রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২৫)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২০ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:১৫:৪৩ সকাল
পর্ব-২৪
আজ বিপুর মনটা খুবই খারাপ। অন্য দিনের মত হাসিটা মুখে নেই। ক্ষনিকের জন্য বিদায় নিয়েছে। থেমে গেছে আগের সেই চাঞ্চল্যতা। আজ পড়ার টেবিলে বসতেই ওর প্রশ্ন-
- স্যার। আপনি কি আমাকে আর পড়াতে আসবেন না?
- 'না। আসবোনা' এটি নিরেট বাস্তবতা হলেও বলা সম্ভব হয়নি। ইচ্ছে করে বলতে চাইনি। কিছু কিছু সময় আর শব্দ মানুষকে বিদ্যুত গতিতে উত্তপ্ত করে তুলে। আমি এমনটি করতে অ্ভ্যস্ত নই। একটি মাত্র শব্দ দিয়ে সব শেষ করে দেয়া বোকামী বৈ কিছুই নয়। তাই জবাবটা বিপুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। ওর অবুজ হৃদয়ের অনুভুতিকে আহত না করে শব্দের ভাষায় 'নো' বলার আর্ট খুজছি। তাই জবাবটা সোজা না দিয়ে মুচকী হাসি মুখে জানতে চাইলাম
- কেন। কি হয়েছে?
- মনটা খুব ভারাক্রান্ত। আডষ্ট কন্ঠ যেন বিপুর ভেতরের কথাগুলোকে আটকে রেখেছে। হতাশার চোখে জলসানো পানি নেমে আসতেই ওর মাথাটা নীচু হয়ে গেল। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলতে লাগল,
- স্যার। আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন যে, বাবা এ শাখা হতে বদলী হওয়ার নোটিশ এসে গেছে। আগামী মাস হতে ষোল শহর শাখায় যোগ দিতে হবে।
দুদিন পর আজ আবার বিপুকে পড়াতে এসেছি। এর মাঝেই ম্যানেজার সাহেব বদলী হওয়ার নোটিশটি এসে পড়েছে। এ নিয়ে অফিসে সবার মাঝে এক মিশ্র গুঞ্জন শুরু হয়েছে। যারা প্রমোশন পায়নি, তারা খুব ক্ষুব্ধ। কানে কানে বলছে, শালা আমার প্রমোশনটা দিলনা। খূব ভাল হয়েছে। আবার যারা প্রমোশন পাবার অপেক্ষায়, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আফসোস করছে। বলছে, দুত্তরি। শালার ভাগ্যটাই খারাপ। তেলটেল মেরে যাও স্যারকে একটু রাজী করালাম, এবার দেখি যাবার পালা।আর একজন স্যার আসবে। তার সাথে পরিচয় হবো। তারপর কত নাম্বার সিসির তেল ব্যবহার করলে মন গলাতে পারবো..এসব দুশ্চিন্তায় প্রমোশনের অপেক্ষমান লিষ্টের লোকগুলো বড়ই চিন্তিত।
সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে আসার কারণে আমার জন্য ঘটনাটি বাসী হলেও বিপুর জন্য নতুন। দুশ্চিন্তার কারণও বটে। চাকুরীর সুবাদেই বিপুকে পড়াতে আসা। আকর্ষন-বিকর্ষনের সুত্র এখানে অকেজো বলেই কি করলে ভাল হবে সেটা নিয়েই আমি ভাবছি। তাছাড়া, ম্যানেজার সাহেবের মেয়ে পড়ানোর কারণে অফিসিয়ালী এতদিন যে সব বাড়তি সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছিলাম, স্যারের বিদায়ে এখন সেটি আর পাওয়া যাবেনা। কাজেই বিকেল চারটা পর্যন্ত অফিস করে বিপুকে পড়াতে যাওয়ার যুক্তিটা মন কিছুতেই সায় দি্ছেনা। এমনটি একেবারেই অসম্ভব। পাপ্য টিউশনির টাকা বাসায় দেয়ার ব্যবস্থা হলেও অফিসিয়াল কাজ সেরে বাকী সময় ম্যানেজ করার সিদ্ধান্ত শুধু অবাস্তব নয়, খুব কষ্টসাধ্যও বটে।
বিপু বিষয়টা আচঁ করতে পেরেছে। তাই আমাকে হারানোর ভয় ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ও জানতে চায় আমার ভেতরের অুনভূতির কথা।
মুচকী হেসে বললাম, তুমি এত হতাশ কেন? আমি কি বলেছি তোমাকে পড়াতে আসবোনা?
- স্যার। আপনিতো আর অগের মত দুপুর দুটায় আসতে পারবেন না। বাবাও এ নিয়ে ভাবছে।
- সপ্তাহে যেহেতু তিন দিন তোমাকে পড়াতে আসি, সেক্রিফাইসটা একটু বেশী করলাম। মানুষ স্বার্থের জন্য অনেক কিছু করলেও, একটা সময় আসে দায়ীত্ববোধ তাকে বেঁধে রাখে। ও ইচ্ছে করলেও ছুটতে পারেনা। আমি মনে হয় সেই দায়ীত্ববোধের জালে আটকা পড়ে আছি। যাকগে। এ নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি দিন দিন যেভাবে ভাল ছাত্রীতে পরিণত হচ্ছ, এতে আমার কিয়ে আনন্দ তা তোমাকে বুঝাতে পারবোনা। একজন শিক্ষকের বড় পাওয়া হল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোন ছাত্র যখন ভাল ফলাফল নিয়ে আসে। সামনে তোমার পরীক্ষা। আমার উপর নির্ভর করছে তোমার ফলাফল। কাজেই সে পর্যন্ত এ বিষয়টিকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। প্রয়োজনে তোমার বাবার অফিসে আমিও ট্রান্সফার হয়ে যাবো। কি বল?
আশাবাদী কথাগুলো শুনে বিপু আশ্বস্ত হল। চোখে মুখে খুশির ভাবটা ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে ভেতরের স্বাস্তিটা প্রকাশ করল। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বিপু বলতে লাগল,
- জানেন স্যার। বাবা নিজেই বদলী হওয়ার জন্য অনুরুধ করেছিলেন। কিন্তু এখন ভাবছেন, মনে হয় ভুল হয়ে গেছে। কারণ একদিকে চাকুরী হয়তবা আর বেশিদিন করতে হবেনা। দ্বিতীয়ত, নতুন শাখায় এসে আবার সবার সাথে পরিচিত হওয়া অনেক ঝামেলা। আর আপনি আমাকে পড়াতে আসার বিড়ম্বনাটা আগে মাথায় ছিলনা। এসব নিয়ে বাবা গতরাতে আম্মর সাথে আলাপ করার সময় কিছুটা চিন্তিত মনে হয়েছে।
- দ্যাখ। মানুষ তিল তিল করে গড়ে তোলা একটা সমাজ হতে অন্য পরিবেশে যেতে অনেক কিছুই ছাড় দিতে হয়। অবুঝ মনকে আহত করে একজন পাষন্ডের মত ভেতরের কষ্টগুলো চেপে রেখে বিদায় নিতে হয় সৃতিবিজড়িত মায়ার জায়গা থেকে। এ বিদায় যে কত কস্টের আমি এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাই। স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দালানগুলোর সাথে আজও মনের অজান্তে কথা বলে আসি। নীরবতার ফাঁকে রেখে আসা সে সব নিত্য পথে হাঁটার শব্দ যেন কানে ভেসে আসে। কাছের মানুষগুলো চারিপাশে হাটার শব্দ শুনতে পাই। আত্মার আতীয়রা ইশারা দিয়ে ডাকে ফিরে যেতে। মানুষ তার অবস্থান হতে দুরে না গেলে অনেক সময় এসব অনুভুতি বুঝা যায়না। কিন্ত কিছুই করার নেই। এটাই জীবন।
তোমার বাবার বিদায়ের খবরে অফিসেও সবার মাঝে এক ধরনের অনুভূতি কাজ করছে। একটানা অনেক গুলো বছর যাদের সাথে দৈনিক ৮-১০ ঘন্টা কেটেছে, স্থান পরিবর্তনে ওদের ভালবাসার একটা অজানা মোহমায়া মনকে খুব কষ্ট দেয়। এ কষ্টটা মানুষ কাউকে বলতে পারেনা। একটা সময় আসবে, আমাকেও একদিন বলতে হবে, বিপুহে! আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়। কিন্তু সেদিনের বিদায়ে আহত হৃদয়ের প্রলাপকে উপেক্ষা করে কবিগুরুর মত বলতে হবে
যেতে নাহি দেব হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৮৩০ বার পঠিত, ৬৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।.....
স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দালানগুলোর সাথে আজও মনের অজান্তে কথা বলে আসি। নীরবতার ফাঁকে রেখে আসা সে সব নিত্য পথে হাঁটার শব্দ যেন কানে ভেসে আসে। কাছের মানুষগুলো চারিপাশে হাটার শব্দ শুনতে পাই। আত্মার আতীয়রা ইশারা দিয়ে ডাকে ফিরে যেতে।
আপনি আমার অন্তরে লালিত কথাগুলোই যেন বলে দিলেন। শৈশব থেকে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রথমেই স্থানীয় প্রাইমারীর তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত। অবশ্য প্যারালালি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন রেওয়াজ অনুযায়ী সকালে মক্তবে হুজুরের কাছে পড়তে যাওয়া। এরই মাঝে আম্বার আগ্রহে ও পারিবারিক সিদ্ধান্তে স্কুল থেকে ট্র্যাক পরিবর্তন করে কাউমী মাদ্রাসায় পড়া। সাত বছর পর আবারও ট্র্যাক পরিবর্তন করে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়া। ফাজিল পর্যন্ত পড়াশুনা করে আবারও কলেজে ভর্তি হয়ে গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশুনার মাঝে কত শ্মৃতি যে স্মৃতির পাতায় অলিখিতভাবে লিপিবদ্ধ আছে তা নিজের অজান্তেই মাঝে মধ্যে পাঠ শুরু করি। কিছুটা মধুর তো আবার কিছুটা বেধনার, কিছুটা রোমাঞ্চকর তো কিছুটা বিব্রতকর। সব মিলিয়ে মন চায় আবারো ফিতে যেতে সেই সোনালী দিনগুলোতে।
ইংলিশ মিডিয়ামে কিছুদির পরলেই রেকর্ড হয়ে যেত।
তবু ব্যথা পেতে হয়
তবু বোকা মনে কয়
যাতনা তার ক্যামনে সয়
তবু আবার ফিরে কয়
যদি ভালবাসা হয়।
ধন্যবাদ।
পিছনের অনেক কিছু আমাকে তাড়িত করে।
চরম বাস্তব। ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন