রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২৪)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:০৪:৫৬ দুপুর
পর্ব-২৩
একদিন পর আবারও এসেছি পড়াতে। আজ বিপু কিছুটা অন্যরকম। গত পরশু স্যারের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত গল্প শোনার আগ্রহের অভিব্যক্তি এটি। বয়সের গন্ডি এখনও পরিপক্কতার সীমা পার হয়নি বলেই অনেকটা সরল প্রকৃতির। স্বভাবগতভাবেই আমি শিক্ষক হিসেবে কঠিন প্রকৃতির নয়। সবাইকে কাছে টেনে নিজের মত করে গড়ে তুলতে চাই। শিক্ষক হিসেবে বাধাহীন এ সরল রাস্তায় কেউ উলু ধ্বনি দিয়ে ধুলো উড়াতে চাইলেই আমার শিক্ষকতার সীমা রেখাটা টানতে চাই। আজ সে সীমারেখার গন্ডি বুঝাতেই শিক্ষকতার শানে নুযুল ব্যাখা করবো।
বিপু মনে মনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। স্যার নিশ্চয়ই পড়ার শেষে নতুন বিষয়ে কথা বলবে। ইয়েস-নো যাই হোক, বিষয়টা সবার প্রিয়। আমার খোলামেলা কথায় সে দারুণ খুশী। বিগত কয়েকমাসে পড়ালিখা সংক্রান্ত স্যারের ইম্প্রেসিভ কথায় তার মাঝে অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে।
ছাত্রীদের ধমক দিয়ে কিছুই আদায় করা যায়না। কাছে টেনে হিতাকাঙ্কী সেজে বুঝানোর ফলটা অন্যরকম হয়। অবুজের বিবেক জাগ্রত হয়।
কমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াবস্থায় ছাত্র আব্দুর রহীমকে ধমক দিয়ে কাজ হয়নি। হিতে বিপরীত হতে দেখে নিজের অবস্থান পাল্টাতে হয়েছে। বেত্রাঘাতে ছাত্রের পীঠে দাগ ফেলানোর চাইতে বুঝিয়ে পড়াতে পারাটাই শিক্ষকতার কৃতিত্ব। রহিম ছিল চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বড় ডানপীঠে। পাঠদানে বড়ই ফাঁকী বাজ। মাতাপিতার একেবারেই অবাধ্য। কিন্তু আমি যে নাছোড় বান্দা। যখন আমার সব কৌশল শেষ, তখন কঠোর হয়ে গেলাম। বললাম, আজ তোমাকে পড়া দিতেই হবে। না হয় শেষবারের মত কঠিন পিটুনি দিয়ে বিদায় নেব লজিং থেকে।
দরজা বন্ধ করা হল। বেতটা টেবিলের উপর। মেজাজটা ১২০ ভোল্টে চার্জ দিয়ে রেখেছি। বাইটা আমার হাতে। বাংলা বই। আজকের পড়া কবিতা। নাম- আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফূল তুলিতে যাই।
আজ তিন দিন হল। কবিতাটা ও মুখস্থ করতে পারেনি। বাবা জেঠা সবকিছু বলেও আদায় করতে পারিনি। তাই আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা 'রাগ' নামের ঘূমন্ত কঠিন মানুষটিকে জাগিয়ে তুললাম।
রহীম নিশ্চুপ। এত অসহায়ত্বে সে কখনও পড়েনি। ও বুঝতে পেরেছে, বেতের আঘাত আজ একটিও মাটিতে পড়বেনা। বাচাতে ওর মা বাবাও আসবেনা। তাই সে ও বাচার জন্য শেষ অনুরোধটা করে বসল।
- স্যার। আপনাকে একটা কথা বলব।
- বল। খুব গম্ভীর স্বরে জবাব দিলাম।
- বেতটা টেবিলের উপর না রাখলে হয়না?
- না। হয়না। এটা না হলে তুমি পড়বেনা। আমি ভাল করে জানি।
- না। স্যার আজকে পড়া শিখে এসেছি। স্যার। বেতটা সামনে থাকলে ভয়ে আমি পড়াটা ভূলে যাব। না পারলে মাইরেন স্যার। অসুবিধা নেই। এখন যদি বেতটা...।
- ঠিক আছে। এবার পড়া বল।
রহীম একটু নেড়ে চেড়ে বসেছে। ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিল। ভয়ে আমার দিকে না তাকিয়ে নীচের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ। তারপর কোরানের হাফেজের মত ১২০ মাইল গতিতে কবিতা পড়া শুরু করল
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ী যাই।
কবিতার প্রথম দু লাইন বুঝতে পারলেও বলার গতি ১২০ এর ও বেশী হওয়ায় বাকী লাইনগুলোর কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু শূনেছি ..উন উন বুন বুন টুনো টুনো টুন.....
খুব রাগাম্বিত হলাম। বললাম। থাম। কি কবিতা বল নাকি মুখস্থ কোরআন পড়ছ। বেতটা হাতে নিয়ে বললাম, খুব আস্তে আস্তে বলতে হবে। না হয় ঠোটের উপর বেত্রাঘাত করব।
-ঠিক আছে স্যার। রহীম সম্মত জানাল। তবে স্যার আর একটা কথা বলব?
- তুমি কি কথা বলবে। না পড়া দেবে?
- না । এটা শেষ কথা স্যার।
- বল।
- মারবেন না তো স্যার!
- না। মারবোনা। ভাবছি ভয়ে হয়তাবা ও পড়া ভুলেও যেতে পারে।
- স্যার আমার খুব ডর লাগছে। ভয়ে সব বন্ধ হয়ে আসছে। কথা দিন যে, সত্য কথাটা বললে আমাকে মারবেন না।
রহীমের কথাটা শুনে আমার মনটা নরম হয়ে গেল। ভাবলাম, তাকে বেত্রাঘাত আর আমার ইচ্চে নয়। পড়াটা আদায় করতে পারলেই হল। তাই একটু সহজ হলাম। বললাম, ঠিক আছে। মারবেনা । বল কি বলতে চাও।
- স্যার। আপনি আমাকে মারবেননা বলেছেন। আমি বিশ্বাস করি। তাই মনের কথাটাই বলি। সত্য বলার জন্য যদি আপনি আমাকে মারেন, কিছুই করার নাই। প্রথমত, স্যার আমি এতদিন অনেক দুষ্টমি করেছি। আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। এজন্য কথা দি্চ্ছি আজ থেকে আর দুস্টমি করবোনা।
দ্বিতীয়ত স্যার, যে কবিতাটি আমি কোরানে হাফেজের মত করে পড়ছি, আসলে এটি্র প্রথম চার লাইন ছাড়া আমি আর পারিনা স্যার...একথা বলেই রহীম চেয়ার থেকে উঠে পেছনে সরে গেল। দুহাত জোড় করে বলতে লাগল, স্যার আজকের জন্য মাফ করে দিন প্লীজ...
রহীমের অভিনব এ কৌশল দেখে আমার রাগ ১২০ থেকে জিরোতে চলে এল। আমি হেসে দিলাম। রহীম দৌড়ে এসে পা ছুড়ে সালাম করে নিজেও হাসতে শুরু করল। সময়ের বিবর্তে রহীমের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছিল।
...বিপুকে ধমক দিয়ে শিক্ষক হিসেবে পার্সোনিলিটি দেখানো সহজ। কিন্তু জ্ঞানদান সম্ভব নয়। তাই আজকের পাঠ শেষে অসমাপ্ত কথাগুলোই আবার শূরু করলাম। সাথে কাজের মেয়ে তাহেরাকে ও ডেকে বসালাম।
আমার বন্ধুর বন্ধু রিপন। বুয়েটের ছাত্র। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো। প্রথম বষ পার না হতেই ও কেমন জানি হয়ে গেল। উড়ো উড়ো ভাব। পড়ায় মন বসেনা। টেবিলে বসলেই মাথা ব্যাথা শুরু হয়। সারাদিন শূয়ে শুয়ে ভাবুকের মত ভাবতেই ভাল লাগে। মাঝে মধ্যে যাতনার সীমাটা সহ্যর বাহীরে চলে যায়। এ পরিস্থিতি হতে উত্তরণের জন্য অনেক ডাক্তারের কাছে গিয়েও লাভ হয়নি।
অনেকদিন পর ক্লাশমেইটের বাবার কাছে গেল। পেশায় আর্মি ডাক্তার। সাথে ফাইলবন্দী সব প্রেসক্রিপশান নিয়ে গেল। বন্ধুর ডাক্তার বাবা সবকিছু খতিয়ে দেখল। রোগের উৎস জানার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই পেলনা। ডাক্তার বিস্মিত। উৎস ছাড়া রোগ নির্ণয় সম্ভব নয়। দুচার টাকা পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়ার জন্য তিন চার ধরনের ওষুধ দিয়ে বিদায় করলে রুগী তৃপ্তি লাভ করবে। কিন্তু সমস্যারতো সমাধান হবেনা। তাই রিপনের হাত ধরে বলল,
- দ্যাখ বাবা। তোমার কাগজপত্রে যা দেখলাম, আর মুখে যা শূনলাম, এতে তোমাকে বলার মত আমার কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে, আরও এমন কিছু আছে, যা তুমি আমাকে লজ্জায় বলতে চাচ্ছনা। তুমি বিয়ে না করে যদি সন্তান হওয়ার জন্য আমার কাছে ওষুদ নিতে আস, এ ওষুধে কোন কাজ হবেনা। মুল কথাটাই আমাকে অকপটে বলে দাও। আমি ডাক্তার। আমাকে না বললে এ রোগ তোমাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে।
না। রিপন কিছুই বলতে চায়না। অবশেষে ডাক্তার হঠাৎ দাড়িয়ে গেল। তারপর চোখের নিমিষেই খুব জোরে একটা থাপ্পড় রিপনের গালে বসিয়ে দিল। রিপন কিছু বলার আগেই ডাক্তার অভিভাবকের সুরে বলতে লাগল,
- বেয়াদব। কান্ডজ্ঞানহীন ছেলে কোথাকার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসছে। ফকিরের পোলা যে ফকীর থাকে, এটি বুঝার জন্য তোমার মত ছেলেদের দেখাই যথেষ্ট। কত কষ্ট করে তোমার মাতাপিতা পাঠিয়েছে বুয়েটে পড়তে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিধ্যাপীঠ। জানো তুমি কি হতে যাচ্ছো আগামী দিনে এ জাতির একজন শ্রেষ্ঠ নাগরিক। গাড়ী, বাড়ী নারী সবই তোমার চারিপাশে ঘূরে বেড়াবে।
রিপন একেবারেই কিংকর্তব্যমিমুঢ়। বুঝে উঠতে পারছেনা যে কি করবে। পিতাসম বন্ধুর পিতার এ আচরন ওর কাছে জানা নেই। ও ভয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে। রাগে ক্ষোভে কাপঁছে। ভাবছে, নিজের মাতাপিতাও এমনভাবে কখনও চড় দেয়নি। আর আজ এ বয়সে আমাকে.....।
বন্ধুর ডাক্তার পিতা রিপনকে কঠোর বাসায় কথাগুলো বলে যাচ্ছে। জানো, বুয়েট থেকে পাশ করার পর বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেয়েটাই তোমার জন্য। আর তুমি নাকি কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে হাবু ডুবু খাচ্ছ। আর এসব বাজে চিন্তায় নিজেকে জড়িয়ে মিছে রোগ তৈরী করে ডাক্তারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছ। এটিত তোমার বানানো রোগ।
- কি ঠিক বলিনি?
- জ্যী স্যার।
- কে সে মেয়েটি।
- আমার টিউশনির ছাত্রী।
পড়তে কতটাকা লাগবে তোমার? আজ থেকে টিউশনিতে প্রাপ্য টাকা আমি দেব তোমাকে। পড়াতে হবেনা ঐ মেয়েকে। যাও। তোমার ভেতরে কোন রোগ নেই। সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের পড়ায় মন দাও। ছাত্র জীবনে এসব প্রেম-টেম যারা করে , মাতা পিতার স্বপ্ন ভঙ্গ করে প্রেমের ওয়াদা রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেম ওসব ছেলে মেয়েরাতো জীবনে কিছু করতে পারেইনা, বরং নিজের ক্যারিয়ারটাকে নষ্ট করার পাশাপাশি সমাজের কাছে মাতাপিতাকেও অপমানিত করে। ছি।
তুমি যদি এসব প্রেম নামের এসব বাজে জিনিষ বাদ না দাও, তাহলে আমিও আমার ছেলেকে বলে দেবো, মাতাপিতার অবাধ্য তোমার মত বন্ধুর সাথে না চলতে।
রিপন রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দারুণভাবে নাড়া দেয়া ডাক্তারের অভিভাবকসুলভ কথাগুলো পুরো পথ জুড়ে ভাবল। ছাত্রীর প্রেমে জড়িয়ে পড়া এ নোঙ্গরহীন প্রেম ভাঙ্গা চাট্রিখানি কথা নয়। কিন্তু তাকে ভাংতেই হবে। জীবন চলার পথে অস্তিত্বের প্রশ্নে অনেক কিছূর সাথে যেমন আপোষ করতে হয়, আবার অনেক কিছূ পরিহারও করতে হয়। অবশেষে রিপন তাই করল।
তম্তয় হয়ে শোনা রিপনের গল্পে বিপু অভিভুত। ওর ঘেন্না হল প্রেমের প্রতি। ক্ষোভে বড় ভাইয়ের জড়িয়ে পড়া প্রেম কাহিনীটা অকপটে বলে ফেলল। ভারাক্রান্ত মনে মাতাপিতার কষ্টটুকু শেয়ার করল। বলল, স্যার বড় ভাইয়া ছা্ত্র হিসেবে খুব ভাল ছিল। কিন্তু এ মেয়েটার সাথে জড়িয়ে কেন জানি বড় অবাধ্য হয়ে গেল। অবশেষে অনার্সের মাঝামাঝি পড়ালিখা থামিয়ে দিল। বড় ভাইয়া এখন ভবঘূরে এক রাজনীতিবিদ..।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৬৯২ বার পঠিত, ৪৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বুঝাই যাচ্ছে আপনি কাউন্সিলিংয়ে যথেষ্ঠ স্ট্রং। হুমম, শিক্ষকদের এই গুনটি থাকা অত্যন্ত জরুরি। এক এক স্টুডেন্ট এক এক ধরনের স্বভাব ধারন করে। একজন দক্ষ শিক্ষকই পারে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রকে একতীভূত করে পড়াতে।
ভাল লাগছে আপনার স্মৃতিচারন গল্প...চলুক সাথে আছি।
শুকরিয়া !!!!
বিয়ের আগে প্রেমে গোল খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। আর এ বিষয়ে ভূল করলে চলেনা। তাই আগামী দিনের সঠিক পাটনার খুজে নেয়ার জন্য এটিকে যারা যেখানে সেখানে নিবেদন করে জালে আটকা পড়েছে, ওদের জীবন ভাল হতে দেখিনি।ি
রহিমের কৌশল আমার কৌশলের সাথে পারবে না।
ভাবতেছি আপনাকে নিয়া একটা কাউন্সিলিং-এর প্রতিষ্ঠান খুলব। থাকবেনতো সাথে?
এই পর্বটাই অন্যান্য পর্ব গুলোর ছেয়ে ভাল লেগেছে।
ছাত্রের কাছে ও শিক্ষকের অনেক কিছু শিখার আছে।
এই পর্বে রহিমের কাণ্ড কারখানা বেশি ভাল লেগেছে। আপনি ওকে ক্ষমা করে ওনেক ভাল করেছেন। মারলে প্রতিক্রিয়ায় সে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যেত। আপনাকে বিশ্বাস করতনা।
বিপু কে বন্ধুর প্রেমের হিস্ট্রি দিয়ে বুঝালেন। বুজল। ভাইয়ের জীবন থেকে সরাসরি শিক্ষা পেয়েছে বলে সহজে বুঝ মানল। কিন্তু কি জানেন মানেন আর নাই মানেন ওই বয়সের প্রেমের তুলনা হয়না। আবেগের থাকেনা বিন্দু মাত্র খাদ। সপ্নে থাকেনা সাদা কালো রঙের তুলির আঁচড়।
মন্তব্য যাই করেছি ইসলামের বাইরে যাবনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন