রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-৩০)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ০১ মে, ২০১৪, ১১:৪৩:১৫ রাত
পর্ব-২৯
চাকুরীর ছয় মাসের মাথায় ম্যাচ পরিবর্তন করলাম। চলার পথে পরিচয় হওয়া দুজন অজানা লোক মনের অজান্তেই বন্ধু হয়ে গেল। নাম হেলাল ও কামাল। একজন কুমিল্লাবাসী। অন্যজন নোয়াখালী। এরা দুজনেই ঢাকা থেকে চাকুরী নিয়ে চট্রগ্রাম এসেছে মাত্র। ক্ষণস্থায়ী বাসা ছেড়ে নতুন বাসার সন্ধানে বের হওয়া দুজনের সাথে পথে পরিচয় হয়। কথোপকথনে দারুল মিল খুজে পাওয়ায় আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম। শুরু হল তিন জনের জন্য বাসা খোজার পালা। তিন দিনের মাথায় নতুন বাসাও পেয়ে গেলাম। মাদার্য পাড়া। মসজিদের পেছনে। জানে আলম চৌধুরীর বাড়ী। অনেক পুরোনো আভিজাত্য ফ্যামেলী। বাড়ীর ভেতরেই পড়ে থাকা খালি বাংলাটা ভাড়া দেয়া হবে। বাসাটি চার দেয়াল বেষ্টিত অন্দর মহলে হওয়ায় বাড়ী ওয়ালা অনেক গুলো শর্ত জুড়ে দিলেন।
- বাড়ীর ভেতরে কোন ধরনের আওয়াজ করা যাবেনা।
- কথা বার্তার সীমালঙ্গন অমার্জনীয়।
- রাত দশটার ভেতরে বাসায় ফিরতে হবে।
- বাড়ীর ভেতরের পুকুরে গোসল করা যাবেনা।
- ভাড়া অগ্রীম দিতে হবে।
- পারিপাশ্বিক কোন অভিযোগ আমলে নিয়ে যে কোন সময় বের করে দেয়ার অগ্রীম নোটিশ প্রদান করা হল..ইত্যাদি।
সবদিক থেকে থাকার জন্য বাংলাটি খুবই সুবিধা জনক হওয়ায় রাজী হয়ে গেলাম। বের হয়ে আসার পর তিনজনই মিটিং এ বসলাম। ভাবছিলাম, এতগুলো শর্ত নিয়ে আদৌ কি এ বাড়ীতে থাকা সম্ভব? তিনজনের দির্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানগর্ব আলোচনা পর্যালোচনা শেষে সন্তোষজন সমাধান পেয়ে গেলাম।
বেশী দেরী না করে ঝটপট বাসা পাল্টিয়ে চৌধুরী বাড়ির বাংলায় উুঠে গেলাম। বাড়ীর কর্তা আলম সাহেব খুব গরম লোক। তবে মিশুক। কর্তী চল্লিশোর্ধ হলেও কথা বলার সময় বাম হাতে মাথার আচল টেনে মুখ আড়াল করে কথা বলেন। বড় ছেলের বউ ভেতরেই পর্দার মাঝে থাকে। মেঝ ছেলে বিদেশে থাকে। তৃতীয় নাম্বার বাড়ীতে বেকার। ছোট ছেলেটি হাইস্কুলে পড়ে। বাস।
নতুন বাসা থেকে গোসল করার জন্য পুকুরের দুরুত্ব আধা কিলোমিটার। সকালে পাকশাঁক সেরে তিনজনে পুকুরে গোসল করতে যাই। কিন্তু গোসল সেরে আধা কিলোমিটার পথ হেঁটে বাসায় আসতে ঘেমে যাই। বাসায় পৌছলে গোসল করেছি বলে মনে হতোনা। গামছা দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে পরিহিত জামা কাপড়ে অফিসে যাওয়াটা বড়ই অস্বস্তিকর মনে হত। মানসিকতার দিক থেকে ম্যাচের তিন জনই খোলা মনের ও রসিক টাইপের হওয়ায় এসব সমস্যাকে উপেক্ষা করতাম।। অনেকগুলো শর্ত মেনে এ বাড়ীর বাংলা থাকার কৌশলগুলো প্রয়োগের জন্য পনের দিন অপেক্ষা করতে হল।
এখন কিছুটা পুরোনো হয়ে উঠেছি। আসা যাওয়ার ফাঁকে বাড়ী ওয়ালা ও তার ছেলেদের সাথে যেচে সালাম বিনিময় শুরু করলাম। ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে রাখা বাড়ীওয়ালীকে দেখলেই 'মন ভরে খুব দরদের সাথে খালাম্মা" বলে সম্বোধনের মাত্রাটা তিন জনেই বাড়িযে দিলাম। বাড়ী ওয়ালাকে রাস্তায় পেলেই সালাম দিয়ে জোর করে চা নাস্তা খাওয়ানো, কথা বলা ইতাদি পরিকল্পনা মোতাবেক অনুশীলন শুরু হয়ে গেল। ছোট ছেলেকে একদিন বাংলায় ঢেকে এনে পড়ালিখা সংক্রান্ত অনেকগুলো পরামর্শ দিলাম। বললাম, তোমার যে কোন বিষয়ে সমস্যা হলে আমার কাছে এসো। সমস্যা নেই। খুশীতে আটখানা হয়ে ছেলেটি বিদায় নিল।
আহ! বাকী পনের দিনে তিন জনের পরিকল্পিত অভিনয়ে অন্দরমহলে সাড়া পড়ে গেল। বাংলা থেকে বের হবার সময় এখন সালাম দিলে খালাম্মা ঘোমটা চাড়াই কথা বলতে এগিয়ে আসে। বাড়ী ওয়ালা বাসায় এসে আড্ডা দিয়ে যায়। মেঝো ছেলে সকাল বিকাল আসা যাওয়ার রুটিন হয়ে গেল। সপ্তাহ শেষে বাড়ী থেকে আসার সময় তিনজনই খালাম্মার জন্য আম-জাম আনার পাশাপাশি ছোট নাতনীর জন্য চকলেট আনতে ভূলে যেতাম না। স্বল্প খরচে এসব সামাজিক কাজগুলো তীরের মত কাজ করল। জয় করে নিলাম 'নতুন খালাম্মার ভালবাসার অচীনপুর'।
কিছুদিন পর খালাম্মা উঠোনে যেন কি করছিল। হেলাল সালাম দিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল। বলল,
- খালাম্মা। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল, যদি কিছু মনে না করেন।
- কি বাবা? বল। খালাম্মা খূশী হয়ে জানতে চাইল।
হেলালের সাথে খালাম্মার আলাপচারিতা শুরু হতেই কামাল ও আমি যোগ দিলাম। তিন জনের দরদ ভরা খালাম্মা ডাক যেন আপন খালাকে ডাকাও হার মানায়। খালাম্মার মুখের নির্মল হাসি দেখে বুঝতে বাকী থাকলনা যে, এতক্ষণে খালা কাবু হয়ে গেছে। কপাট বন্ধ ঘরের সব কটা জানালা খুলে গেছে আমাদের জন্য। তারপর আবারও হেলাল বলতে লাগল
- আচ্ছা খালাম্মা। আমরাতো আপনাদের বাংলায় থাকি আজ প্রায় ২০-২৫ দিন হল। আমাদের চলা ফেরায় কি আপনাদের কোন সমস্যা হয়?
- না বাবা। বিনয়ের স্বরে খালাম্মা জবাব দিল।
- আচ্ছা খালা, আমাদের জন্য কি আপনার একটুও মায়া হয়না?
- বিস্মিত চোখে খালা হতচকিত হয়ে জানতে চাইল, কেন বাবা?
দ্যাখেন খালাম্মা, বাড়ীতে গেলে কথা প্রসঙ্গে আমরা তিনজনেই মায়েদের বলি, চট্রগ্রামে যে বাড়ীতে থাকি, এক খালা আছে, একেবারে নিজের খালার মত। খুবই অমায়িক। অন্যরকম। খালাম্মাটা যে এত ভাল মানুষ কল্পনাই করা যায়না!
- খালাম্মা জানতে চায়, বাবা তোমাদের কি সমস্যা আমাকে বল।
এবার কামাল বলতে লাগল,
- খালাম্মা। আমরা এ বাড়ীতে আসার সময় যে সব শর্ত দিয়েছেন, তা আমরা হুবহু মানতে বাধ্য।
- না না। বাবা। তোমরা আমার পুতের মত। তোমাদেরকে যা বুঝার বুজেছি। তোমাদের খালুজানসহ আমার সন্তােনেরা তোমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তোমাদের মত মানুষই হয়না। তোমাদের তিনজনে নামাজ কালাম, চলা ফেরায় এত মিল দেখে আমি আমার ছেলেদের শিখতে বলি।
- আমি বললাম, আহারে খালা। এত কাছের তিনটা পোলা সকালে আদা কিলোমিটার দুরে গোসল করতে গিয়ে কতযে কষ্ট করে। অথচ ঘরের সামনেই খালাম্মা থাকে। আসরা গতকাল বাসায় বলছিলাম, আপনাকে বিষয়টা বলব। আপনি নিশ্চয়ই মানা করবেন না।
হেলাল বলতে লাগল - বিগত একটি মাস আমরা আধা কিলোমিটার দুরে গোসল করতে যাই। সকালে পাকশাক সেরে এতটুকু দুর থেকে গোসল করে এসে ঘেমে যাই। অথচ, আপনার ঘরের পেছনেই পুকুর। আমাদেরকে সকাল বেলায় যদি মাত্র দশটা মিনিট সময় দেয়া যেত। এর ভেতরেই আমরা তিন জনে গোসল সেরে চলে আসবো।
....খালাম্মা আমাদের কথায় খুব অনুতপ্ত হল। মহিলার মনতো। একটু বুঝিয়ে বলতে পারলে তাদের হিমালয় সম অনুভুতি জয় করা যায়। খালাম্মা তাই করল। বলল,
- বাবা, আজ থেকে তোমাদের জন্য আমার দরজা খোলা। তোমারা আমার নিজের সন্তানের মত। আমাদের ঘরে তোমাদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই তোমাদেরকে খুব পছন্দ করে। তোমাদের উপর সব শর্ত আজ থেকে তুলে দিলাম।
কামাল হেলালকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল, দেখছিস। তোকে বলছিলামনা। খালাম্মা অন্য রকম মানুষ। কথায় আছেনা,
'মার বোন খালা, মার তুন ভালা'...।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৪ বার পঠিত, ৬১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ভালো লাগতেছে চালিয়েই যান
এই তাবিজের গুনতো অনেক.।
(১) তিন জনের পরিকল্পিত অভিনয়ে
(২) স্বল্প খরচে এসব সামাজিক কাজগুলো তীরের মত কাজ করল
(৩) মহিলার মনতো। একটু বুঝিয়ে বলতে পারলে তাদের হিমালয় সম অনুভুতি জয় করা যায়।
(৪) খালাম্মা অন্য রকম মানুষ। কথায় আছেনা, 'মার বোন খালা, মার তুন ভালা'... সরাসরি অন-দ্য-স্পট পাম্পিং
পর্ব গুলর জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
আসলেই কামাল কে নিয়ে আপনারা বাকী দু’জন মিলে কামাল কিয়া ভাই!
০ চৌধুরী সাহেবের তো কোন মেয়ে ছিল না ? ভাড়াটিয়াদের জন্য এত কাহিনী বানানোর কি কারণ থাকতে পারে ?
আপনি না হলেও গ্যাঞ্জামখান সমস্যা করতো। ধন্যবাদ দুজনকে।
অনেকদিন হলতো, চর্চা না থাকার কারণে অনেক মাখরাজের ব্যবহার ভূলে যেতে বসেছি।
বাড়ীওলা শর্তগুলো কেন দিয়েছিলেন তা বুঝতে পারছিনা?
পটাতে উস্তাদ তিনজন। মা' থেকে মাসির দরদ বেশী,এই প্রবাদের কি করবেন।
দেরী হয়ে গেল। আরো আগে পড়া প্রয়োজন ছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন