রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-৩৭)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ০১ জুন, ২০১৪, ০৪:৩২:০৪ বিকাল
পর্ব-৩৬
অনেকক্ষণ পর ভেতর থেকে ছবি হাতে ফিরে এসেছে বিপু। চেয়ারে বসতেই অনুরোধের সুরে জানতে চেয়েছে,
- স্যার। আপনি কি আমাকে আর্ট শেখাবেন? আমার খুব ইচ্ছে করে...।
- ঠিক আছে। মাথা নেড়ে অকপটে সমর্থন জানালাম। ভাবছি, অবুঝের এ পাগলামী কে থেমে দেয়ার জন্য সব কিছুতে হ্যা বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। আবেগের মানুষদের মুখের উপর কিছু বলতে নেই। বরফ যেমন আগুনকে নিভিয়ে দেয়, আবেগী মানুষকেও মিছে বাহানায় 'হ্যা' জবাবে নিমিষেই সব ঠান্ডা করে ফেলে। সময় ক্ষেপণের সাথে প্রয়োজন একটু ধৈর্য্যের। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় মারামারি বৈ কিছুই হয়না। আর রাগের মাথায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সব সময় ভূলই হয়ে থাকে। বিপুকে ঠান্ডা করার জন্য এটাকেই কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছি।
....না। আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবেনা। ব্যস্ততা দেখিয়ে বিপু থেকে বিদায়ের পালা এবার। তবে চিরতরে নয়। শুধুমাত্র আজকের জন্য। আপাতত 'পড়ানোর পর্বের' সমাপ্তি না টানিয়ে আবারও আসবো বলে আশ্বস্ত করে বিপু থেকে বিদায় নিলাম। বের হবার আগে স্যারের সাথেও কথা বলে নিলাম। বললাম, নিয়মিত না আসতে না পারলেও মাঝে মধ্যে আসবো...ইত্যাদি।
কিছুুুু দুর যাবার পর পেছন ফিরে তাকালাম। বিপু-তাহুরা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দেখছে আমার চলার গতিপথকে...। মানুষের মনতো। আমারও কুব খারাপ লাগছে। আসা যাওয়ার এ পথে আমার পদচিহৃ আর পড়বেনা। মনে মনে কবি রবি ঠাকুরের বিদায়ের সেই শেষ গানটাই গাইছিলাম,
"আমার পায়ের চিহ্ন পড়বে না আর এই বাঁকে গো..."।
মানুষ সামাজিক জীব। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে তিল তিল করে গড়ে তোলা অনেক বাস্তবতাকে ভুলে যেতে হয়। ভুলতে বাধ্য হয়। যৌবনের আকর্ষন বিকর্ষণের শুরুর এ সময়টিতে হৃদয়ের ভেতরে কাজ করা চুম্বক শক্তির টানে সব মানুষই প্রেম নিয়ে ভাবনার এক নতুন জগতে হারিয়ে যায়। হারাতে ভাল লাগে। চলার পথে দেখা হওয়া সব গুলো শুভাসিত ফূটন্ত ফুলই যেন দৃষ্টিশক্তিকে কেড়ে নেয়। আটকে দেয় কিছুক্ষণের জন্য। আহব্বান করে ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত মোহনীয় এক অজানা শক্তির দিকে। চোখের দৃষ্টিকে অভিভুত করে ফেলে ভালবাসার যাদুকরী মোহ মায়ায় । মন্ত্রের মতই যেন নিয়ন্ত্রণহীন হৃদয়ের আকর্ষ বিকর্ষণে সৃষ্ট বিদ্যুতে আতকে উঠে। নিজের মাঝেই নিজে চমকে উঠে।
অবুঝ মনের এসব পাগলামীর নাকে রশি লাগিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সিদ্ধহস্ত মানুষেরাই এসব পাতানো জাল এড়িয়ে গন্তব্যে পৌছে যায়। ওরা ভাবে, বাগানের সব ফূলতো আর আমার জন্য নয়। এমনটি ভাবা বোকামি বৈ কিছুই নয়। আমিও ভাবুকের মত ভান করে এমনটিই ভাবছি চলার পথে দেখা হওয়া বিপুর মত ছাত্রীদের নিয়ে।
একজন সাদা মনের মানুষ মানেই - পঞ্চেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধহস্ত একটি কঠিন অনুশীলনের লোক। একজন সাদা মনের মানুষ মানেই - হাজারো ঘাত প্রতিঘাতে সয়ে থাকা জীবন্ত এক 'নির্বাক লাশ'!
নতুন চাকুরীতে যোগ দেয়ার তিন মাস পরের ঘটনা। বন্ধু মিজান আর মানিক এসেছে কুমিল্লা থেকে। বৃহস্পতিবার। দুপুর ১টা। ওরা পুরোনো লজিং মিস্ট্রেসের দুত হয়ে এসেছে। বড় বোনের পাতানো ভালবাসাকে বাঁধা দিতে গিয়ে ছোটবোন মনের অজান্তেই প্রেমের ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই। নিজেই নিজের কল্পনার রাজ্য গড়ে তুলেছে ভালবাসার মহাসমুদ্র। সেই সমুদ্রের নোনাজলে হাবুডুবু খেয়ে একেবারেই একাকার।
- তোরা দুজন হঠাৎ করে আসার কারণ কি? জানতে চাইলাম।
- 'হার এক্সিলেন্সি', মাদার অব ইউর আননোন ডারলিং '......' এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার প্রস্তাব নিযে দুত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।
- ওরে বাপরে বাপ! তাহলে তোমরা এখন প্রেমের দুতের সাকসেস মিশন নিয়ে সুদুর কুমিল্লা হতে চট্রগ্রাম এসেছ। কবে এসব 'বাটপার এসোসিয়েশন' এর সদস্য হলি? এটাই কি প্রথম মিশন?
- জ্যী জনাব।
- তয় বলেন তো দেখি, 'হার এক্সিলেন্সি' মাদার অব ইউর আননোন ডারলিং কি বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছে?
- বড় বোনের পাতানো প্রেমের ফাঁদ উম্মোচন করতে গিয়ে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া ছাত্রীটির বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু মেয়েটি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তার আম্মুকে অনুরোধ করেছে, যাতে আপনার থেকে একটি বার সম্মতি নেয়, তাকে বিয়ে করবেন কিনা? আপনি ব্যাংকে চাকুরী করেন। তাই ওর আম্মু আমাদের ডেকে পাঠিয়েছে আপনাকে বিষয়টি জানাতে।
- তার মানে?
....সে আমাকে ভালবাসে, এটি অনেক দুর থেকে জেনেছি। কিন্তু আমি তো ওকে....। হাহা। যাক আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছে যে, আমার কাছে দাবী করার মত এমন কোন পথ ওকে খুলে দেইনি । তাছাড়া, চাকুরীতে যোগ দিয়েছি মাত্র। কঠিন বাস্তবতায় ছিটকে পড়ে বি.এস.সি. পরীক্ষাটা দিয়েও ড্রপ দিলাম। এখন চাকুরী করেই বি.এ. পরীক্ষার দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। সুতরাং এমতাবস্থায় এসব পাগলামী কে মুল্যায়ন করার কি সময় আছে?
- তাহলে ফিরে গিয়ে আমরা কি জবাব দেব আপনার 'মাদার অব আননোন ডারলিংকে'?
- গিয়ে বলবেন, আমাকে ব্যাংকে পাওয়া যায়নি। আমি ঢাকা গিয়েছি আননোন অফিসিয়াল কাজে। আসতে এক সপ্তাহের বেশী সময় লাগবে.....। খালাম্মা, বিষয়টি যেহেতু এক পক্ষ, তাই...।
দু সপ্তাহ পরের কথা। বন্ধু মানিক বসে আছে অফিসের সোফায়। কালো চশমা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। প্রথমে কাষ্টমার মনে করলেও পরে ভাল করে খেয়াল করে দেখি,
- অ্যারে..মানিক্যা। তুই?
- হাহা। আজকে আমি কারো 'মাদার অব আননোন ডারলিং' এর দুত হয়ে আসিনি। নিজ খরচে এসেছি ভাল একটা খবর দেয়ার জন্য।
- হুম। তার মানে আমার আননোন ডারলিং টার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই না?
- ঠিকই বলেছিস। আমি দেখতে এসেছি তোর কঠিন হৃদয়টাকে একটু দেখতে। ক্
ক্যামন করে পারে মানুষ ভূলতে এমন সুন্দরীকে,
ক্যামনে করে দেয় ফিরিয়ে, মজনু প্রেমের লাইলীটাকে
আহ! কি করে তুই পারলি হাতের নাগালে পাওয়া এত সুন্দর মেয়্টাকে না করে দিতে!
- হাহা। দ্যাখ। বাবা মৃত্যুবরণ করেছে, সেই কতদিন হল। যে মানুষটি দারিদ্র্যতার কষাঘাতে অনেক না পাওয়ার বেদনাকে গলাধঃকরণ করতে অভ্যস্ত, পুরোনো জামা পড়ে দশ বছরের সাধনার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে পাহাড় সম যাতনাকে বুকে ধারণ করে, যে কারণে-অকারণে অনেক চাওয়া পাওয়াকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, ওর মুখে দেখা মুচকি হাসিটি মনের একমাত্র অভিব্যক্তি নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে হাজারো অজানা কাহিনী। এসব ভালবাসা, প্রেম, পাগলামী আমার জন্য নয়....। দরিদ্রতার কষাঘাতে অনেক কঠিন প্রেম ও জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। আর সে পালিয়ে যাওয়া প্রেমের যাতনার চেয়ে নিজেকে এসব থেকে গুটিয়ে নেয়া উত্তম নয় কি?
মানিক আমার সব কিছুই জানে। তাই ও বেশি কিছু বলেনি।
বিপু জানেনা, অনেক ঘাত প্রতিঘাতের জীবন্ত স্বাক্ষী, হাসি তামাশায় মেতে থাকা স্যার চিন্তা চেতনার দিক থেকে অন্য জগতের এক মানুষ। স্বপ্নে গুলি খেয়ে হৃদয়ে শিহরণ সৃস্টি করার মানুষ এটি নয়।
..এক সপ্তাহ পর বিপুকে একবার পড়াতে গিয়েছিলাম। তার পর দু সপ্তাহ পর। তারপর আমি অার নাই। নাইরে নাইরে নাইরে নাই। কথায় আছে না,
কাছে এলে পোড়ে মন,
দুরে গেলে ঠন ঠন।
দুরে যেতে যেতে আমিও বিপুর কাছে ঠন ঠনের তালিকায় নাম লিখে হারিয়ে গেলাম চিরদিনের জন্য। অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুনতে হয়তব মনের অজান্তেই এক সময় গাইবে..
তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদের নাম।
সে এখন গোমটা পড়া কাজল বধূ দুরের কোন গায়
যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে পাওয়া যায়...।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৩ বার পঠিত, ৫৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রেম ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে লেখক খুব সিদ্ধহস্ত । বুঝা যাচ্ছে ।
ধন্যবাদ ভাল লাগলো ।
মাঠ জুড়ে বৃষ্টির জল, জমবে ভালো ফুটবল,
জলে ভিজে কামিনী হবো ব্যাটাদের জিভে আসবে জল।
ঘরে বসে আর হবেনাকো ভুল,
মাঠের জলে মাস্তি হবে, হবো না হয় এবার তেঁতুল।
জানিয়ে দেব সবাইকে মোরা তেঁতুল নারীর দল,
রান্না বান্না নয় শুধু, জানি ছলা কল।
ধন্যবাদ
আল্লাহ আপনাকে উত্তম চরিত্র দিয়েছেন ভাইজান ,,আল্লাহর শুকরিয়া
সে এখন গোমটা পড়া কাজল বধূ দুরের কোন গায়
যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে পাওয়া যায়...।
এই সত্যটি আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে আরো সত্য। সত্যি আমরা অনেক মল্লিকাদের ভুলে গেছি।
আর ভুলে যাবার কারনেই আজ আমাদের এই অবস্থা। আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনার প্রেম ভাইরাস জয়ের কাহিনী আগের জানা। আমরা ভুলটা এখানেই করি; বিবেক কে ভুলে আবেগের স্রোতে গা ভাসাই।
মানিক আপনার প্রেম বিশারদ বন্ধুর কপালে কি জুটল? কেমন আছেন উনি?
আমি তাহা নই যাহা বলে বেড়ায়,
নির্বাক আমাকে আহাজারী তাড়িয়ে বেড়ায়।
ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্যটা কলিজায় লেগেছে। আপনি অল্পে ঠিক কথাটা বলেছেন।
জী স্যার।
আমি নিষ্ঠুর, আমি প্রেমহীন
কাঠফাটাঁ রৌদ্রের শুকনো বিন।
আমি যাদুময়ী প্রেমের বংশীবাদক
পেয়েও হারানো প্রেমের মিছে যাযক।
আমি তাই যাহা আপনি ভাবেন...ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ এই ভাইকে। অনেক কিছু শিখলাম।যাযাকাল্লাহ।
ঝঞ্ঝার মত ছুটে আসুক মর্তপানে,
জরা যত যাক উড়ে যাক মর্মতানে।
শ্রীনগরীর স্বর্গসম করুনাভায়
কি দেখা যায় হৃদিতাঁরায়
আজ এ দিনে !
এখানে দিতে না চাইলেঃ
আমার ইমেইল
সেই দুরের গায়ের বধূদের কোনো খোজ-খবর নিশ্চয়ই নেই!
তবে আমার কিশোর বয়সের এক 'হার এক্সিলেন্সি' মাদার অব .. আননোন ডারলিংয়ের খবর নিয়েছি সম্প্রতি। তবে মাত্র ২০ বছর পর!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন