সাদা মনের খোঁজে - (পর্ব-৩)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০২:৩৪:৩৫ দুপুর
আগের পর্ব দেখুন
স্বীকারোক্তি - ইচ্ছা থাকা সত্ত্ব্বেও ব্লগে অনেকদিন ধরেই আসতে পারিনা। নিজেকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু ব্লগ নেশা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই নিজেকে ব্লগের দেয়ালের সাথে বেধে রাখার জন্যই 'সিরিজ লিখায়' হাত দিয়েছি। ব্লগারদের সাথে আড্ডা দেয়ার মাধ্যমে হয়তোবা নিয়মিত হবার প্রবল ইচ্ছাটার বাস্তবায়ন হবে। ব্লগে যারা এসে আমার লিখা পড়ে মন্তব্য রেখে যান, তাদের ব্লগ বাড়ীর ওয়ালের লেখনি পড়ে মন্তব্য করা নৈতিক দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ন্যূন্যতম কাপর্ন্যতাবোধ আমার নেই। আবার সস্তা দামের মন্তব্য করতে ও আমি অভ্যস্ত নই। তাই সবার ব্লগে আসার বোধ থাকা সত্ত্ব্বেও আপাতত কিছু সময় বিলম্ব হলে মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।
------------------------------------------------------------------
অফিস কলিগ নাবিলকে আজ ও ভুলতে পারিনা। বিশাল এক সাদা মনের এ মিশরীয় নাগরিকটা যে এত উদার, এর আগে ঘুণাক্ষরে ও ভাবতে পারিনি। এ ধরনের মানুষগুলো পারিপার্শ্বের লোকদেরকে চুম্বকের মত কাছে টেনে নেয়। মনের অজান্তেই জনপদের আশাহত মানুষেরা জড় হয় এদের নেতৃত্বে। যে কোন সমাজ বিপ্লবে এসব মানুষগুলোই জাতিকে কিছু দিয়ে যেতে পারে। ইতিহাস এদের জন্যই। একজন নেতার এসব শ্রেষ্ঠ গুন না থাকলেই নয়।
অবিশ্বাস্য ভাবনার এসব মানুষগুলোর মত উদার, ত্যাগী, নি:স্বার্থ চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যদি 'সত্যর এ মিছিলের' যাত্রীদের মাঝে পেতাম, তাহলে মনটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে যেত। আকাশের মালিক দ্ধার খুলে রহমত দিয়ে ভরে দিত এ সবুজ জমিনকে। তাই এ শিক্ষণীয় ঘটনাটির স্মৃতিচারণ করার লোভ সামলাতে পারিনি।
১৯৯৭ সাল। প্রবাসে ফ্যামেলি নিয়ে এসেছি মাত্র। স্বল্প সময়ের জন্য বাহিরে বাসা নিতে হয়েছে। হাই আল সালামা। কর্মস্থল থেকে সাত কিলোমিটার দুরে। যাতায়াতের জন্য আপাতত ভাড়া গাড়ী ঠিক করেছি। মাসে ৭০০ রিয়াল। আসা যাওয়া মিলিয়ে অফিস সময়টা অনেক লম্বা হয়ে গেল। কাজ শেষে গেইটে গাড়ির অপেক্ষা। উপ! খুব বিরক্তিকর। কিন্তু কিছু করার নেই। মনে অনেক কষ্ট।
বাংলাদেশী অফিস কলিগ দুষ্টের হাসি দিয়ে গাড়ি নিয়ে পাশ দিয়ে চলে যায়। নির্বাক তাকিয়ে থাকি। আর বলি, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
নাবিল কোম্পানীর সিনিয়র একাউন্টেন্ট। এক বছর হল যোগ দিয়েছে। ওর বাসা অফিস থেকে ২৫ কিলোমিটার দুরে। নাম সরাফিয়া। হিসাব নিকাশ কষে অফিস থেকে বিলম্বে বের হতে হয়। তাই আমার সাথে গেইটে তেমন একটা দেখা হয়না।
দুসপ্তাহ পরের কথা। নাবিল পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল-
- তুই এখানে অপেক্ষা করছিস কেন?
- গাড়ির জন্য।
- কার গাড়ী?
- ভাড়া।
- কোথায় যেতে হবে?
- হাই আল সালামা।
- মাসে কত দিয়ে হয়?
- সাত শত রিয়াল।
- ওহ! এত টাকা! এভাবে পোষাতে পারবি? কোম্পানীতে বাসা পেতে হয়ত আরও ২-৪ মাস সময় লাগবে। এতগুলো টাকা বেতন থেকে চলে গেলে...।
- কি করবো? জানতে চাইলাম।
নাবিল কিছুটা ভাবল। তারপর বলল। গাড়িটা বাদ দিয়ে দেয়।
- আসা যাওয়া কিভাবে করবো?
- কাল থেকে আমি তোকে নিয়ে যাব।
- না। এটা সম্ভব নয়। কারণ, বিষয়টা তো আর একদিনের নয়। আবেগে দুনিয়া চলে না। তাছাড়া দুজন একই সময়ে অফিস থেকে বের হওয়া..
- এটা আমার দায়িত্ব, নাবিল জবাব দিল। তোকে এ নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি বলেছি বাস। আমার ভাই হলে কি এমন করে বলতে পারতাম। মনে কর আমি আমার ভাইকে সাহায্য করছি।
নাবিলকে কিছুতেই মানা করতে পারিনি। ও অবশেষে আমাকে আনা নেয়ার দায়িত্বটা কাঁধে তুলেই নিল। ওর আশ্বস্ততা ভাল লাগলেও এটি কতদিন চলবে তা নিয়ে আমি শংকিত। তাছাড়া, আমাকে নিয়মিত আনা নেওয়া করতে গেলে নাবিলের এক ঘন্টা বেশী ব্যয় করতে হবে। উল্টো পথে তাকে অনেক দুর ঘুরে আসতে হবে। অফিস থেকে একটু আগে বের হতে হবে। নিজস্ব সুবিধা অসুবিধাগুলো বাদ দিতে হবে।..না। বুঝে আসেনা। যাই হোক। এটা ওর ব্যাপার।
শুরু হল পথ চলা। আসা যাওয়ার মাঝে কথা বলতে বলতে নাবিলের সাথে সখ্যতা অনেকটা বেড়ে গেল। ওর ভেতরের মানুষটার সাথে পরিচিত হতে শূরু করলাম। আমাকে এতদূর আনা নেয়ার এ নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগে নিজেই হীনমন্যতায় ভুগি। ভাবি, এ কেমন মানুষ। মানুষের মন কি এত বড় হয়? কিন্তু বাস্তবতা তো তাই। তাই তার সম্পকে জানার আগ্রহটা্ও যেন আরও বেড়ে গেল।
একদিন যাবার পথে নাবিলকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা, তুই যে আমাকে এভাবে আনা নেওয়া করছিস, এর কারণটা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গীটা খুলে বলবি কি? নাবিল মুচকি হাসল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্মৃতিচারণ করতে লাগল আর এক মহান ত্যাগের কাহিনী। আমি একেবারেই বিস্মিত! তন্ময় হয়ে শুনছিলাম আর এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। আর ভাবছিলাম, আমি কি জীবনে এমন কাউকে উপকার করতে পেরেছি? কিংবা অামার যদি গাড়ী থাকতো, আমি কি এমন দীর্ঘ সময় ধরে কাউকে উপকার করতে পারতাম? না। মন সায় দেয়না। মিছে শান্ত্ননার আশ্বাসও বের হয়ে আসেনা মন থেকে। আমি তো আমার সম্পকে বুঝি? তাই এসব ভেবে নিজেকে সংগোপনে ধিক্কার দেই। ছি। ছোট লোক। মিছে আশ্বাস্ও দিতে ও বুঝি তোর কস্ট হয়? আঙ্গূল দিয়ে নাবিলকে দেখিয়ে দিয়ে মনে মনে বলি, দ্যাখ, না জানলে শিখে নেয় এর থেকে। এ লোকটি তোর কষ্টের কথা বুঝে। এতে দারুণ আনন্দ আছে। ভেতরের মানুষটা সত্যিকারের মুসলিম না হলে কলাগাছ সম সাড়ে তিন হাত দেহের মানুষটা্ও অমানুষ হয়। এসব দেখে শিখতে হয়। রপ্ত করতে হয় কঠিন অনুশীলনের মাধ্যমে।
বলছিলাম নাবিলের কথা। ও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গল্পের মাধ্যমে আমাকে ক্ষনিকের জন্য নিয়ে গেল রিয়াদে। তার ভাষায় - আমি তখন রিয়াদে। এক বছর বেকার। চাকরি পাইনা। বড়ই হতাশ। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে চলে যাব। মনস্থির করার পরই চাকরিটা পেয়ে গেলাম। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। কর্মস্থল বাসা থেকে ৬০ কিলোমিটার দুরে। দূরত্বটা কর্মের জন্য বিশাল বাঁধা হয়ে দাড়াল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। পেয়েও হারানোর ভয়। দুচার জনের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করলাম। কাজ হয়নি। একদিন এক অচেনা মিশরীয় সাথে দেখা। ও আমার বিষয়টা শুনে পিঠে জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল, আমি আছি না। এ দায়িত্ব আমার।
ওর অফিসটাও আমার অফিস থেকে দুরে ছিল। কিন্তু নিয়মিত আমার জন্য সেও এক ঘন্টা বেশী কষ্ট করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। একদিন দুদিন নয়। এক বছর। বিশ্বাসের দেয়ালটিও হার মানিয়েছে বাস্তবতার কাছে।পৃথিবীর কোন শ্রেষ্ঠ বিনিময় দিয়েও এসব ত্যাগী মানুষদের অবদান মুল্যায়ন করা যায়না। এটি অমুল্য।
তোর সমস্যাটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এর কৃতিত্ব আমার নয়। এটি আল্লাহর। যিনি মিশরীরর মাধ্যমে আমাকে শিখিয়েছেন। তাই ভাবলাম, যে আল্লাহ আমাকে চাকরি দিলেন, আর এক অচেনা মানুষকে দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, যোগাড় করে দিলেন রিজিকের, সেই আল্লাহ হয়তবা তোর সমস্যাটা আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পরীক্ষার দিকে ঠেলে দিলেন। বুঝতে চাইলেন, আমি তার কোন অবদানকে অস্বীকার করব। তাই আমার যত কষ্টই হোক, সেই শিক্ষার বাস্তব অনুশীলন আমাকে করতেই হবে। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। যারা কোন কিছু সবার আগে শুরু করে, তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ।
অনেকদিন পরের কথা। এ কাফেলার বড় সারীর একজন্ নেতা এ ধরনের একটা সমস্যায় পড়লেন। বেচারার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল। অনেক দূরের অফিস। ৬৫ কিলোমিটার। না গেলে চাকরি থাকবেনা। ছুটে গেলাম সাহায্য করতে। মিশরীয় নাবিলের ত্যাগের মহিমায় দারুণভাবে অনুপ্রাণিত আমি এগিয়ে গেলাম। দীর্ঘ সময় ধরে পাওয়া আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে নিজেকে একজন পরোপকারী, ত্যাগী হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য লেগে গেলাম। আপ্রাণ চেষ্টাও করেছি। সমস্যার সমাধান হওয়া পর্যন্ত পাশে দাড়িয়ে ছিলাম। মিশন শেষ হল।
অনেকদিন পরের কথা। কোন এক অনাকাঙ্খিত মুহূর্তে অামি নেতার দ্বারস্থ হলাম। আমার প্রিয় 'কেবলা বাবা' থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাটা ছিল বড়ই কষ্টের।
চলুন, আগামী পর্বে শোনা যাক সে না বলা কাহিনী।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৫ বার পঠিত, ৩৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিন। নিয়মিত লিখেন আপনার লেখা খুবই ভালোলাগে। আর আগের ধারাবাহিক লেখাটা পারলে পোস্ট করুন অনুরোধ থাকলো।
সাথেই আছি হারিয়ে যাবার পূর্ব পর্যন্ত........।
সুযোগ করে নিয়মিত হবেন আশা করি।
কেবলা বাবাদের অনেক কাহিনীর শেষ নেই
মানুষ মানুষের জন্য। আর মানবিক সাম্য কৃতজ্ঞতা থাকেনা সবার।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া খুব ভাল লাগল ।
'কেবলা বাবা'র ব্যাপারটা নিয়ে আতংকবোধ করছি- আল্লাহতায়ালা রক্ষা করুন, ক্ষমা করুন!
অচেনা মিশরীয় ও উদার নাবিলের জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা রইলো।
কেবলা বাবার অপেক্ষায়...।
ধন্যবাদ ডিজিটাল ফুল দিয়ে বরণ করার জন্য।
ইসলামী বিপ্লব তো শীতল বাতাসের মত। তুমি চাইলেও আসবে। না চাইলেও আসবে। তুমি পছন্দ করলেও তার পরশ তোমার গায়ে লাগবে। না চাইলেও লাগবে। আর তা আসার পর রুপ নেবে বানে। বানের স্রোতের মত ভাসিয়ে নেবে সব অছ্যুত। বিষয় হচ্ছে তুমি কোন ভুমিকা নেবে। দুয়ার বন্ধ করে তাকে আটকানোর চেষ্টা করবে, না খুলে রেখে হৃদয় জুড়াবে। বদ্ধ দুয়ারে ধাক্কা হয়তো খাবে কিন্তু ফিরবে না। ঠিকই অন্য দরজায় অন্য পথে বয়ে যাবে। যাবেই। তবে একটা কথা অনন্তকাল ধরেই সিদ্ধ। যারা অগ্রগামী তারাই সফল। সিদ্ধান্ত তো সর্বদা তোমারই হবে।
আমরা এই আচরণ থেকে অনেক দুরে। আপনার শিক্ষনীয় এই পোষ্ট থেকে যদি কেউ গ্রহন করে। আমি চেষ্টা করবো।
আপনার লেখাটা অনেক দিন পরে পড়ার জন্য ক্ষমা চাইছি।
লেখাটা অনেক সুন্দর হয়েছে, হৃদয় ছোয়া লেখাটা পড়া শেষ করে বুঝতে পারলাম চোখের কোনাটা ভিজে গেছে.....।
অনেক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য...
মন্তব্য করতে লগইন করুন