রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-৩৯)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৫ জুন, ২০১৪, ০৮:৩৫:১০ সকাল
পর্ব-৩৮
প্রচন্ড ক্ষমতাধর, আপোসহীন ঘুষখোর, এ ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার শ্রদ্ধেয় খায়ের সাহেব, একদিন পর অফিসে এসেছেন। তবে আজকের আসাটি অন্য দিনের মত নয়। লুঙ্গি পরিহিত খুব বিমর্ষ খায়ের সাহেব আজকে অফিসে এসেছেন একজন সর্বহারার বেশে। অফিসে ঢুকতেই ছোট শিশুর মত ঘুমরে কেঁদে উঠলেন। তারপর অফিসার ইসলাম সাহেবকে জড়িয়ে ধরে একজন নিঃস্ব মানুষের মত হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। এ কান্না সহজে কেউ থামাতে পারেনি।
ম্যানেজার সাহেবচেম্বার থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসলেন খায়ের সাহেবকে শান্তনা দিতে। কিন্তু এ শান্তনা যে মুখের ভাষায় মুছে যাবার মত নয়। এ ক্ষত সারা জীবনের জন্য। এ কান্না হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা একজন আহত মানুষের কান্না। এ কান্না সব অপকর্মের স্বাক্ষী প্রকৃতির নিষ্ঠুর আক্রমনের কান্না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। অনুশোচনার সুযোগ আছে। তাই বুকে জড়িয়ে ধরা ইসলাম সাহেবের কানের পাশে একজন অসহায় মানুসের মতই বেদনা জড়িত কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হচ্ছিল ,
- স্যার। আমার সব শেষ। চাকুরী জীবনের সব টুকু আয় দিয়ে তিল তিল করে সাজানো আমার স্বপ্নের সংসার গত পরশু বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা বিক্ষুব্ধ জলোচ্চাসের সাথে ভেসে গেছে। নিয়ে গেছে আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে। সন্তান হারানোর বেদনায় মুমুর্ষ আমার স্ত্রীর রোদনে পুরো বাড়িটাই যেন মৃত বাড়ীতে পরিণত হয়েছে। শান্তনা দেবার কেউ নেই। চোখের সামনে জীবন্ত সন্তানকে 'মা আমাকে বাঁচাও' আকুতি আর আর্তচীৎকারেও রক্ষা করতে পারলনা। এ বেদনা কেমনে ভূলি স্যার! ঘরে রেখে আসা টেপ রেকর্ডারটা আনতে গেলে আমার সন্তানটাকে স্ত্রীর হাত থেকে কেড়ে নিল নিষ্ঠুর সমুদ্রের জলোচ্ছাস। আমি শেষ হয়ে গেছি স্যার.......।
কিছুটা শান্ত হওয়ার পর খায়ের সাহেব স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন সেই ভয়াল রাতে ঘটে যাওয়া কিয়ামতের অভিজ্ঞতাগুলো। জলসানো চোখের পানি দিয়ে বর্ননা করতে লাগলেন নিজের দেখা স্বল্প দৈঘ্যর সেই কিয়ামতের দৃশ্যর তান্ডবের কথা। সন্তান হারানের দৃশ্যর কথা।
জীবনে অনেক ঝড় ঝাপ্টা এসেছে। বন্যা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বাড়ী ঘর উড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু ২৯ শে এপ্রিলের মত এত নিষ্ঠুরতা অতীতের আর কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছিলনা। নিরব নিস্তব্ধ সাগরের শান্ত জল এতটুক অশান্ত হয়ে জনপদের মানুষ, গরু, ঘর বাড়ী এভাবে ভাসিয়ে নিতে পারে, অবিশ্বাস্য। এটি কেন হল, কেমন করে হল এর কোন ব্যাখ্য নেই।
...বরাবরের মতই আল্লাহর উপর এতটুকু ভরসা ছিল যে, রেডিও থেকে ভেসে আসা অশনি সংকেত এতটুকু বিপর্যয় ডেকে আনবেনা। রাত যতই গভীর হচ্ছিল ততই ঝড়ের তাণ্ডবের খবরগুলো বাড়তে থাকল। ভোলা সহ বিভিন্ন নদী তীরবর্তি এলাকাগুলো তলিয়ে যাবার খবর আসতে থাকল। একটি সময় এল, রেডিও বার্তাও সঠিক খবর দেয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ফিন ফিন বাতাস দরজা জানালা দিয়ে ঢুকছে। শন শন বাতাসের সাথে হঠাৎ দমকা হাওয়া। ভাবছি, ফাউন্ডেশন করা বিল্ডিং ঘর। যাই কিছু হোক অন্তত ভেতরে কিছুই হবেনা। ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে স্ত্রী এক রুমে শুইয়ে পড়েছে। আমি দরজা জানালা সব বন্ধ করে কান পেতে আতঙ্কিত মানুষের মত বাহিরের ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ শুনছিলাম। উকি দিয়ে বাহিরে দেখার সুযোগ নেই। আশে পাশের নারিকেল আর সুপারির গাছগুলো যেন বাতাসের প্রচন্ড ধাক্কায় বার বার মাটিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ছিল। সাথে মেঘের গর্জন, আকাশ থেকে ছোড়া মেঘের ঘর্ষনে বিস্ফোরিত বিদ্যুত চমকানোর সাথে আগুনের ঝলকানি যেন সব কিছু আলোকিত করে আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল। অনেক দুরে বড় গাছগুলো ভাঙ্গার মড় মড় আওয়াজ। তারপর কারো ঘরের টিন খুলে বাতাসের ক্ষিপ্রতার সাথে ধাক্কা খেয়ে ধড়াস করে মাটিতে পড়ার বিকট শব্দ। এর পর বাঁচাও বাঁচাও শব্দে অসহায় মানুষদের আর্তনাদ। শূরু হল প্রচন্ড গতিতে ধাবমান পানির শব্দ। সাথে মানুষদের আত্মচিৎকার। নিজের ভীত সন্ত্রস্ততার কথা স্ত্রী সন্তানকে না জানানোর ইচ্ছে থাকলেও দরজার নীচে দিয়ে কাদা মাটি সহ সমুদ্রের নোনা চল দ্রুত গতিতে ঢুকতে দেখে আর দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। ক্ষণিকের মধ্যেই বাহির থেকে ধুয়ে মুছে আনা নোংরা পানি পুরো ঘরে ঢুকে পড়েছে। স্ত্রীকে জাগিয়ে ঘুম চোখে সন্তান দুটোর একটিকে কোলে আর আর একটিকে হাতে নিয়েই বের হয়ে পড়লাম ঘর থেকে। বের হতেই বুঝতে পারলাম বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
তৈরী করা ফুলের বাগান আর উঠোনের উপর দিয়ে থৈ থৈ করা পানি দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। ঘরের মায়া ছেড়ে দিয়ে একটু দুরে আসতেই মনে লোভ হল, সদ্য কেনা নতুন টেপ রেকর্ডারের প্রতি। কয়েকদিন আগে এটিকে পনের হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি মাত্র। স্ত্রীর কোলে ছোট সন্তানকে তুলে দিয়ে বড় ছেলেটাকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তোমরা একটু দাড়াও। আমি আসছি।
ঘরের ভেতর থেকে টেপ রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে বের হয়ে আসতেই স্ত্রীর মুখে বিকট শব্দে উচ্চারিত হতে শুনলাম, ও আল্লারে। বাচাও আমার কলিজারে। সর্ব শক্তি দিয়ে গতির স্রোতকে ঠেলে দৌড়ে এলাম। কিন্তু কোন কাজ হলনা। এতক্ষণে আমার সব শেষ।
দুসন্তানকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে স্রোতের প্রচন্ড ধাক্কায় স্ত্রী পড়ে ভিজে গেল। উঠতে বুঝতে পারল বড় ছেলেটা ওর হাত থেকে ছুটে গিয়েছে। কোলের সন্তানের মায়ায় বড়টিকে ধরে রাখতে পারলো না। হাত থেকে ছুটে যাওয়া ছেলেটি মুহুতের মধ্যেই স্রোতের টানে দুরে সরে গেল। ছেলের মুখ থেকে বার বার আওয়াজ ভেসে আসছিল, মা, আমাকে বাঁচাও। শব্দ কটি কয়েকবার উচ্চারিত হবার পর আর শোনা যায়নি। তলিয়ে গেছে পানির নীচে। জ্যান্ত সন্তানটিকে চোখের সামনে লাশ হয়ে ভেসে যেতে দেখে শুধু মাত্র ' ও আল্লাগো, তুমি একি করলা...' শব্দটি খায়ের সাহবের কানে ভেসে এসেছিল।
একদিকে স্রোতের প্রচন্ড গতি বেগ, অন্যদিকে আকাশ থেকে ছুড়ে মারা অগ্নি বজ্রপাতের আতঙ্ক, চারিদিকে পানির সাথে ভেসে যাওয়া স্বজন হারাদের বেচে থাকার বুকফাটা চীৎকার, বিভীষিকাময় এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষায় মরিয়া হয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে গিয়ে সন্তান হারানোর বেদনাকে গিলে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। কিভাবে যে বাড়ী থেকে একটু দুরে অনেক বড় একটা দালান ঘরের বারান্দায় এসে ঠাই নিলাম মনে নেই। আমার মত আরও অনেকের এ সাময়িক আশ্রয়স্থলটুকু যেন স্বজনহারাদের কান্নায় একাকার হয়ে গেল। কে কাকে শান্তনা দেবে!
....আজ সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে নিঃস্ব খায়ের সাহেবকে। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, এ ব্যাংকের প্রতাপশালী খায়ের সাহেব শিশুর মত করে কাঁদছে। কয়েকদিন আগেও তিনি ঘুষ খাওয়া নিয়ে ঔদ্ধত্যপুর্ন মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, আমাকে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে বঙ্গোপসাগরের ওপারে ট্রান্সফার করলেও সাগরে ঢিল ছুড়ে দেখব উত্তর কি আসে। সৎ মানুষগুলো যখন প্রাপ্য মাসিক মায়না দিয়ে চাল ডাল আর আলূ ভর্তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খায়, তখন খায়ের সাহেব পকেট ভর্তি ঘূষের টাকা নিয়ে বাড়ী ফিরতেন উৎফুল্ল মনে। দুহাত ভর্তি বাজার নিয়ে রিক্সা হাঁকিয়ে ছুটে যেতেন বাড়ীর দিকে। ঘূষের টাকায় রাতারাতি অর্থনৈতিক উন্নতিতে গ্রামের মানুষ গুলো খায়ের সাহেবের চাকুরীরর অভূতপুর্ন সাফল্য নিয়ে গর্ব করত। ইস! ভাগ্য কতটুকু সুপ্রসন্ন হলে মানুষ সরকারী চাকুরীতে এত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রমজানের সময় মসজিদে সবার চেয়ে বেশী দান খয়রাতে খায়ের সাহেবের জন্য দুহাত তুলে দোয়া করতেন ইমাম সাহেব। সবাই শত বার আমীন আমীন বলে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইত খায়ের সাহেবের জন্য। আজ সেই অনুদান আর প্রাপ্য দোয়াও খায়ের সাহবকে রক্ষা করতে পারেনি। আহ! কি অদ্ভুত শাস্তি মহান প্রভুর বিচারালয়ে!
......২৯শে এপ্রিল, ১৯৯১ সালের এ ভয়াল বন্যায় কম বেশী সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হলেও খায়ের সাহেবের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিপর্যয় অবাক হওয়ার মত। রেয়াজুদ্দিন বাজারের স্বল্প আয়ের বাকহীন ফল বিক্রেতাদের পকেট থেকে জোর করে নেয়া টাকায় তিল তিল করে গড়ে তোলা খায়ের সাহেবের সাজানো সংসার আজ আর নেই। এটি যেন এক বিরান বাড়ী। গতকালও এখানে কেউ সুখের সংসার সাজিয়ে বসবাস করেছে বলে দেখে মনে হয়না। অদেখা আখেরাতের কল্পিত জান্নাতের পরিবর্তে বিশ্বাস বোধের কষ্টি পাথরে গেথে থাকা দুনিয়া ভোগের লালসায় নিজের মত করে সাজানো তাজমহল তছনছ হয়ে গেছে একরাতের ঘূর্ণিঝড়ে। সকাল বেলার রাজা খায়ের সাহেব আজ ফকির সন্ধ্যা বেলা। সন্তান হারানোর শোকে মুহ্যমান, সুর্যাস্ত আর সুর্যোদায় এ দুয়ের মাঝখানের ৮-১০ ঘন্টার ব্যাবধানে পথের ফকির হয়ে গেলেন খায়ের সাহেব। নিঃস্ব খায়ের সাহেবের এ করুণ পরিণতি দেখে অনুভুতি আর অনুশোচনার ভাষায় গাওয়া কবি মল্লিকের কণ্ঠে বড় অাক্ষেপের সুরে গাওয়া গানটিই আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে..
সময়..............
ফুরালে মনে হয় সব অভিনয়।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৪১৩ বার পঠিত, ৩৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুঃখজনক হলেও কষ্ট পেলাম না বরং শিক্ষা পেলাম।
ফুরালে মনে হয় সব অভিনয়....
আপনার কলমের প্রতিটি অক্ষরে গড়া শব্দগুলো জীবন্ত ।হুট করে কলম থামিয়ে দেবেন না ।দয়া করে ।
অহং ১ মুহুর্তে শেষ! গতকালের গর্জন এখন কান্না। আহ!!! বান্দার হক যে নস্ট করলো ভুড়ি ভুড়ি অনুশোচনা হলেও সেটা কিভাবে পুরন করবে?
আফসোস....
আল্লাহ আমাদের পানাহ দান করুন।
ডান দিকে চলতে চাই
ডানে চরিত্র রাখতে চাই
ঈমানের সাথে মরতে চাই
হে আল্লাহ! আমাদের ঈমানকে মজবুত করে দাও। তোমার পথে চলার তাওফীক দাও।
শিশুটির জন্য প্রচুর মায়া লাগছে।
ধন্যবাদ অনেক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন