রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২৭)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৩ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:৫১:৪১ রাত
পর্ব-২৭
ম্যানেজার সাহেবের বিদায়ের দিন আজ। অফিসে ফেয়ার ওয়েলের আয়োজন চলছে। এ নিয়ে সবাই ব্যাস্ত। ষ্টাফদের অনুদানে এ আয়োজনে সবাই কাজ করছে। কি পেলাম, না পেলাম, তার হিসেব মিলানোর চাইতে স্যার চলে যাচ্ছে এটাই বড়। কিন্তু এত আয়োজনের মাঝেও রবি্ ও সেকান্দর সাহেবের মনটা বেশী ভাল নেই। কারণ একটি পদের জন্য তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পর্কের মানুষটির আজ বিদায়। সব আশা ভরসা ভেস্তে গেল। স্যার বিদায় নেয়ার পর প্রমোশনের বিষয়টা আগের মত ফলোআপ করা যাবেনা। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা সিরিয়াসলি কাজ করছে। তবু্ও শেষ ভাল যার, সব ভাল তার, এ আশায় দুজনই স্যারের বিদায় অনুষ্ঠানটা আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এত ব্যাস্ততার মাঝেও রবি সাহেব আমাকে এক কোনায় ডেকে নিয়ে বললেন, মজুমদার সাহেব। দোয়া করবেন। আশা করছি প্রমোশনটা এবারে হয়েই যাবে। স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে আশ্বস্ত করেছে। বলেছে চিন্তা করবেন না। আমি আপনার নাম হেড অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। দেখা যাক শেষ রেজাল্ট টা কি হয়।
রবি সাহেবের মুখে শোনা ম্যানেজারের মিছে আশ্বাসে মনে মনে হাসলাম। বিদায়ের এ অবেলায় স্যারের ডাবল ষ্টান্ডার্ড কর্মনীতি টা দেখে খুব খারাপ লাগল। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি জেনে ও না জানার ভান করে সায় দিলাম।
খাওয়া দাওয়া শেষে স্যার শেষ কথা দিয়ে ইতি টানলেন। অতীত স্মৃতিকে টেনে এনে আবেগ ঘন কথা বললেন। সবার প্রতি সহানুভুতি জানালেন। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানালেন। এ শাখার কর্মচারীদের মুগ্ধ করা ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংয়সা করলেন।
স্যার বিদায় নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেলেন। সবাই স্যারকে বিদায় দেয়ার জন্য ব্যাংকের দরজা পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু রবি সাহেব আর সেকান্দর সাহেব গেলেন স্যারের বাসায় পর্যন্ত। বুকভরা আশা- কোন সুযোগে স্যারের মুখে যদি প্রমোশনের কথাটি আর একবার শুনেত পারতাম। ইস। কিযে ভাল লাগত। বিশ্বাস, স্যার নিশ্চয়ই কিছু একটা বলবেন।
পরদিন নতুন ম্যানেজার অফিসে যোগ দিলেন। বয়সে পুরোনো ম্যানেজার থেকে ও কম। সবাই আগত ম্যানেজারের সাথে নতুন করে পরিচয় পর্ব শুরু করলেন। এখানে তলে তলে কি হয় জানা না থাকলেও আনাগোনা আর অতিভক্তিতে মনে হল, নুতন আঙ্গিকে তেলের সিসির ব্যবহার শূরু হয়েছে। আশায় বুক বেধে থাকা মানুষগুলো এখনও প্রহর গুণছে সেই প্রতীক্ষিত পদটির জন্য।
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। এক পড়ন্ত বিকেলে অফিসের কাজ সেরে সেকান্দর সাহেব আমার সাথে বসলেন। আজ মনটা খুব খারাপ। একেবারেই ভারাক্রান্ত। হতাশায় নুইয়ে পড়া একজন মানুষের মতই যেন চেহারায় ভেসে উঠেছে ভেতরের আহত মনের অভিব্যক্তি। চোখে মুখে অনেক ক্ষোভ। এতটুকু ক্ষোভ নিয়ে কথা বলতে তাকে আর কখনও দেখা যায়নি। প্রসঙ্গটা ছিল বিদায়ী ম্যানেজারকে নিয়ে।
- মজুমদার সাহেব। আজ দুদিন হল, আমার মনটা ভীষণ খারাপ। অসহ্যনীয় এক পরিস্থিতির শিকার আমি। বিষয়টা শেয়ার করার জন্য ছূটে বেড়াচ্ছি। আপনার সাথে এ বিষয়ে শেয়ার করে হালকা হওয়ার কথা অনেকবার ভাবলেও বলার মত মুড ছিলনা । আজ ভাবছি,ম বলেই ফেলি।
আপনি নিজেই দেখেছেন যে, বিদায়ী ম্যানেজারের জন্য আমি কি না করেছি। তার বাসায় চাল ডাল, তরি তরকারী হতে শুরু করে সব কিছুই আমি আমি সরবরাহ করেছি। এমনকি তার স্ত্রীর পেটিকোট ও সেলাই করে দিয়েছি। ভাবতাম, স্যার আমাকে খুব পছন্দ করে। থাক। নিজের আত্মীয় হলেও তো করতে হতো। দ্বিতীয়ত, বয়স হয়েছে। প্রমোশনটা বড়ই জরুরী। অন্য শাখায় বদলী হয়ে গেলে আবার নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া, অবস্থান তৈরী করা বড়ই মুশকীল। তাই দু দুবার আমার বদলী হওয়ার আদেশ ও বাতিল করেছি। আমার শতভাগ বিশ্বাস ছিল যে, স্যার আমাকে প্রমোশনটা অবশ্যই দেবেন। পারিবারিকভাবে স্যারের সাথে এতটুক মিশে গেছি যে, তা বলার মত নয়। অথচ স্যার বিদায়ের পর নতুন ম্যানেজারের কাছে আমার বিরুদ্ধে যা বলে গেল, আমি রীতিমত হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে তাকে জুতা দিয়ে পেটাই করি।
- কি বলেন? স্যার কি বলেছে?
- মাথাটা নীচু করে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর আড়ষ্ট কন্ঠে সেকান্দর সাহেব বললেন, শালার ব্যাটা বলে, আমি নাকি আস্ত একটা পাগল!
সেকান্দরের চোখে পানি টলমল করছে। দেখে খুব খারাপ লাগল। অভয় দিয়ে শান্ত্বনা দিলাম। বললাম, সেকান্দর সাহেব, যে সব ম্যানেজার তার কর্মচারী থেকে উপঢৌকন খেতে অভ্যস্ত, এদের ভেতরের মানুষটি বড়ই খারাপ। কারণ, নৈতিকভাবে পদস্খলিত ব্যাক্তিরাই এমন কাজ করতে পারে। আমি নিশ্চিত যে আপনি বা রবি সাহেব কারো প্রমোশনই হবেনা। স্যারের কথাবার্তায় আমার কাছে কেন জানি সব সময় এমনই মনে হত। তারপরও আপনারা অনেক সিনিয়র মানুষ। আমার চেয়ে অবশ্যই বেশী বুঝেন। তাই কিছু বলিনি।
- মজুমদার সাহেব। ব্যাংকের কর্মচারী ইউনিয়ন আমরা স্বাদে করিনা। এসব ইউনিয়ন যদি না থাকত, তাহলে ব্যাংকের পিয়ন থেকে শুরু করে অফিসার পর্যন্ত সবাইকে এরা বাসার কর্মচারী বানিয়ে ছাড়তো। যাক। আমার প্রমোশনের সব আশা ভরসা ভেস্তে গেল। শেষ ফলাফলটা দেখি। তারপর আমি ওকে দেখে ছাড়ব...।
পরদিন ইসলাম সাহেবের সাথে সেকান্দরের বিষয়টা শেয়ার করলাম। ইশারা ইঙ্গিতে ম্যানেজারের না জানা অভিমতটাও তুলে ধরলাম। ইসলাম সাহেব মুচকী হাসলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর বলতে লাগলেন
- মজুমদার সাহেব। যোগ্য এবং সৎ লোকদের সাথে এদের পার্থক্য এখানেই। এত তেল মেরে শেষ উপাধি হল "পাগল"। তাও এ উপাধিটা রেখে গেল আগত ম্যানেজারের কাছে। তার মানে এ ম্যানেজারের কাছে সেকান্দর সাহেবের মান ইজ্জতের কিছুই আর রইলনা। কারণ কোন ষ্টাফ সম্পর্কে একজন বিদায়ী ম্যানেজারের রেখে যাওয়া কমেন্ট বড়ই গুরুত্বপুর্ন। জানিনা, সেকান্দর সাহেব আর কত ড্রাম তেল মালিশ করলে নতুন ম্যানেজারের মনটা পুর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। ভাববে, সেকান্দর আসলে তাই নয় যাহা বিদায়ী ম্যানেজার বলে গেছে।
ইসলাম সাহেবের মতে, যেসব লোক বর্তমানে ব্যাংকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, বিভিন্ন শাখায় ম্যানেজার হয়ে বসে আছে এদের মাঝে ৯৯ পার্সেন্ট এ পদের জন্য অযোগ্য।
- কেন? জানতে চাইলাম।
- কারণ, ম্যানেজার মানেই যিনি ম্যানেজ করেন। আর যিনি ম্যানেজ করেণ, তিনিই নেতা বা লীডার। লীডারের ব্যাসিক কিছু কোয়ালিটি থাকতে হয় বলেই সে লীডার। যাদের মাঝে এটি নেই, তারা যে কোন ভাবে ঐ অবস্থানে বসলেও নেতা হবার যোগ্যতা পুরোপুরি এদের মাঝে নেই, এটা নিরেট সত্য।
- সে গুণগুলো কী?
একজন নেতার প্রথম এবং প্রধান গুণ্ই হল -সততা। এটি না থাকলে অন্য গুণগুলো থেকেও লাভ নেই। আর আমাদের মানেজারদের মাঝে এটি নেই বলেই ব্যাংকে এত সমস্যা। সারা পৃথিবীতে সৎ নেতৃত্ব থাকলে কোন সমস্যা থাকতোনা। আর এ গুণটির অভাবের কারনেই এত অশান্তি আর অব্যবস্থাপনা।
স্বল্পভাষী তাত্বিক কথার লোক ইসলাম সাহেব বাস্তব জীবনে সৎজীবন অনুশীলনে অভ্যস্ত বলেই সমাজে এদের কদর নেই।
(চলবে্)
বিষয়: বিবিধ
১৪৯২ বার পঠিত, ৪৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে ধন্যবাদ দেবোনা আপনার জন্য আন্তরিক দোয়া আল্লাহ আপনার লেখার মেধাকে আরো বৃদ্ধি করে দিন এবং ধর্মের কাজে লাগান। আমিন।
আর নির্লজ্জ্ব বিদায়ী ম্যানেজার এর মত পশুর জন্য করুণা হচ্ছে। আজকের সমাজে এসব বিবেক ও চক্ষুলজ্জাহীনদের দাপট সর্বত্র।
আগের পর্বগুলো পড়া হয়নি সুযোগ পেলে পড়বো ।
চট্টগ্রাম শহরেই আমার কর্মস্থল। ফেবুতে আপনার প্রোফাইলে একটি প্রাইভেট ভারসিটির ইনফরমেশন দেখলাম।
এটাই আজকের পোস্টের সারমর্ম বলা যায়। এর অভাবেই বাংলাদেশের আজ কি অবস্থা।
আপনি ঠিকই বলেছেন। তৎ লোকের মেলা যে অফিন আদালতে প্রশাসনে কবে হবে দেখার খুব ইচ্ছে
সেকান্দর সাহেবের বারোটা যে বাঁজিয়ে দিলেন। নিশ্চয়ই তিনি হয়তো অবসরে অাছেন। অার যদি কোন অবস্হায় অাজকের পর্বটা নজরে পরে তখন যে তিনি কি করবেন তা অাল্লাহই ভাল জানেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন