সাদা মনের খোঁজে - পর্ব (৪)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০২:১৫:০৪ দুপুর
আগের পর্ব দেখুন
যাতনার স্মৃতিতে ভাস্বর এ গল্পের কেবলা বাবার নাম 'মিনার ভাই'। দুজনেই পাশাপাশি অফিসে কাজ করি। বাসা থেকে অফিসে দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। আসা যাওয়ায় ১৩০ কিলোমিটার। নিজস্ব গাড়ী ব্যাতিরকে এতটুক দুরে কাজ করার চিন্তাই করা যায়না।
কোন এক রাতের কথা। মিনার ভাই আমাকে ফোন দিয়েছে। ...গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। কাল অফিসে যাবার জন্য....। সমস্যার কথাটুকু শেষ না হতেই আমি আশ্বস্ত করলাম, সমস্যা নেই। আমি নিয়ে যাব। কাল থেকে ততদিন আপনাকে আনা নেওয়া করব, যতদিন গাড়িটা ঠিক না হয়।
মিনার ভাইয়ের বাসা আমার থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দুরে। অফিসে যাবার সময় আমাকে উল্টোপথে বাড়তি ৪-৫ কিলোমিটার বেশি যেতে হবে। যথাসময়ে তাকে অফিসে যেতে না পারাটা দন্ডনীয় অপরাধ। আবার আসার পথেও আমার এক ঘন্টা পরে বের হতে হয় অফিস থেকে।
আমার অফিসে তেমন কোন বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। নিজের মত করেই অফিসে আসা-যাওয়া করি। কিন্তু মিনার ভাইয়ের কারণে সকালে এক ঘন্টা আগে অফিসে রওয়ানা দিতে হত। ফেরার পথে আবার এক ঘন্টা বাড়তি অপেক্ষা করতে হত। নামিয়ে দেয়ার জন্য ৪-৫ কিলোমিটার বেশি পথ অতিক্রম করতে গিয়ে আর ও বাড়তি আধা ঘন্টা ব্যায় হত। এক কথায় মিনার ভাইকে আনা নেওয়া করতে আমার অতিরিক্ত ২-৩ ঘন্টা চলে যেত।
দ্বীনি ভাই। আমার প্রিয় নেতা। আল্লাহ ও রাসুলের (সা) এর প্র্রতিনিধিত্বকারী এসব নেতাকে সাহায্য করা মানেই দ্বীনের সহযোগীতা করা। এ ধরনের একটি কল্যান মুলক কাজ করতে গিয়ে নিজের মাঝে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পেলাম। সর্বোপরি, মিশরীয় নাগরিক সাদা মনের মানুষ নাবিল থেকে পাওয়া শিক্ষাটাও কাজে লাগানোর একটা মহা সুযোগ হল। শুরু হল মিশনের নবযাত্রা।
মিনার ভাইয়ের গাড়িটা ঠিক হতে দু'সপ্তাহ লেগে গেল। এর মাঝে ১৫-২০ কিলোমিটার দুরে দেয়া মেকানিকের কাছে ও দু একবার আসা-যাওয়া করেছি তাকে নিয়ে।
সকাল সাড়ে সাতটায় মিনার ভাইকে বাসা থেকে উঠাতে হবে। আমি ১০-১৫ মিনিট আগেই বাসার নিছে গিয়ে ফোন করে জানান দিতাম, ভাই আমি এসেছি। ৮-১০ মিনিট পর তিনি নেমে আসতেন। মিনার ভাইয়ের জন্য আমার এ বাড়তি কস্ট দেখে প্রায়ই বলতেন, আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করছেন। প্রত্যুত্তরে একটি কঠিন সময়ে আমার পাশে দাঁড়ানো নাবিলের স্মৃতিচারণ করে বলতাম, মানুষ মানুষের জন্য। একে অন্যকে সাহায্য না করলে কি আর সমাজে থাকা যায়? তাছাড়া, আপনি আমার সংগঠনের নেতা। দ্বীনি ভাই হিসেবে আপনার সাহায্য এগিয়ে আসা আমার নৈতিক দায়িত্ব। এসব বলে আমাকে লজ্জা দিয়ে কি কোন লাভ আছে?
পারিবারিক সর্ম্পক ছাড়াও সাহিত্য সাংস্কৃতিক এবং চিন্তার দিক থেকে মিনার ভাইয়ের সাথে আমার অন্যরকম একটা মিল ছিল। এ কারণেই হয়তোবা সখ্যতাটাও ফ্রুটিকা জুসের মত একটু বেশিই ছিল।
গাড়িটা ঠিক হতে দুসপ্তাহ লেগে গেল। মিশন সমাপ্তি করে তৃপ্ত হৃদয়ে ফিরে গেলাম। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম আমাকে দিয়ে তাঁর এক বান্দাকে খেদমত করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
২০০৯ সালের কথা। দিনটি ছিল ৮ই জিলহাজ্জ্ব । সৌদি আরবের জেদ্দায় ঘটে যাওয়া এক অকস্মাৎ বন্যার তান্ডবে সবকিছু লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই গর্জন হীন আকাশের উগলে দেয়া বৃষ্টি স্বল্প সময়ের মধ্যে সবকিছুকে ডুবিয়ে দিল। পাহাড়ি ঢলে কৃত্রিম ভাবে তৈরী হওয়া উচু-নিচু রাস্তার ছোট ছোট নদী খাল বিল, ডোবা পাড়ি দিতে গিয়ে ৬৫ কিলোমিটার রাস্তায় গাড়ী সহ কতবার যে ভিজে ভিজে রাস্তা পার হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সে এক অবর্ননীয় স্মৃতিকথা।
দীর্ঘ সময় ধরে লবণাক্ত বন্যার পানিতে গোসল করা গাড়িটার শুরু হল জ্বর, সর্দি, কাঁশি, কাঁপুনি-ঝুাকুনি, আমাশা, পাতলা পায়খানা। অবশেষে হার্ট এ্যটাক্ট! ডায়নামোতে অটোমেটিক বিদ্যুত উৎপাদন না হওয়ায় ব্যাটারি আর রিচার্জ হয়না। রিচার্জ হলেও চলার পথে বিদ্যুৎ গোলযোগের কারণে দুচারটা উল্টো টান দিয়ে অবশেষে হার্ট এ্যাটাক্ট। থেমে গেছি রাস্তার উপরেই। এত দুরে আসা যাওয়ার রাস্তায় গাড়ির নিত্য অসুস্থতায় হাঁফিয়ে উঠলে ও বাজেট ঘাটতির কারণে মুমুর্ষ রোগীকে হাই পাওয়ারের সেলাইন দিয়েই জোর করে চালিয়ে দিলাম আরও কিছুদিন।
কোন এক সকালের কথা। অনেক চেষ্টা করেও গাড়িকে আর জাগাতে পারলাম না। এর আগে অনেক পুরোনো একটা হুন্ডা গাড়ী চালানোর কারণে দেখে দেখে মেকানিক্যাল অনেক কিছুই রপ্ত করছিলাম। সর্দি কাশি জনিত প্রাথমিক রোগগুলো সারাতে পারতাম। কিন্তু আজকে অনেক চেষ্টা করেও ওকে আর জাগাতে পারিনি। অবশেষে পরিচিতি মেকানিককে ডেকে আনলাম জাগিয়ে তোলার জন্য। এন্টিবায়োটিক সহ অনেকগুলো ডায়াগনস্টিক শেষে ডাক্তার বলল, হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত আমার গাড়িটা আর কোনদিন জেগে উঠবে না। তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার সব চেষ্টা সাধনা আর ভালবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্মৃতি বিজড়িত পঙ্খীরাজটা চলে গেল না ফেরার দেশে। পনের শত রিয়ালের বিনিময়ে ওর কঙ্কাল গুলো বিক্রী করে দিলাম।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। গাড়ী ছাড়া অফিস করার কোন উপায় নেই। বসকে ফোন করে কাজে যেতে না পারার কারণটা বলে দিলাম। আগামীকাল অফিসে যাওয়া নিয়ে তেমন একটা ভাবছিনা। কারণ মিনার ভাই আছে। তার সাথেই চলে যেতে পারবো। ভাবছি ফ্যামেলীর নিত্য কিছু সমস্যাসহ বাজার-সওদা করার কথা নিয়ে।
রাতে মিনার ভাইকে ফোন দিয়েছি। বিস্তারিত খুলে বলার পর চাপা স্বভাবের মানুষটা উত্তর দিল, আমি যেহেতু সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্য বের হব, আপনি আর আগেই আমার বাসার নীচে চলে আসুন।
আমার বাসা থেকে মিনার ভাইয়ের বাসায় যেতে গাড়ি ভাড়া লাগবে বিশ থেকে পঁচিশ রিয়াল। ওর বাসায় যাবার বাড়তি পরামর্শটা পেয়ে খুব জোরে একটা ধাক্কা খেলাম। নেতা মানুষ। জোর করে কি বলা যায়, আমাকে এসে নিয়ে যান? না। থাক। কেউ যেচে এগিয়ে আসতে না চাইলে জোর করে হয়না। তাছাড়া নেতার সাথে কথা বলার আদব বলতে কথা। নিঃশর্ত আনুগত্য। আমি চলি যে তার মন যোগাইয়া মনের দুঃখ করে কই...।
ফোনটা রেখে দিয়েছি। বিষয়টা জানার জন্য পাশেই ওতপেতে বসে থাকা স্ত্রী প্রশ্ন করল,
- দ্বীনি ভাই কি বলেছে তোমাকে?
- বলেছে, সমস্যা নেই।
- তাতো বুঝলাম। কিন্তু তিনি কি তোমাকে তোমার মত করে তোমার বাসায় এসে নিয়ে যাবে?
- একটু থেমে উত্তর দিলাম, না?
- কেন?
- সব কিছু কেন দিয়ে হয়না।
- কিছুক্ষণ চুপ থেকে খুব ভারাক্রান্ত মনে বলতে লাগল, তাহলে নেতা থেকে কি শিখলাম? তোমার অনুপ্রেরণায় আমি সদস্যা হলাম। তোমার গাড়িতে করে আদর্শের ফেরী্ ওয়ালা হয়ে চষে বেড়াই এ শহরের আনাচে কানাচে। সংগঠনের জন্য ওয়াকফ করা তোমার গাড়িটায় এ শহরের কে না চড়েছে? কখনও একটু যাতায়াত খরচ্ও নিতে দেখিনি তোমাকে.............।
- থেমে দিয়ে বললাম, বাদ দাও তো। আমার কর্মের মাধ্যমে আমার জান্নাত আমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। যারা অন্য দ্বীনি ভাইয়ের সহযোগীতায় এগিয়ে আসেনা, এটি ওদের দুর্ভাগ্য।
- না। আমি এটা মানি না। তাহলে কিসের দ্বীনি ভাই। কার সাথে সীসা ঢালা প্রাচীর হয়ে লড়বে। এসব কাঁচের সীসা দিয়ে দিয়ে ইস্পাতসম প্রাচীর হয়? নেতা থেকে আমরা কি শিখবো। কি শেখাবো অধীনস্থদের।
- একটু অপেক্ষা কর। হয়তবা কোন সমস্যার কারণে কাল আসবেনা। পরশু থেকে হয়তবা আসবে আমাকে বাসা থেকে নিয়ে যেতে...।
পরদিন সকাল বেলায় ভাড়া গাড়িতেই মিনার ভাইয়ের বাসার সামনে যথাসময়ে উপস্থিত হলাম। প্রথমদিন কিছু জরুরী কাজ থাকায় ফেরার পথে অন্য জনের গাড়িয়ে আগেই এসে পড়েছি। দ্বিতীয়দিন এক ঘন্টা বিলম্ব করে আসছি নেতার সাথে। খুব গম্ভীর ভাব। দেখে মনে হচ্ছিল, খুব ইজ্জতে লাগছে। ড্রাইভার হয়ে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। বাসা থেকে দু্ই কিলোমিটার দুরে এসেছি মাত্র। সামনেই বাসের রাস্তা। স্যেজন্যতা বোধ দেখাতে গিয়ে মিনার ভাইকে বললাম,এক কাজ করুন। আপনি আর কষ্ট না করে আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। খুব তুপ্তির একটা মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। বললেন, ঠিক আছে।
আমি নেমে গেলাম। গাড়ির দরজা বন্ধ করার সময় জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যা হবে নাতো?
- না। সমস্যা নেই। বাসে করে চলে যাবো।
সিগনাল খূলেছে। মিনার ভাই টান দিয়ে দৃস্টি সীমার বাহিরে চলে গেলেন। আমি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবছি আমাকে রেখে যাওয়া মিনার ভাইকে নিয়ে। প্রশিক্ষণ শালায় যার মুখে হযরত ওমর আর ভৃত্যুর কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হতাম, ভাবতাম, আহ! কি উদারতা। কত বড় বিস্ময়কর শিক্ষা! অর্ধ পৃথিবীর সম্রাট হযরত ওমর (রা) কিয়ামতের মাঠে আল্লাহর ট্রাইবুনালের রায়ে যাতে এ ভৃত্যুর জন্য জাহান্নামে যেতে না হয়, সে ভয়ে ভৃত্যুর অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে তিনি উটের লাগাম টেনে হাঁটছেন। আর ভৃত্যু উটের উপর বসে আছে
তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য সামনেই অপেক্ষা করছে বিশাল এক উৎসুক্য প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্রপ্রধান ও তার সহযোগীরা। হযরত ওমরের মাঝে এত টুকু কার্পন্যতাবোধ কিংবা হীনমন্যতা কাজ করেনি যে, অর্ধ পৃথিবীর সম্রাটকে এভাবে ভৃত্যুর উটের লাগাম টানতে দেখে না জানি কি মনে করে...........।
বাসায় ঢুকতেই স্ত্রী জিজ্ঞেস করল,
- কার সাথে এসেছো?
- মিনার ভাইয়ের সাথে।
- তোমাকে কি বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে? ......বলতে ভাত খেয়ে যেতে।
- উনি আসলেই তো খেয়ে যেতো?
- তার মানে? উনি কি তোমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়নি?
- না।
(সরি। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে বলেই অসমাপ্ত রেখে দিলাম)
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৫২৬ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
একটা গাছের সব ডাল সমান মজবুত হয়না। সমান হবে এমনটা আশা করাটাও বোকামী। গাছের মজবুত ডালগুলোই গাছের প্রানশক্তি। তবুও গাছ সকলকে নিয়ে বাঁচে। এটা প্রকৃতির শিক্ষা। তবে কিনা আপনি আমি বলে কয়ে কোন ডালকে মজবুত করতে পারবোনা। এটা পারা যায়না।
এসব প্রকাশ করাতে আমি যে সমস্যাটা দেখি-
নিজের কাহিনীর মত করে না বলে গল্পের ছকে বললে নিরাপদ হতো!!
আমার বুঝ হয়তো একটু অন্যরকম-
কি জানি!!!
আর নিজের জন্য যা করবো তা অন্যেকে বলবো না।
হেফাজত করুন আমাদের মালিক। অভিজ্ঞতা এমন আছে অসংখ্য। তবে আপনি যেভাবে শব্দের গাথুনি দিয়ে লিখছেন। তাতো আমি পারবো না। আপনাকে মোবারকবাদ। যদি কেউ একটু সংশোধন হয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন