স্মৃতি বিজড়িত চুয়াল্লিশ দিনের ছুটি-২
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:২৫:১৯ দুপুর
আগের পর্ব দেখুন
দেশে যাবার সময় যেন প্রতীক্ষার প্রহর আর শেষ হয়না। তবুও কেন জানি অনাকাঙ্খিত সময় টেনে হিছড়ে আরও লম্বা হয়। মন মানে না। তবুও ভাল লাগে। আমি যাচ্ছি..। মনকে বুঝাই, দুর পাগল। এইত আর একটু। চুপ করে বসে থাক।
ভোর ৬টায় প্রবাস ছাড়ার কথা। রাতের সেহরী, ফজরের নামাজ সব মিলিয়ে এ সময়টিতে সৌদি এয়ারপোর্টে কর্মরত লোকগুলো হেলে দুলে আসে। দাঁড়িয়ে আছি। অনেক লম্বা লাইন। মুখে কারও কথা নেই। মলিন মুখে খালি একবার ডান পায়ের উপর। আর একবার বাম পায়ের উপর ভর করে বিরক্তির ভাব প্রকাশ করছে অনেকেই। একেবারেই নিঃশব্দ। ইমিগ্রেশন পার হবার জন্য নিথর নিঃশব্দে অপেক্ষা করা মানুষগুলো না দেখলে বুঝা যায়না এখানে কেউ আছে।
চট্রগ্রাম বিমান বন্দরে নেমেই এ বোবা মানুষগুলোকে বিস্ফোরিত হতে দেখে বিস্মিত হলাম। হাসলাম। কথ্য ভাষায় বিশ্রী গালাগালি। মনে হল অনেক দিন পর গালি গুলো চর্চার হিড়িক পড়েছে। কর্মরত কর্মচারী গুলোও অনেকটা বেহায়ার মত। ইচ্ছে করে বেধে দেয়া জটলা অনেকক্ষণ পর খুলল। কিন্তু এতক্ষণে ইফতারের সময় শেষ।
একদিন যাত্রা বিরতির পরই চট্রগ্রাম থেকে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। সাথে তিন ভাইয়ের বউ পোলাপান, পুতের বউ মিলিয়ে বিরাট মিছিল। আহা। কি আনন্দ। অনেক বছর পর চার ভাই একসাথে বাড়ীতে ঈদ করবো। দারুণ উৎফুল্লতা নিয়ে ছুটে গেলাম গ্রামের বাড়ীতে।
বাচ্চাদের গ্রামের মানুষ ও মাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ভাবছি কয়েকদিন থাকব। ছেলে ফাহীমকে নিয়ে যখন প্রথম বার দেশে গিয়েছিলাম, বাসে যাবার সময় রাস্তার দুধারে বন্যার পানি যেন থৈ থৈ করছিল। ছেলে জীবনে এ প্রথম এমন দৃশ্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
- ও বাবা। বাংলাদেশে এত সুইমিং পোল আছে? বাহ। দারুণ তো!
সৌদি আরবে পুকুর বলতে সুইমিং পুল। আমাদের দেশের মত খোলা পুকুর নেই বলে। তাই ওর ধারণাটা এমন ছিল। আর এক বন্ধুর ছেলে জ্যান্ত গরু দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেই ফেলল,
- দ্যাখ দ্যাখ বাবা। ঐযে একটা কাঁচা গরু হেঁটে যাচ্ছে।
বাড়ীতে গিয়েই পুরুষ মহিলা মিলিয়ে ২০ জনের বিশাল টিম দৌড়ে ঝুপ করে একেবারে পুকুর পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়লাম। অনেক দিনের পুরোনো কাঁদা গায়ে মেখে আনন্দ করলাম। লুঙ্গি দিয়ে ডিঙ্গী নৌকা বানিয়ে পুকুরের মাঝে দু ঘন্টা কাটালাম।
অনেক মানুষের পদভারে বাড়িটা যেন সতেজ হয়ে উঠল। দশটায় রাতের খাবার শেষ করেই উঠোনে বসে গেল পালা গানের আসর। অনেক বড় আয়োজন। দর্শকও অনেক।
বিদ্যুৎ নেই। খালি উঠোনে সবাই গেড়ে বসেছে। ঝাপসা অন্ধকার। গাছ গাছালীতে ভরা বাড়ীর দক্ষিন দিকের বাতাসে দারুণ একটা আমেজ তৈরী হয়েছে। এরি মধ্যে বাথরুম সিঙ্গারদের অনেকেই হাজির হয়ে গেল। কিন্তুু শুরুটা করবে কে?
যে কোন জায়গায় আমার মেয়ে তাসনিয়াকে দিয়েই গানের যাত্রা শুরু করি। কারণ এ ব্যাপারে ওর মাঝে জড়তা একেবারেই কম। বলার দেরি। শুরু করতে দেরী হয়না। ছোট বেলায় ওকে গান গাইতে বললে না বলা পর্যন্ত ওর গান বন্ধ হতো না। নন ষ্টপ সিঙ্গার। এখন এমনটি না হলেও ওকে দিয়ে শুরু করাটা সহজ হয়।
ছোট বেলায় গ্রামের মেঠো পথে ছাগল চরাইতে গিয়ে মুলত আমার গানের চর্চা। প্রত্যেক সমাপনি পরীক্ষার পর বাঁশী নিয়ে সুর তুলতাম রাস্তার ব্রিজের উপর বসে। নিজের মাঝেই মিছে প্রেমের হাবুডুবু খেতে খেতে সুর তুলতাম। ইথারে ভেসে ভেসে অনেক দুর চলে যেতো বাঁশিতে তোলা সেই করুন কান্না। মেঝ ভাই হতে শেখা এ বাঁশীঁ ছিল এক সময় বড়ই আপন। কিন্তু শহরে এসে জায়গার অভাবে আস্তে আস্তে হয়ে গেলাম বাথরুম সিঙ্গার। বাঁশী আর বাজানো হলনা।
ব্যচেলার থাকাবস্থায় জেদ্দায়ও বসত গানের আসর। ফ্যামেলী আনার পর নিজেদের মাঝেই গড়ে তুলেছি শিল্পী গোষ্ঠী। জেদ্দার বাসায় আমি কখনও বাথরুমে গানের টান দিলে ড্রইং রুম হতে মেয়ে তাসনিয়া সুর তোলে। অন্যরুম হতে ছেলে ফাহীমের কন্ঠে যোগ হয় সুর। ফিনিশিং এর জন্য ভেতর থেকে শুরু হয় ম্যাডামের কন্ঠে লীড। অবশেষে বাথরুমে ধরা গানটি কোরাশ সঙ্গীতের মুর্চনায় বেজে উঠে পুরো ঘর জুড়ে। এভাবেই রুদ্ধ দ্বার চর্চার মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব "বাথরুম ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠী" তিল তিল করে গড়ে উঠেছে।
প্রতিবারই ছুটিতে যাবার পর অবসর সময়গুলোকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য বাথরুম ব্যান্ড শিল্পীরা আনন্দের ছাপ রেখে আসে। এবারও তাই হল।
বড় ভাইয়ের চার ছেলে। সবাই মোটামুটি গাইতে পারে। সৌদি আরব হতে আগত অতিথি ব্যান্ড শিল্পীদের পাশাপশি যোগ হয়েছে পাশের বাড়ীর দু চাচাত ভাই্। ওরা যে এতটুকু মন খুলে গাইবে বুঝতেই পারিনি। উপরত্ন মেম্বার হানিফ ভাই ছিল বাড়তি আকর্ষন। ওর গান আর কথা নিয়ে দারুণ ভাবে জমে উঠত এ আসর। অন্ধকারে হঠাৎ করে অট্রহাসি শুণে মনে হত, এ যেন কালজয়ী শিল্পীদের আসর বসেছে।
তবলায় হান্ডি, পাতিলা আর ভাতের বল সবই আনা হয়েছে। রঙ্গ বে রঙ্গের তাল তুলেছিল ফাহীম ,হান্নান আর পারভেজ। মেম্বার হানিফ ভাই হাতের মটকায় আওয়াজ তুলে মাথা নেড়ে নেড়ে গানে দোহাজারী ধরে।
আসরটিকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য শিল্পীদের দু'গ্রুপে ভাগ করে প্রতিযোগিতা শুরু করেছি। এক গ্রুপে একটি গান গাওয়ার পর অন্য গ্রুপের পালা। যে কোন গান গাইলেই হল। আনন্দময়ী এ পালা গানের আসরে ভাবিরা সেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে বার বার চা আপ্যায়ন করার মাধ্যমে এসব অতিথি শিল্পীদের উৎসাহ দিতে কার্পন্যবোধ করেনি।
অন্ধকারে গান গাওয়ার আর একটি সুবিধে হল, এতে শিল্পীরা লজ্জা কম পায়। আসরের শুরুতে শিল্পীদের মাঝে কিছুটা জড়তা থাকলেও অবশেষে প্রতিযোগিতায় নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য আর অনুরোধ করতে হয়নি।
চলবে
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৮ বার পঠিত, ৪৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর অনুভুতির কথা জানতে পেরে ভাল লাগল। আমার এলাকাতে বেয়াল্লিশ দিন থাকার কথা কল্পনাও করা যায় ন। সরকারী দলের নাতি পুত্রদের অত্যাচারে পালাতে হবে। অনেক ধন্যবাদ।
অনেক দিন পর নিজ দেশে এসে অতি স্বাভাবিক জিনিসগুলো আপনার চোখে যে মায়ায় মায়ায় জর্জরিত হয়ে হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে আবেগে মথিত হয়েছে, লেখার প্রতিটি পরতে পরতে সেই মায়া এবং ভালোবাসাকে অনুভব করলাম।
অনেক ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য।
আমাগো এলাকার এমনই একজন প্রতিথযষা শিল্পী। হেতিনি গ্রামীন টয়লেটে ডুকলে দরজার হুক লাগানোর দরকার হতো না। অনেক দূর থেইক্যা হেতের গানের আওয়াজ হুনা যেত। ফলে ঐদিকে আর কেউ যাওয়ার নিয়ত করতো না।
আপনার সেই পারিবারিক গানের আসরে কুইক রেন্টালের কারেন্ট হলে ভাল হত।
ড্রইং রুম হতে মেয়ে তাসনিয়া সুর তোলে।
অন্যরুম হতে ছেলে ফাহীমের কন্ঠে যোগ হয় সুর।
ফিনিশিং এর জন্য ভেতর থেকে শুরু হয় ম্যাডামের কন্ঠে লীড।
অবশেষে বাথরুমে ধরা গানটি কোরাশ সঙ্গীতের মুর্চনায় বেজে উঠে পুরো ঘর জুড়ে।
এভাবেই রুদ্ধ দ্বার চর্চার মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব "বাথরুম ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠী"
এটাকে এখন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানী করে ফেলুন-
আর জেদ্দায় হোক উদ্বোধনী শো.
ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য রেখে যাবার জন্য।
দারুণ নামটি চয়েজ করেছেন। ভালো লাগলো।
খুবই ভাল লাগল। চালিয়ে যান দেরী কইরেন না।
বিদ্যুত বিভ্রাট আপনাদের ব্যান্ড তৈরিতে উৎসাহিত করল। তবে গানের ঠেলায় কেউ যেন তা band করার দাবি না জানায়!!!
আল্লাহ আপনাকে ও আপনার পরিবারকে ভালোরাখুন প্রবাসী সরি দেশি ভাই।
ধন্যবাদ ।
যে যাই হোক, আমিও বাথরুম সিঙ্গার হিসেবে খারাপ যাই না!! তাই ভাবছি আপনার দেয়া অসাধাণর নামের শিল্পীগোষ্ঠীর নামেই একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তুলবো।
''বাথরুম ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠী"
চালিয়ে যান,শব্দে নিঃশব্দে সাথে আছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন