রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২৮)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৫ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:৫৮:৩৭ রাত
পর্ব-২৭
আদি যুগের মেট্রিক পাশ সোলায়মান সাহেব একেবারেই নিশ্চুপ। ম্যানেজারের বিদায়ে মুখে কোন ভাষা নেই। শিক্ষাগত প্রতিযোগীতার দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় নিজ প্রমোশনের দু:স্বপ্নটা মনে মনেই পোষতেন। তাকে অফিসের সবাই বিবিসি সোলায়মান নামেই চেনে। ব্যাংকে কোথায় কি হচ্ছে, কার সাথে কার ভাব, তলে তলে কে কার সাথে প্রেম করে এসব তথ্য উপাত্ত নিয়েই তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত। সংসারের ভারে নুইয়ে পড়া সোলায়মান সাহেব এসবের মাঝে তৃপ্তি খুঁজে পান।
ব্যাংকে যোগ দেয়ার কয়েকদিন পরের ঘটনা। এক বিকেলে আমাকে ডেকে নিয়ে সামনে বসালেন। খুব মুখ রোচক গল্পের মতই আন্তরিকতার সাথে শুনিয়ে দিলেন ক্যাশিয়ার আলী সাহেব আর উষা দেবীর না জানা প্রেমের অনবদ্য কাহিনী। রোমাঞ্চ, থ্রিলিং সম্বলিত এসব ঘটনা শুনতে কিযে ভাল লাগে! তাও বিয়ের আগে! এসব বলতে বলতে দোকান থেকে দু'কাপ চা এনে আপ্যায়ন করালেন। তারপরও গল্পের শেষ নেই। অবশেষে অসমাপ্ত রেখেই ছুটি শেষে বিদায় নিলাম। কয়েক পর্বে শেষ হল এ প্রেম কাহীনি।
এ অফিসে বয়োজ্যোষ্ঠ সোলায়মান সাহেব অনেক পুরোনো। উষা দেবীর সাথে তার ভাব ভাল নয়। এটি তিনি নিজেই তৈরী করেছেন। কিছু কিছু পুরুষ আছে, যারা অতি প্রেমিক। কিন্তু প্রেমের কথা কাউকে নিবেদন করতে রাজী নয়। এদের ভাবটা লাজুক প্রকৃতির হলেও নারীদের সাথে কথা বলার চাইতে সমালোচনায় খুব মজা পান।
এ অফিসে ট্রান্সফার হয়ে এসেই বিবাহিত আলী সাহেব অল্প সময়ে উষা দেবীর সাথে প্রেমে এতটুকু জড়িয়ে পড়বে কেউ ভাবতেই পারেনি। আর ঘটনাটা ধরা পড়ে যাবার পর পুরোনোদের মাঝে ক্ষোভ - শালার, আমরা এতদিন পাশে থেকে.....। এত কিছুর পরও উষা-আলী নির্লজ্জের মতই কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ ভালবাসার ত্যাগে নাকি লজ্ঝা শরম এমনিতেই উঠে যায়। লজ্জার চেয়ে প্রেমের গুরুত্বটা বেশী বলেই হয়তবা এমন মনে হয়।
এ অফিসে আর এক রসিক মানুষ কাশেম সাহেব। আশে পাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেই তার আনন্দ। অফিসার পদে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে এ অফিসে যোগ দিয়েছেন এক বছর হল। তার জীবনে দুঃখ একটাই, জীবনে যে গোল খেয়েছি, তা আমার সব শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু হজম করার ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ, আমি বন্দী কারাগারে, আছিগো মা বিপদে।
পিতৃহীন দরিদ্র পরিবারে মায়ের একমাত্র সন্তান কাশেম সাহেব। মেথম্যাটিকস এ মাষ্টার্স পাশ করার সবুটুকুন অবদান মায়ের। একজন মা সন্তানের জন্য যে কি করতে পারেন তা কাশেম সাহেব হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন। মায়ের সে সব দুঃসহ কষ্টগুলোর কথা স্মরণ করে কাশেম সাহেব সব ক্ষোভ বার বার গলধঃকরণ করে ফেলেন। শত হলেও মা। নালিশ কার বিরুদ্ধে দেবে?
পড়ালিখা শেষ। নতুন চাকুরীতে যোগদান। আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে মায়ের অবদানের কথা স্মরণ করে কাশেম সাহেব ভাবতে শুরু করলেন, মাকে কিভাবে খুশী করা যায়। সন্তানের চাকুরী প্রাপ্তিতে মা খুশীতে আটখানা। সব মায়ের মতই ছেলের বউ ঘরে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন কাশেম সাহেবের মা। যেখানেই যান, সবার একটিই প্রশ্ন -
- কিগো বুবু। কাশেম কে বিয়ে দিবানা? সবই তো হল। ছেলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। কখন না কখন মরে যাও। মরার আগে অন্তত ছেলের বউটাকে দেখে যা্ও। না হয় আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবে?
- ছেলের বউ দেখার আকুতি মায়ের মুখে শুনতেই কাশেম সাহেব মুচকী হেসে দিলেন। ভাবলেন, মাতো আমার জন্য অনেক করলেন। এবার মাকে খুশি করি।
- মা। তুমিত জীবনে আমার জন্য অনেক কিছু করলে। তাই আমার বউ দেখার দায়ীত্বটা তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। তোমার পছন্দমত বউ দেখ। তুমি যাকে পছন্দ কর তাকেই বিয়ে করবো।
কাশেম সাহেবের কথায় বৃদ্ধ মা খুব খূশী হলেন। উঠে পড়ে লেগে গেলেন ছেলের বউ দেখার জন্য। মেয়ে খুঁজে নিতে বেশীদিন সময় লাগেনি। কোন এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাশেম সাহেবের মা মেয়েও দেখে আসলেন। প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মায়ের পছন্দের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কাশেন সাহেব মেয়ে না দেখেই রাজী হয়ে গেলেন। ভাবলেন, যে সন্তানের জন্য মা সবকিছু উজাড় করে দিতে পারে, সে মা কি আমার জন্য খারাপ বউ পছন্দ করবে?
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হল। নিদিষ্ট দিনে কাশেম সাহেবের বিয়েও হয়ে গেল। শ্বশুর বাড়ীতে কলেমা পড়ানোর পর মিষ্টি মুখ করানোর জন্য নতুন জামাই বউকে পাশাপাশি বসানো হলো। মুখে রুমাল গুজে কাশেম সাহেব বসে আছেন। পাশে বসা স্ত্রীর লম্বা ঘোমটার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাজানো চেহারাটা দেখার জন্য আড় চোখে সামনে রাখা আয়নায় বার বার দেখছেন। না। চোখে পড়েনা।
অবশেষে দেখলেন ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিলনা। নব বধুর চেহারায় তিনি বিস্মিত নয়, একেবারে বাকহীন। মনে মনে ভাবছেন
দেখার কথা কি দেখছি
ভাবার কথা কি ভাবছি
গোমটা ভেতর বউটা আমার
ঘরে নিয়েই বা লাভকী......?
নতুন বউ নিয়ে আপন ঘরের ফেরার সময় আরও একবার ভাল করে দেখল নবাগত স্ত্রীকে। না। বিশ্বাস হলনা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বিয়ের গাড়ীটি বাড়ীতে ঢুকতেই কাশেম সাহেব নেমে গেলেন। বাড়ীতে অনেক বড় আয়োজন। শত মানুষের আনা গোনা। আপ্যায়ন নিয়ে ব্যস্ততম মানুষদের সোরগোল যেন বাজারে পরিণত হয়েছে। কাশেম সাহেব কোন কথা না বলে সোজা ঘরে ঢুকলেন। অপেক্ষমান মা কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই মাথা থেকে বিয়ের পাগড়িটা ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন।
রসিক কাশেমের মেজাজ আজ বড় খারাপ দেখে চাচী, চাচা, খালা সবাই দৌড়ে আসল। সবাই কারণ জিজ্ঞেস করছে। কাশেম সাহেব নিশ্চুপ! কোন এক অজানা কারণে কাশেম সাহেব বিয়েতে ক্ষুব্ধ, এটি এক কান দুকান করে সবার কানে চলে গেল। অনেকেই যেঁচেই বলাবলি শুরু করল
- হ। রাগ করবেনা? শিক্ষিত ছেলে। মাস্টার্স পাশ। ব্যাংকের অফিসার। তারপরও ছেলেটাকে একটু সম্মান করা হলোনা শ্বশুর বাড়ীর পক্ষ থেকে। মানুষের কি কান্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই! খাট পালং ফার্নিচার এসব দেয়ার জন্য বলতে হয় নাকি?
বিয়ের আগেই কাশেম সাহেব এসব না দেয়ার জন্য বলে দিয়েছেন। বিয়ের বাড়ীর আত্মীয়দের মুখে এসব গুঞ্জন শুনে কাশেম সাহেব বিপাকে পড়ে গেলেন। ভাবলেন, এভাবে চলতে থাকলে মান ইজ্জত সবই যাবে। তাই ৎ দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। সবাইকে বললেন, না আমি অন্য কারণে রাগ করেছি। থাক। আপনারা এসব নিয়ে কথা বলতে হবেনা। পরে দেখবো।
বিয়ের কয়েকদিন পরের ঘটনা। আজ নতুন স্ত্রী বাসায় নেই। বাবার বাড়ীতে বেড়াতে নাইয়্যুর গিয়েছে। মা ছেলে একান্ত আলাপে বসেছে। সুযোগ বুঝেই মাকে কাশেম সাহেব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
- মাগো। তোমার কাছ থেকে একটা বিষয় আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে। মনে কিছু নেবেনা তো?
- বল বাবা - মা অকপটে উত্তর দিল।
- আচ্ছা বলত। বিয়ের আগে ছেলের বউটা কি খূব ভাল করে দেখেছিলে? আমিতো তোমার পছন্দমত বিয়ে করব বলেছি। তাই তোমাকে কিছু বলার নেই। কিন্তু একটা মেয়ে এতটুকু অসুন্দর, তা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
- ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। গায়ের আচলে চোখের পানি মুচতে মুচতে বলতে লাগলেন,
- বাবারে, তোর জীবনে এতবড় ক্ষতি হবে আমি ভাবতেই পারিনি। আমি মা হয়ে ছেলের এত বড় ক্ষতিটা ক্যামনে করে ফেললাম..মায়ের বুকফাঁটা চাপা আর্তনাতে কাশেম সাহেব কিংকর্তব্যমিমুঢ়। .....আমাকে তো তারা এই বউ দেখায় নাই। আমাকে বউয়ের ছোট বোনটা দেখিয়েছিল। আর বিয়ের সময় এটাকে দিয়ে দিল! এ ক্যামনে হয়। বিয়ের দিন বউটা দেখেই আমি শান্তিতে নেইরে বাবা .....। যে ছেলের জন্য এতকিছু করলাম, সে ছেলের জীবনটা এমনভাবে নস্ট করে দেবো, একি হয়? আমার এম এ পাশ ছেলেটাকে ক্যামনে একটা পেত্নি বিয়ে করালাম। এখন আমি ওদেরকে বললে যদি অস্বীকার করে..... কি কি করবো। ক্যামনে বুঝাবো যে আমার সাথে ওরা বেঈমানী করেছেরে বাবা.....।
মায়ের অসম্মান হবে জেনে কাশেম সাহেব আর কোন ঝামেলায় যাননি। জীবনের সব স্বপ্ন মাড়িয়ে দেয়া বিয়ের এ অবিশ্বাস্য কাহীনি মা-ছেলের মাঝে ইতিহাস হয়ে থাকল। কিন্তু অমার্জনীয় বেদনাটি একদিনের জন্যও ভুলে থাকতে পারেননি কাশেম সাহেব। তাকে আজও এর যাতনা তাড়িয়ে বেড়ায়।
........খুব কস্টের কথাগুলো শেষ করে কাশেম সাহেব বলতে লাগলেন,
- মজুমদার সাহেব। মায়ের পছন্দমত বিয়ে করার বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। তাই জীবনে কখনও কারও পছন্দ অপছন্দমত বিয়ে করবেন না প্লীজ। আবেগের বশবর্তী হয়ে জীবনে অনেক কিছু করলেও এটি আবেগ দিয়ে হয়না। এর গ্লানি বড়ই মারাত্মক। এসব কারণে অন্তরাত্মার সাথে যে দুরত্ব তৈরী হয়, তা বড়ই অসহনীয়।
মানুষের জীবনে বিয়ের মত গুরুত্বপুর্ন আর কোন অধ্যয় নেই। এটিকে যারা গুরুত্ব দেয়না, প্রেমের মুল্যায়ন করতে গিয়ে আটকা পড়ে যায় কোন ললনার বিছানো পাতানো জালে, খেয়ালের বশবর্তী হয়ে বসে যায় বিয়ের সিঁড়িতে, এদের পুরো জীবনটাই যেন একটা জাহান্নাম। সে জাহান্নামের বাসিন্দা না হলে বুঝতে পারবেন না এর প্রখরতা কত নির্মম! আর সেই না দেখা জাহান্নামের মাঝে বাস করা আমি কাশেম বড্ড অশান্তিতে আছি। সারাদিন হাসি তামাশার মাঝে মেতে থাকা আমি কাশেমের ভেতরের বাকহীন মানুষটার বাহ্যিক এসব কেবলী মিছে অভিনয় মাত্র...।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
৩০৯৯ বার পঠিত, ৬৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
উত্তরে বলল, কেন বলব? তাকে সমুচিত জবাব দিয়েছি। শিক্ষা হওয়ার জন্য।
মানে?
মানে হল। আমার বিয়ের জন্য সে আমাকে তোমার ব্যাপারে আগে বলেনি কেন.......
উপদেশ ও শিক্ষায় পূর্ন এ পর্বটা।
এদিক থেকে আমি বেচে গেছি। মায়ের ভাইয়ের মেয়েকেই....... অতএব বড়টা দেখিয়ে নাকি ছোটটি দেখিয়ে বড়টি দেয়ার কোনো চান্স ছিল না। তাছাড়া মায়ের ভাইজি বলে কথা!!!
না না , এটা হতে পারে না। ছেলেপেলেদের হাদিয়া দেয়ার অভ্যাস প্রায় বিলুপ্তির পথে @ হ্যারি
ভাই ছোট্ট হলে বড় আপুদের কাছথেকেইতো হাদিয়া নেয়। আর অপেক্ষায় থাকে, কবে যে বড় আপুরা বেড়ায়তে আসবে, আমার জন্য গিফ্ট আনবে বড় আপুদেরকে নাকি ছোট্ট ভাইদের পছন্দের ব্যাপারে কিছু জানাতে হয় না। বোনেরা নাকি নিজ গুণে বুঝে ফেলে, কি দিলে খুশি হবে।
রিয়েল লাইফেতো কোন বড় আপু নেই, তাই কোন গিফ্ট্ ও নাই আপনাকে কিন্তু সহজে ছাড়ছি না। নদী ভ্রমনে নাহয় পার পেয়েগেছেন, এখানে নো পারাপার
কারণ?
কারণ আমার বাবা যে আমার মাকে বিয়ে করেছে, এটা কি একটা পছন্দ হল? আমার মা এত কাল......।
তাহলেতো কালো মেয়েদের বিয়ে না হওয়ার কোন চান্স নাই।
সেই মুহূর্তে এমন খারাপ লাগাটা দোষের নয় কিন্তু এখনও মেনে নিতে না পারাটা দোষের।
আমি একটা হাদীসে পড়ছিলামঃ-
এক মহিলা গিয়ে আল্লাহ'র রাসুলের কাছে অভিযোগ করলো, "তার স্বামীটা (তুলনামুলকভাবে) দেখতে খাটো, কুৎসিত। ঐস্বামীর সাথে থাকলে হয়তো অন্যায় পথে পা বাড়াতে বাধ্য করতে পারে তাকে।" তখন আল্লাহর রাসুল ঐলোকটাকে ডেকে বল্লেন, ঐমহিলাটাকে তালাক দিতে।
[হাদিসটি ভুল হয়ে থাকলে আল্লাহ আমাকে যেন ক্ষমা করেদেন]
তাহলে বুঝাগেলো, বিয়ের পরে আকর্ষন হারানোটাও দোষের নয়। মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত কিসিমের!
আর এটাও বুঝলাম- কেউ যদি অন্যজনের প্রতি আকর্ষন হারায় যার কারনে ভুল পথে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই উত্তম।
রঙ্গের মানুষ???????
মন্তব্য করতে লগইন করুন