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন