রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২৬)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২১ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:৪৯:৩৪ বিকাল
পর্ব-২৫
এ অফিস হতে ম্যানেজার সাহেবের বিদায়ের প্রস্তুতি চলছে। যাবার আগে প্রমোশনের শেষ অনুমোদনের গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। অপেক্ষমানদের ভাবনা, জানি স্যার কি করে! মনে মনে প্রমাদ গুনে নিজেই আবার আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলে। না। স্যার নিশ্চয়ই আমাকে প্রমোশনটা এবার দিয়েই যাবে। স্যার অন্তত এতটুকু বেঈমানী করবে বলে মনে হয়না।
যাবার আগে স্যারের প্রতি অফিসার পদপ্রাথীদের শ্রদ্ধাবোধের মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছে। অফিস শেষে মিছে বাহানায় স্যারের বাসায় যাবার হিড়িকটাও লক্ষ্যণীয়। বিপুকে পড়াতে গেলে প্রায়ই কোন না কোন অফিসার পদপ্রার্থীর সাথে স্যারের বাসায় দেখা হয়। আমাকে দেখে খুব কাছের মানুষের মতই পাশে বসিয়ে দুটো কথা বলতে চায়। সাফাই গাইতে গাইতে খুব গুরুত্বের সাথে কানে কানে বলে,
- মজুমদার সাহেব, আমি যে এসেছি, অফিসে যাতে কেউ না জানে। জানেনতো। আপনার ভাবীকে স্যারের স্ত্রী খুব পছন্দ করে। প্রায়ই বলে ঘুরে যেতে। তাই আসলাম।
- আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বিদায় নেই। চলে যাই অন্দর মহলে বিপুকে পড়াতে।
পড়ার টেবিলে বসতেই মিষ্টি, আম সহ আরো হরেক রকম নাস্তা। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই বিপু মুচকী হাসি মুখে উত্তর দেয়, স্যার, বাবার অফিস থেকে আসা লোকটা এগুলো এনেছে।
- বাহ! অফিসের ম্যানেজার হলে দারুণ মজা। ষ্টাফদের শ্রদ্ধাবোধটা দেখে খুব ভাল লাগে। স্যারকে অফিসের লোকেরা অনেক পছন্দ করে। আসলেযে প্রমোশনের জন্য এসব উপঢৌকন তেলে মারারই নামান্তর তা বিপুকে বুঝতে দেইনা।
এসব তেল মারার উপকরণের মধ্যে রয়েছে স্যারের স্ত্রীর জন্য কাপড় উপহার, মেয়ের জন্য জামা ইত্যাদি। বাড়তি হিসেবে অনেককে আবার মুরগীর গোস্ত পাকিয়েও নিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে।
স্যারের বাসায় এসব উপহার দেয়ার সময় খুব বিনয়ীভাবেই হাস্যোজ্জল মুখে বলেন, স্যার, আমার মা গ্রামের বাড়ী থেকে এসব পাঠিয়েছেন। মা মুরগী পালতে কুব পছন্দ করেন। মাঝে মধ্যে নাতি-পুতিতের জন্য শহরে পাঠায়। এবারেও তাই হয়েছে। ভাবলাম, তিনটা যেহেতু পাঠিয়েছে, একটা পাকিয়ে স্যারের বাসায় দিয়ে আসি। আপনি এসব খুব পছন্দ করেন তো, তাই...। স্যারের বাসায় আসার সময় নিজের স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আসেন। সাথে ফ্যামেলী থাকলে অন্দর মহলের খবরটা একটু বেশী নেয়া যায়। স্যারের স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটা আরও গভীর করা যায়। বাড়তি উপঢৌকন থাকায় স্বাভাবিকভাবেই আতিথেয়তার পরিমানটাও একটু বেশী হয়। সাথে নিয়ে আসা মুরগীর তরকারী দিয়ে জোর করে ভাত খাইয়ে বিদায় দেয়। যেতে যেতে গর্ব করেই বলে, দ্যাখেছ। স্যার আমাকে খুব আদর করে। আমার সাথে স্যারের সম্পর্কটা অন্যরকম। আশা করি এবারে প্রমোশনটা আমাকে দিযেই দেবে ইনশাল্লাহ!!!!!
স্যারের বাসায় গোপনে আসা যাওয়ার সবকিছুই আমি জানি। তাই অবসার সময় রবি সাহেব আর সেকান্দর সাহেব একান্ত অবসরে অফিসে আমার সাথে শেয়ার করেন। বলেন,
- ঐ যে সেদিন স্যারের বাসায় আমাকে দেখেছিলেন। রাত একটায় বাসায় ফিরেছি। স্যারতো খাওয়া ছাড়া আমাকে ছাড়তেই রাজী নয়। কি আর করি। অবশেষে খেয়েই আসলাম।
অফিস থেকে স্যারের বাসায় কে কি নিয়ে আসলো এসব খবর সুযোগ পেলেই বিপু আমাকে ব্রিফিং করে। আমিও না জানার ভান করে জেনে নেই।
স্যারের বাসায় যাতায়াতের দিক থেকে রবি সাহেব আর সেকান্দর সাহেবের প্রতিযোগীতাটা লক্ষ্যণীয়। ক্যাশিয়ার আহমদুল্লাহ সাহেব কিছুটা চাপা স্বভাবের। তাছাড়া, এসব তেল মারার অভিনয় তাকে দিয়ে হয়না। অফিসের সোলায়মান সাহেব সেকেলের মেট্রিক পাশ। পঞ্চাশোর্ধ। সারাদিন ব্যালেন্স মিলানো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ ছাড়া আর অন্য কোন কাজ তাকে দিয়ে হয়ও না। সেও অফিসার পদপ্রার্থী। তবে মনে মনে। তার দৌড় স্যারের অফিস পর্যন্ত। বাস। যোগ্যতার দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় ওর আনাগোনাটা অনেকটা কম।
আর দশদিন বাকী আছে। স্যার এ শাখা হতে বিদায় নেবেন। সকাল দশটা। স্যার আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়েছেন। ঢুকতেই চেম্বারের দরজাটা বন্ধ করতে বললেন। প্রথমেই এ শাখা হতে চলে যাবার বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। বললেন, বিপুকে নিজের বোনের মত করে আর একটু সহযোগীতা করুণ। বদলী হয়ে গেলেও যে কোন সহযোগীতায় সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুুতি দিলেন। বললেন, আপনি আমার মেয়েটাকে যেভাবে আগ্রহ নিয়ে পড়াচ্ছেন এবং তার মাঝে উত্তরোত্তর যে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আলাপ চারিতার ফাঁকেই ড্রয়ার থেকে নিয়ে একটি ফরম আমার সামনে এগিয়ে দিলেন। বললেন, খবরদার! এ নিয়ে কারো সাথে ক্ষুর্নাক্ষরেও আলাপ করবেন না। খুবই গোপনীয়। আপনার হাতের লিখা সুন্দর। তাই ভাবলাম, আপনাকে দিয়েই এটি পুরণ করে নেই।
ফরমটির উপরে লিখা আছে, অফিসার পদে পদোন্নতির আবেদন। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন, আপনার দৃস্টিতে এ শাখায় কাকে প্রমোশন দেয়া যায়? প্রাথমিক ভাবে সেকান্দর সাহেবের নামটাই প্রস্তাব করলাম। না। স্যার মানলেন না। সরাসরি উড়িয়ে দিলেন।
বললাম, স্যারও ও যোগ্যতার দিক থেকে মাষ্টার্স। কাজের দিক থেকে ১২০ মাইল স্পীডে কলম চলে। এনারজেটিক।
না। ওকে দেয়া যাবেনা। ও আস্ত একটা পাগল। কথাবার্তায় লাগমহীন। দাড়ি, কমা নেই। পুলিস্টপতো দুরের কথা। মুখের উপর কথা বলে ফেলে। এসব লোক অফিসার হলে ব্যাংকের মান ইজ্জত সবই যাবে।
....এবার সুরটা পাল্টিয়ে বললাম, স্যার। রবি সাহেবকে....?
- ওতো মেট্রিক পাস। ক্লিয়ারিং ফরওয়াডিং ছাড়া আর কি পারে? কাজের চেয়ে ঘুষের পেছনেই সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। দশটাকা, পাচ টাকা কোনটাই ছাড়ে না। আজকের একজন অফিসার আগামীকাল হবে শাখা ম্যানেজার। রবি সাহেবের সে যোগ্যতা একেবারেই নেই। অফিসার মানেই দশ বিশজন ষ্টাফকে লীড দেয়া। গুরুত্বপুর্ন নথিপত্রে দস্তখত করে অনুমোদন দেয়া। এসব সুযোগ পেলে ওরা পুরো ব্যাংটাকে বিক্রী করে দেবে। সুতরাং এসব লোককে প্রমোশন দেয়ার ক্ষেত্রে আমার অনুমোদনও প্রশ্নবোধক হয়ে দাড়াবে।
আমি স্যারের মুখের দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, রবি সাহেবের বাসা থেকে পাকিয়ে নেয়া মুরগীর গোস্ত স্যারকে খাইয়ে কোন কাজ হয়নি। জানিনা, আর কতটা মুরগী পাকিয়ে স্যারকে খাওয়ালে অফিসার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যাবে। সেকান্দর সাহেবের আম কলাও ও ভেস্তে গেল। এসব উপঢৌকনের সামাণ্যতম আমার পেটেও যাওয়ার কারণে ইচ্ছে হচ্ছে, স্যারকে আবার বলি। কিন্তু মন সায় দেয়নি। আমার উপর রাখা স্যারের আস্থার জায়গাটুকু নস্ট করা ঠিক হবেনা।
...অবশেষে বললাম, স্যার। এ অফিসে আহমদুল্লাহ সাহেব অনেক সিনিয়র। ক্যাশে কাজ করার কারণে তাকে অফিসে সবার আগে আসতে হয়। আবার সবার পরে বিদায় যেতে হয়। কথা শেষ না করতেই স্যার মন্তব্য করে বসলেন,
- ওতো একটা গাধা্। ক্যাশের কাজ ছাড়া ও আর কি জানে?
- স্যার। ওতো কাজের কারণেই বের হতে পারেনা। আর তার কাজটাই এমন। অনেক পুরোনো দিনের বিএ পাশ। ব্যসিক ফাউন্ডেশন ভাল। কাজ শিখতে তো আর বেশীদিন লাগবেনা। ব্যাংকের কাজের জন্যই সে অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে পারেনি। অফিসার হলে অন্তত ক্যাশ হ্যান্ডলিং অফিসার হিসেবে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারবে। তাছাড়া বেচারার বড় মেয়েটা বিয়ে দিতে হবে। সিনিয়রিটির দিক তো সেও এটি পাবার যোগ্য...।
অফিসার পদপ্রার্থী ফরমে তিন নাম্বার নামটি আহমাদুল্লাহ সাহেবের। স্যার বললেন, ঠিক আছে। আপনি যেহেতু বলেছেন, যুক্তিটা সমর্থনযোগ্য। ওর নামের পাশে খালি ঘরে লিখুন - "পদোন্নতি দেয়ার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে"।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৫২২ বার পঠিত, ৭৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি- লগ-ইন থেকে এমন পোস্টেও যদি ফাস্টু হতে না পারি
কী আর করা -
জ্যুসটা খেয়ে বিদায় হই
আল্লাহতায়লা কার কপালে কি রাখছেন....
এক ,দুই ,তিন বলতে বলতে আমি ভাবছিলাম শেষে স্যার আপনাকে পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলবে কিন্তু না হলো না সিট
তেল মারার কত বিচিত্র কাহিনীর সাথে পরিচিত হলাম ভাই, স্যালুট আপনাকে। না, মনে হয় তবু কোন কাজে লাগবেনা। জীবনে একবারই চেষ্টা করেছিলাম, আরব দেশে হতে আসার সময় সুন্দর আকর্ষণীয় কিছু আতরের শিশি নিয়ে এসেছিলাম, জায়গামতো সময়মতো দিয়েছিলাম, প্রমোশনটা হাসিল করতে। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হলো না। তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, আর কোন দিনও ঐ পথ মাড়াবোনা। যা আছে কপালে এম্নিতেই হবে, আপনার পোস্ট হতে যতো শক্তিশালী তেলমালিশ পদ্ধতিই শিখি না কেন, ঐ কাজ আর নয়....
মেরুদন্ডহীন মানুষ কখনো ই কারোর পছন্দের হয় না। তেল মারার সময় আর তা ব্যবহার করার সময়ই ভাল লাগে।
এদের আদর কদর যা আছে তা সবেই ঐ একটা সময় হয়ে থাকে।
মূলত এদের কোন সম্মানবোধ থাকে না।
তবে তা বাংলাদেশে নয়। বাংলাদেশে এখন চলছে এক ব্যক্তির,এক পরিবারের,এক দেশের তৈল মারার প্রতিযোগিতা।
বিদ্যুত বিহীন বাতি চাইনা
ফিরে দাও মোর মোমবাতি,
ক্যারোসিনের হারিকেনে
ছিলনা মোর কমখ্যাতি।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে লাজলজ্জাহীনভাবে টেবিলের নিচে খাওয়ার অভ্যসটা প্রকাশ্যে টেবিলের উপরে খাওয়ার অবস্থায় উন্নীত হওয়ার সুবাদে ম্যানেজার সাহেবরাও এখন নিজের পরিত্যাগকৃত কুরসিটাতে যেন তাদের চেয়েও আরো ধূর্ত কাক শিয়াল বসে কুরসিটাকে এমনভাবে অপবিত্র ও নোংরা করে গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি করেন যাতে কোন ভদ্রলোক ও আক্কেলজ্ঞানওয়ালা মেধাবী শিক্ষিতরা সরকারী অফিস আদলতে বসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলে সরকারী ব্যাংক-বীমা, অফিস আদালত সব কিছুতেই গ্যাঞ্জাম লেগেই থাকে। ভাল সার্ভিস এসব অফিসগুলো থেকে উধাও হয়ে গেছে।
ধন্যবাদ, অনেক ভালো লেগেছে।
ভাল লাগল এই পর্বটি
গেছে ?
হায় হায় কত রকমের ঘুষ !!
আমার বউ কৈ? কবে পাঠাবেন? @পুষ্পমণি
কারণ তিনি মানুষের সার্বিক অবস্থা বুঝেন.... তবু
ও কেন যে.........
মন্তব্য করতে লগইন করুন