রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-৩৪)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৪ মে, ২০১৪, ১১:০৬:৪৭ রাত
পর্ব-৩৩
আগামী শনিবার বিপুর পরীক্ষা শেষ। তাই বৃহস্পতিবার অর্ধ অফিস শেষে আজ আর বিপুদের বাসায় যাওয়া হয়নি। নিয়ম ভেঙ্গে এই প্রথম বারের মত শুক্রবারে পড়াতে গিয়েছি বিপুকে। পরীক্ষার সর্বশেষ বিষয় 'ইসলাম ধর্ম শিক্ষা'। এটি পড়ানোর প্রয়োজন তেমনটি না হলেও বিদায়ের পুর্বে শেষ হাজিরা অবশ্যই দেয়া উচিত। তাই গুরুত্বের কথা ভেবেই পড়াতে গিয়েছি। শুক্রবারে পড়াতে যাবার কথাটা গত বুধবারেই বলে এসেছি ।
আজ পড়াতে বসতেই বিপুর উত্তর ছিল, স্যার - আপনার দেয়া সবটুকু পড়া গতকাল শেষ করেছি। গতরাতে অনেক পড়েছি।
- খুব খুশী হলাম তোমার সেলফ মোটিভেটেড পড়ার কথা শুনে, বিপুকে জবাব দিলাম।
- স্যার। আপনি কি সত্যি সত্যিই বিদায় নেবেন? আমাদের বাসায় জীবনে আর কক্ষনো আসা হবেনা ? দেখা হবেনা আপনার সাথে?
ছল ছল দৃষ্টিতে আবেদনের সুরে বলা বিপুর কথাগুলো ছিল খুবই আবেগাপ্লুত। বিপুর দিকে তাকিয়ে আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
- স্যার তো স্যারই। তোমার জীবনে কত স্যার আসল আর গেল। সবার বিদায়ে কি তুমি এমনটা করেছিলে? অতীতের কোন স্যার তোমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে বলে মুখে শুনিনি কখনও। সুতরাং আমার মত একজন স্যারের বিদায়ে তোমার এত অনুভুতির কারণ কি বলত!
আড়ষ্টতা কণ্ঠে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বিপু কথাগুলো ছিল এমন- "স্যার। আপনি আসলেই একটা সমস্যা। সমস্যা এজন্যই বলছি যে, অন্যান্য স্যারদের মত আপনার মাঝে কোন কঠোরতা খুঁজে পাইনি। ছাত্রীর সাথে দূরত্ব বজায় রেখে পড়ানোর পরিবর্তে কেন জানি তাদের ভেতরের মানুষটির সাথে পরিচিত হন। খুব নিজের মত করেই ওর সাথে আপন হয়ে যান। সব জড়তা দুর করে ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের উধ্বেঁ বন্ধু সুলভ সম্পক তৈরী করে নেন। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের মিছে ভয়টা কে বিদায় করে দিয়ে তাকে স্বপ্ন দেখান। কাছে টেনে নেন। ভেতরে লুকিয়ে থাকা জিনিয়াস কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন।
আজ পর্যন্ত আপনি কখনও আমাকে ধমক দিয়ে পড়া আদায় করেননি। আমাকে প্রথমে পড়ার গুরুত্ব বোঝানোর পাশাপাশি ভাল ছাত্র কিংবা জ্ঞানীদের পড়ার পদ্ধতি শুনিয়ে দারুণ ভাবে নিজের ভেতর আগ্রহ তৈরী করেছেন। আপনার এসব কথাগুলো আমার খুব খুব ভাল লাগত। আর সে ভাল লাগার কথাগুলো মা বাবা, বান্ধবী সবাইকে বলতাম। বলে আমি শিহরিত হতাম। স্বপ্ন দেখতাম নিজেকে নিয়ে।
আমি ছাত্রী হিসেবে বেশী ভাল নয়, এটি খুব ভাল করে জানি। এজন্য পড়ার আগ্রহটা তেমন ছিলনা। কিন্তু আপনি আমার মাঝে কিভাবে যে সে আগ্রহটা তৈরী করলেন, নিজেই বুঝতে পারিনা। আপনার দেয়া পড়া পারি আর না পারি, আপনার আসার অপেক্ষা আমি প্রতিদিনই করতাম। শেষের দিকে আমাকে নিয়মিত পড়াতে আসতে না পারায় কস্ট লাগলেও আপনার ক্ষতি করে আমাকে পড়াতে আসবেন, এমনটি আমিও চাইনি।
সত্যি কথা বলতে কি, আপনার উচ্ছসিত প্রশংসায় আমি নিজেকেই খুব ভাল ছাত্রী হিসেবে ভাবতে শুরু করলাম। আর সে ভাবনা থেকেই পড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ তৈরী হল। ক্রমেই ভাল ফলাফল নিয়ে আসতে শূরু করলাম। এতদিন ধরে যে পরীক্ষাটা দিচ্ছি, এটি আমার জীবনে সবচেয়ে সহজ এবং আনন্দদায়ক পরীক্ষা।
এসব কিছু মিলিয়ে অাপনি আমার মাঝে স্যার হিসেবে আর নেই। আমার ভেতরে বাস করা আপনি এখন আমার 'খুব খুব প্রিয় একজন মানুষ'। সে মানুষটি কেমন আমি জানিনা। আমি এখন ভাবি, এভাবে পড়িয়ে অতীতের সবগুলো লজিং টিউশনি আপনি কি করে ছেড়ে এসেছেন?
- আর কিছু?
- স্যার। আমি জানি এটি আপনার শেষ বিদায়। তাই আপনাকে নিয়ে আমার ছোট্র একটি প্রশ্ন । আমি দুঃসাহসের সাথেই কথাটা বলে ফেলব আপনাকে। আর আপনি অনুগ্রহ করে আমার উপর রাগ করবেন না। কিংবা মনে কোন কস্ট নেবেন না। স্যার হোন আর ভাই হোন,গত কয়েকটি মাস পড়ার সুবাদে যেহেতু আপনাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে, তাই আমার সে অনুভুতির দু'একটা কথা আপনাকে মন খুলে বলতে চাই।
- বল। সমস্যা নেই। এটি তোমার অধিকার। মানুষ তার মনের কথা খূলে বলতে পারলে খুব হালকা হয়। কষ্টগুলো লাঘব হয়। তাই তোমার মনের সব কথা বলতে পার। তবে - সংক্ষেপে।
স্যার। অতীতে যে সব লজিং কিংবা টিউশনি করেছেন, আমার মত এমন কোন ছাত্রী কি পেয়েছেন, যারা আপনার বিদায়ে কেঁদেছে!
- অনেক কঠিন প্রশ্ন করেছ। সব কথা কি আর খুলে বলা যায়? তবে এটা ঠিক যে, মানুষ মানুষের জন্য। মানুষের মনটা খুব বিপদ জনক। এটিকে কন্ট্রোল করতে না পারলে অকল্পনীয় এক বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়। কখনও কখনও সেখান থেকে ফিরে আসা যায়না।
আচ্ছা, বলত, এত গভীরে গিয়ে প্রশ্নটা করার কারণটা কি?
- স্যার। ভালবাসার নেগেটিভ দিকটা কি, এ নিয়ে আপনার মুখে অনেক বাস্তব কাহিনী শুনেছি। এসব শিক্ষণীয় কথাগুলোতে আমি অনেক অভিভুত হয়েছি। শিখেছি। শুনে খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু একান্ত অজান্তে যদি কারো মন আপনি দখল করে নেন, তাহলে এটাকে তাড়ানোর ওষুধটা কি বলতে পারবেন? গল্পে পড়েছি, "কুইনিন জ্বর সারে বটে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে"?
- বিপু। সত্যি কথা বলতে কি, অতীতে ফেলে আসা সব ছাত্র ছাত্রীই আমাকে বড় ভাইয়ের মত জানত। গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করত। আর এ গভীর শ্রদ্ধার মানুষগুলো থেকে বিদায় নেয়ার দৃশ্যটা কিছুটা ভিন্ন এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
মানুষ এক বিচিত্র রকমের প্রাণী। যার জন্য জীবন উত্সর্গ করে, তাকে আবার পাষণ্ডের মত জবাই করে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনা। মানুসের ভেতরে বাস করা 'মন' নামের বস্তুটি সৃষ্টির এক অকল্পনীয় বিস্ময়! এটিকে জয় করতে পারলে তাকে দিয়ে যে কোন অসাধ্য কাজ সাধন করা যায়। তাই ছাত্র ছাত্রী পড়াতে গেলে আমি সেই কাজটাই আগে করার চেস্টা করি। চিনতে চেস্টা করি তার ভেতরের মানুষটাকে।
জন্মগতভাবে প্রত্যেকটি মানুষই জিনিয়াস। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার অভাবেই জিনিয়াস মানুষটি হিনিয়াস (হিংস্র) হয়ে উঠে। ভোতা হয়ে যায় তার প্রখর মেধাশক্তি। পরিণত হয় জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীতে।
গন্তব্য পৌছার জন্য পথের চারিধারে দেখা সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যদি কেউ দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে সে কখনও গন্তব্য পৌঁছতে পারেনা। এজন্য কোন গন্তব্য যাওয়ার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নাম্বারিং এর দিক থেকে আমার জন্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ।
আচ্ছা বলত দেখি, বিগত কয়েকটি মাস ধরে তোমাকে পড়াচ্ছি। কিন্তু এতদিন ধরে দেখা বিপু যেন আজ অন্য এক বিপু। এর কারণ কি? অবশ্যম তোমার অনুভুতি পুর্ন কথাগুলো শুনে ভাল লাগছে এজন্যই যে, তুমি তোমার ভেতরে জমা কথাগুলো অকপটে বলে দিয়েছো।
একান্ত অজান্তে যদি কারো মন আপনি দখল করে নেন, তাহলে এটাকে তাড়ানোর ওষুধটা কি বলতে পারবেন? এটা বলতে তুমি কি বুঝাতে চেয়েছে? আর সে্ই মনটি কার?
.....আমার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে বিপু কি যেন ভাবছিল। মুখে কোন কথা নেই। একেবারেই নিশ্চুপ। ভাবছিলাম, ও গুছিয়ে কথা বলার জন্য হয়তোবা চুপে চুপে মনের সাথে বুঝাপড়া করছে। তাই জানতে চাইলাম - নীচের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছ?
হঠাৎ আমার দিকে খুব অভিমানী দৃষ্টিতে তাকাতেই অশ্রুসজল চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গাল বেড়ে নিচে পড়ে গেল। ....ভেজা কণ্ঠে "আমি জানিনা স্যার" বলেই দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।
-বিপু.........
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৬ বার পঠিত, ৫১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার বাড়ীর সামনে দিয়া
বন্ধু যা বউ লইয়া...
হাহা। ধন্যবাদ।
তা যাই হোক, ইদানিং সম্ভবত কাজের খুব চাপ যাচ্ছে, তাই খুব দেরিতে পাচ্ছি রঙের মানুষের রঙিন গল্প।
চালিয়ে যান মুই আপনের হিচনে হিচনে আছি।
আসলেই খুব উপভোগ করছি আপনার এই সিরিজটা।
শিক্ষকতায় থাকায় এটি আমার জন্য বাড়তি পাওনা বলা যায়। আমি আপনার মত উৎসাহ দিয়ে পড়াতে না পারলেও চেষ্টা করবো।
আগের গুলো ও বাঙলায় ছিল ইংলিশ বর্ণমালায়। আজ কম্পিউটার থেকে লগইন করায় বাঙলায়।
পর্ব তা হলে চলবে।
লেখাটি বই আকারে বের করার জন্য ব্যবস্থা করুন। কারন আমি এরকম পর্ব পর্ব করে পড়ে মজা পাই না।
লাছা লাগাইয়া গেল কনে?
ধন্যবাদ। কষ্ট পেতে পেতে মন ফাইট্যা কালা হইয়া গেলে আর কস্ট লাগেনা। ধন্যবাদ।
আইনের পেছনে ঘুরতেই যায় দিন--
কখন শোধি বলুন আপনার ঋণ?
বিলম্বে আসি তাই।
কেন পাখি ডাকে
কেন চ্যাকা খায়
তবু প্রেম করে
তবু যে কাদায়।
ধন্যবাদ।
ব্যস্ততার দরুন দেরিতে পড়লাম এপর্বটা! ধন্যবাদ আপনাকে।
তবে এই ধরনের ডাইরেক্ট প্রশ্ন খুবই কাজের সিচুয়েশন কোন্ট্রলে। টেকনিকটি শিখেছিলাম আমার মরহুম পিতার কাছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন