রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-৩৬)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৭ মে, ২০১৪, ০৫:০৬:১০ বিকাল
পর্ব-৩৫
নাস্তা পানি খাওয়া শেষ। এবার পড়ানোর পালা। কিন্তু বিপু যে নেই। ছাত্রী বিহীন শিক্ষক খালি টেবিল সামনে নিয়ে একা বসে আছি । ভেবেছিলাম, বিদায়ের এ শেষ বেলায় কিছু্ উপদেশ দিয়ে চলে যাবো। কিন্তু সেটা আর হলনা। বিপুর চোখের জলে সব ভেস্তে গেল। এভাবে বিদায় নেয়া ঠিকও হবেনা। আরও একটু সময় নিতে হবে।
কোথাও একাকীত্বে আকা জোঁকা করা আমার চিরাচরিত অভ্যাস। এখন আমি একা। রুমে কেউ নেই। ইচ্ছে হচ্ছে সময় পার করার জন্য কিছু একটা আঁকা জোকা করি। রুমের সাদা দেয়াল। একটু উপরে ঝূলে আছে ফ্যামেলীর সাথে তোলা বিপুর পুরোনো ছবি। । ভাবছি, বিদায় বেলায় ছবিটা এঁকে রেখে যাবো। দেখলে বিপু ও খুব খূশী হবে। অনুপস্থিতিতে আমার রেখে যাওয়া স্মৃতি কথা বলবে। দারুণ আইডিয়া। উপস্থিত বুদ্ধিটা ভালই লাগল। শুরু হল এ্যাকশন।
ছবিটা বাম হাতে ধরে ডান হাতে বিপুকে আঁকছি। একেবারে মনের মাধুরী দিয়ে। ছবি আঁকার আনন্দটাই অন্যরকম। যে পারে সেই বুঝে। সময় কখন কিভাবে যে পার হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। আমি সেই আনন্দই খুঁজে পেয়েছি। বিপুর ছবির মাঝে ঢুবে গেছি আমি । রুমে কে আসল আর কে গেল খবর নেই।
কিছুক্ষণ পর তাহুরার প্রবেশ। বিপুর ছবিটা পেন্সিলের ছোঁয়ায় হুবহু আঁকতে দেখে তাহুরা বিস্মিত। 'থ' হয়ে দাঁড়িয়ে খুব অপলক দৃস্টিতে দেখছে। পেন্সিলের ঘর্ষণে ক্রমেই বিপুর ঠোঁট আর চোখ দুটো উঠে এসেছে। চোখের দৃস্টি দিয়ে যেন পেন্সিলের বিপু তাহুরার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহুরা নিঃশব্দে একেবারে স্থির হয়ে আছে। নিজের মত করেই দেখছে সব কিছূ। হঠাৎ 'ওয়াও' শব্দ করে উল্লাসিত মনে দ্রুত বেরিয়ে গেল তাহুরা। ...নিশ্চিত ও বিপুকে খবরটি দিতে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর বিপু এসেছে। মনটা খুব ভারাক্রান্ত। রুমে ঢুকতেই ছবিটা দেখে যেন মনটা ভাল হয়ে গেল। নিজের ছবি আঁকতে দেখে খুশিতে আটখান বিপু কাছে এসে মাথাটা টেবিলের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল। খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে কাগজে আঁকা পেন্সিলের বিপুকে। উঠে আসা তার অবয়বকে।
মনে মনে ভাবছি, তাকে সহজ করার সময় এখনোই। তাই কখনও বলছি, পেন্সিল টা একটু শার্প করে দাও। রাবার টা এগিয়ে দাও। ছাত্রী শিক্ষকের যৌথ উদ্যোগে ছবি আকার মাঝে এভাবেই হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণ। ও তন্ময় হয়ে দেখছে।
ছবির দিকে ধ্যান রেখে বিপুকে বললাম, আমি জানি তোমার মনটা আজ ভাল নেই। কারণ তুমি অন্য দশটা ছাত্রী থেকে ভিন্ন। তুমি খুবই আবেগী। নরম একটা মন দিয়ে আল্লাহ তোমাকে বানিয়েছে। তোমার সমস্যা এখানেই। তোমার শ্রদ্ধাবোধের ধরনটতে অন্যরকমের একটা ভিন্নতা আছে। আর এ জন্যই হাজার কষ্টকে ভূলে গিয়ে সেই কতদুর থেকে ছুটে আসি তোমাকে পড়াতে।
আমার প্রতি অনুতপ্ত হওয়ার জন্য বিপুকে আর একটু বাড়িয়ে বলতে শুরু করলাম
- জানো, তোমাকে পড়াতে গিয়ে কতটুক সেক্রিফাইস করতে হয়েছে আমাকে! কত রাত শুধু ডাল দিয়ে বাসায় ভাত খেতে হয়েছে। আমার পাকের দিন পাকাতে পারিনি। ম্যাচের লোকেরা অপেক্ষা করে হোটেলে খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমি বাসায় যেতে যেতে হোটেলও বন্ধ। অবশেষে পুরোনো ডাল-ভাত দিয়েই পেটকে শান্তনা দিয়েছি ঘুম পাড়িয়েছি।
তোমাকে পড়াতে এসে এসব কস্ট ভোগ করলেও মাঝপথে ফেলে যেতে চাইনি। কারণ, ছাত্রী হিসেবে তোমার সুপ্ত মেধাকে জাগিয়ে তোলা ছিল আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। তোমার বাবার দেয়া দায়িত্বটাকে নিজের মত করে নিয়েছি। সর্বোপরি, খুব ছোট বোনের মত করেই কেন জানি তোমাকে ভাবতে ভাবতে এতগুলো সময় পার করে দিয়েছি।
বিপুর মুখের ভিষন্নতা অনেক আগেই কেটে গিয়েছে। চোখের পানি উধাও। ও এখন অনেকটা স্বাভাবিক। মুখে মুচকি হাসি ফিরে এসেছে। স্যার নিজ হাতে তার ছবি আঁকছে। এটি একটা অনন্য স্মৃতি। মনের আয়নায় স্যারের শ্রদ্ধাবোধ যেভাবেই চিত্রিত হোক না কেন, স্যারের হাতে আঁকা ছবির স্মৃতি বিপুর চোখের সামনে থাকবে, এ অনুভুতির প্রকাশই অন্যরকম।
- বিপু।
- জ্যী স্যার।
- তোমাকে একটা কথা বলব?
- জ্যী স্যার বলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে বিপু উত্তর দিয়ে নড়ে ছড়ে বসল।
- দ্যাখ। জীবনে অনেক ছাত্র ছাত্রী পড়িয়েছি। কিন্তু কোন ছাত্রীর ছবি এভাবে আমার হাতে আঁকা হয়নি। আজ কেন আঁকছি জানো?
- বিপু নিশ্চুপ।
- অন্য দশটি ছাত্রী হতে তুমি আমার কাছে অন্য এক বিপু। তোমাকে ছোট বোনের মতই জানি। তোমার সাথে যতটুকু সহজ হয়েছি, মন খুলে কথা বলেছি, এমনটি আর কারো সাথে হইনি। আর এটা হয়েছে, তোমার বাবার কারণেই। তোমার শ্রদ্ধাবোধের কারণে।
আমি যদিও আজকে বিদায় নিতে এসেছি, কিন্তু এ বিদায় শেষ নয়। মাঝে মধ্যে অবশ্যই আসব। আগে তোমাকে সপ্তাহে তিন দিন পড়াতাম। এখন একদিন হলেও আসব। তবে যদি তুমি আমার কাছে পড়তে চাও।
- জ্যী স্যার। আপনি অবশ্যই আসবেন। আমি কিছুক্ষণ আগেও মাকে বলেছি, যাতে আপনাকে বলে, মাঝে মধ্যে অন্তত আমাকে পড়াতে আসতে। বাবাকেও ঠিক তা্ই বলেছি। আপনি একেবারেই চলে যাবেন, আমার মা বাবা এমনটি চায়না। কিন্তু আপনার সমস্যার কথা বিবেচনা করে জোর দিয়ে কিছু বলে না।
বিপুর ছবি আঁকা শেষ। পেন্সিল অার্ট কর্ম শেষ হলে এটির সৌন্দর্যই অন্যরকম। আজ তাই হল। দুরে দেয়ালের সাথে ঝুলিয়ে বিপু বার বার দেখছে। আর বলছে,
ওয়াও স্যার। আপনার আঁকা ছবিটা এত দারুণ হয়েছে যে বলার মত নয়। আমার স্কুলের বান্ধবীরা দেখলে তো একেবারে পাগল হয়ে যাবে। ওরা জানে আপনি ছবি আঁকতে জানেন। কিন্তু এত নিখুঁতভাবে পারেন, এমনটি আমিও জানতাম না।
.........জীবনে এ প্রথম, স্যারের হাতে পেন্সিলে আঁকা 'কাগজের বিপুকে' নিয়ে উল্লাসিত মনে ভেতরে চলে গেল 'বিপু'।
ভাবছি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিহীন কবিরাজের দেয়া তাবিজ বিপুর মাঝে দারুণভাবে কাজ করেছে। আর যাই হোক, আপাতত সম্ভাবনাময়ী ৪ নাম্বার বিপদ সংকেত থেকে বাঁচা গেল। বঙ্গোপসাগরের গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসা বিক্ষুব্ধ ঝড়ের প্রচন্ড গতিবেগ যে কোন সময় উপকূলীয় ঘরবাড়িতে আঘাত হানার জন্য রেডিও 'আকাশ বানী' থেকে যে সর্তর্কবানী দেয়া হয়েছিল, তা ধুমড়ে মুছড়ে আছাড় খেয়ে আবারও সাগরের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৮ বার পঠিত, ৫৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাক এবার অন্তত ঝড় থেকে বাঁচা গেল !
কিন্তু সপ্তাহে একবার আসলে সে ঝড়ের মুখোমুখি হতেই হবে । সো থিংক অ্যাগেইন..........।
বিপুর বয়স কম। তাই সে পরিণতি চিন্তা না করেই আবেগী আচরণ করেছে। কিন্তু লেখকও যদি তাই করতেন তবে ঘটনা অন্যদিকে চলে যেত।
আপনার ছবি আঁকার কথা আগে জানতাম না এখন জেনে ভালই লাগলো।
জ্যাস্ট ফান.... মাইন্ড খাইয়েন্না
এ সিরিজটি শেষ করে আর্টের উপর পোস্ট দেব। ধন্যবাদ।
১৯৪ সাল পর্যন্ত বংশী বাদক ছিলাম। রাতের অন্ধকারে গায়ের ব্রিজের উপর বসে সুর তুলতাম। শেখবেন? শিখিয়ে দেবো। ইট পাথরের শহরে যাবার পর এটির চর্চা আর হয়না। তবুও চট্রগ্রাম গেলে শ্যালকের অনুরোধে বাজাতে বাধ্য হই। ও আমার বাঁশীর সুর শুনে বাঁশীর প্রতি আসক্ত হয়েছে। এখন আমি বাজাই না। ও বাজায়। সে প্রশিক্ষণও নিয়েছে।
তিন বছর আগের কথা। নাটক লিখে, অভিনয় করে মাতিয়ে রাখতাম মানুষদের। এখন বিদায় নিয়েছি। কেন?
..না। বলতে ইচ্ছে করেনা। ঘুমন্ত বেদনা গুলোকে বরফ দিয়ে ঢেকে রেখেছি। এভাবেই থাক।
............... রেডিও 'আকাশ বানী' থেকে যে সর্তর্কবানী দেয়া হয়েছিল, তা ধুমড়ে মুছড়ে আছাড় খেয়ে আবারও সাগরের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে।
এ না হলে কি ক্যারিশমেটিক এবং ডাইনামিক কোয়ালিটির শিক্ষক হওয়া যায়?
চারি পাশে যাহা ঘটেছিল
হৃদয়ে করে নিয়েছিল ঁঠাই।
আমি হারিয়ে যাই
যেখানে শৈশব কৈশর আজও স্মৃতি,
ফিরে পাবার নেশায় কল্পনায় হাটি
আজও কানে বাজেই সেই সুমধুর গীতি।
ধানের ক্ষেতে আজও ছুটে বেড়াতে
শুণ্যো ভর করে নিজেকে হারাই,
উলঙ্গ সভ্যতার নিষ্ঠুরতা আর নয়,
অতীত, যে স্বর্নযুগ, যেথায় সবাই মোরা ভাই।
বাজনার তালে আমি মেতে উঠি না
ডুগডুগির সাথে চাই হারানো ভাটিয়ালির সুর,
নদীর বুকে নব বধূ নিয়ে মাল্লার সারী
গান গেয়ে গেয়ে চলে যেতে দুর, বহুদুর।
প্রকৃতির সাথে মিতালী সেই যুগ আজ নেই
নেই ভোরে মোরগ ডাকা কিংবা পাখির গান,
সভ্যতার দালানে গ্রাম আজ শহর হয়েছে
শুধু নেই নিষ্ঠুরতার পদভারে নির্বাক গায়ের প্রাণ।
তারপরও সভ্যতা নিয়ে তোমাদের বড় অহংকার
ভুলে যাও বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবা নামের বুড়ো বুড়ি.
ছিঃ পাষন্ডদের এ যুগ আমাকে বাকহীন করেছে
তাই আবারও হতে চাই স্মৃতিদের ইচ্ছে-ঘুড়ি।
অন্যরকম ভালো লাগছে আপনার সিরিজটা।
সাধ্যমত সঙ্গ দিয়ে যাব, এগিয়ে যান।
দেখাইতাম তোরে আমি ভালবাসি কত।।
পুরা হাইড্রলিক ব্রেক
তারপর ফিস ফিস বাতাসের শব্দ।
অন্য রকম লিখার ভিন্ন রকম স্বাদে অনেক কিছুই শিখিয়ে গেলেন। যাযাকাল্লাহ।
তবে ছবি আঁকতে পারিনা।
আমার মনে হয় অনেক সময় নিয়ে লিখতে হয় এভাবে।
ধন্যবাদ আবারও।
মন্তব্য করতে লগইন করুন