রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২২)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৩ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:০৯:৪৫ বিকাল
পর্ব-২১
বিপু আগের চেয়ে অনেক ফ্রি হয়ে উঠেছে আমার সাথে। খুব ভাল ভাবে বুঝতে শুরু করেছে স্যারকে। ভালমন্দ বিষয়গুলো আগ্রহ সহকারে জানতে চায়। শিখতে চায়। এর পাশাপাশি আবদারও অনেকটা বেড়েছে। রক্ষা না করলে অভিমানে মুখটা মলিন করে রাখে। পড়ার ফাঁকে কৌতুক বলতেই ও খিল খিল করে হেসে উঠে। বলে, ও স্যার। দুত্তরি। আপনার সাথে রাগ করে একটুও থাকতে পারিনা। আপনি বড়ই রসিক স্যার।
- আচ্ছা। আপনি কি আগের ছাত্রীদের সাথেও এমন করতেন? - বিপু জানতে চায়। আমি পাশ কেটে প্রসঙ্গ অন্য দিকে চলে যাই। বলি, আমি এমনই। এজন্য অনেক ছাত্রীকে বাড়াবাড়ি করতে দেখে কত টিউশনি লজিং ছেড়েছি।
- কেমন বাড়াবাড়ি স্যার?
- স্যারের সাথে কোন বিষয়ে সীমালঙ্গন করা। দ্যাখ, আমার ছাত্রীদের কেউ কেউ তোমার চেয়েও খারাপ ছাত্রী ছিল। কিন্তু আমার কথামত ভাল করে পড়ার কারণে অনেককেই ক্লাশে ফাষ্ট হতে দেখেছি। আমিতো এখনও মনে করি, তুমি আর একটু চেস্টা করলে তাক লাগিয়ে দেবে। কি বলো?
- বিপু মুচকী হাসে। বলে, স্যার চেষ্টাতো করছি। স্যার, সপ্তাহে তিন দিন আসা যায়না? প্রতিদিন আসলে আমি আরও ভাল করতাম।
টিউশনির প্রাপ্য টাকা, দুরত্ব, সময় সব কিছু মিলিয়ে আমার অবস্থাযে কোরোসিন, এটা বিপুকে বলতে পারিনা। তাই নিজের ব্যস্ততা দেখিয়ে কেটে পড়ি। ভয় হয়, অফিসে আবার না জানি কেউ মনে কর, ঐ দ্যাখ। মজুমদার অফিসে না আসতেই তেল মারা শুরু। সিনিয়র ক্লার্ক হতে এখনও তিন বছর বাকী। উনি কোন দুঃখে তেল মারে? এমনটি কেউ ভাবা ও অমুলক নয়। জাতে বাঙ্গালীতো। এসবে খুব বেশী মজা পায়।
বিপুদের বাসার কাজের মেয়ের নাম তাহেরা। খুব চালাক। চলাফেরা দেখে মনে হয় ও এ বাসারই একজন। মেয়েটি চোখে মুখে কথা বলে। চলাধারায় মনে হয় বিপুর ঘনিস্ট বান্ধবী। বাস্তবেও তাই। তাহেরা বিপুর চেয়ে একটু বেশী এগিয়ে। কথা বার্তায় লজ্জা শরম কিছুটা কম। আমার প্রতি তার বাড়তি আতিথেয়তার কারণে কিছু বলিনা। দরকারইবা কি? বাসায় আমের ভর্তা থেকে শূরু করে যা যা হয়, সবই আমার জন্য রেখে দেয়। ঢুকে টেবিলে বসতেই দৌড়ে এসে সামনে পরিবেশন করতে করতে বলে,
- স্যার। এটা আপনার জন্য রেখেছি। খুব মজা হয়েছে। খেয়ে দেখুন। জিভে পানি এসে যাবে। বিপু আপনার জন্য আগেই আলাদা করে রেখেছে।
বিপুর কথা তাহেরা বলতে গেলেই বিপু মুচকী হেসে সায় দেয়। আর আমি ভাবী, তাহেরা বুঝি বিপুর জন্য ওকালতি শূরু করেছে।
অভ্যাসগতভাবে আমি মানুষের প্রশংসাটা করতে কখনও ভূলে যাইনা। এর ফলাফল ও অনেক পেয়েছি। যে কোন বাসায় খাওয়ার পর ভাবীকে না পেলে অন্তত ভাইকে বলে আসি, ধন্যবাদ ভাই। দাওয়াত না দিলে ভাবীযে এত মজাদার লোভনীয় খাওয়া পাকাতে পারে জানতাম না। এসব প্রশংসা তীরের মত কাজ করে। মুহুর্তেই তার কলিজায় স্থান করে নেয়ার পদ্ধতি এটি।
বিপুর পড়ালিখার উন্নতির জন্য আমার প্রশংসা আর উৎসাহ কিছুটা কাছে টেনে আনলেও আমি ডিফেন্স থাকতে পছন্দ করি। কারণ, আমি ওর ভাল চাইলেও মনের অজান্তে ওর মাঝে গড়ে উঠা ভালবাসা রোধ করার সাধ্য কারো নেই। অবুঝ মনে গড়ে উঠা ভালবাসার বিস্ফোরণ সহজে থামানো যায়না।
অন্য একদিনের কথা। বাসায় গিয়ে টেবিলে বসতেই তাহেরা দৌড়ে এল। বলল, স্যার, আজকে একটা গুরুত্বপুর্ন খবর আছে। ভেতরে গিয়ে চা নাস্তা হাতে ফিরে এল তাহেরা। তারপর বলতে লাগল,
- জানেন স্যার, বিপু গতরাতে আপনাকে স্বপ্নে দেখেছে।
- তাই নাকি? বিপুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম।
- বিপু মাথা নেড়ে লজ্জাবতীর মত জবাব দিল, জ্যী স্যার।
- আচ্ছা, কি দেখেছো বলোত? খুব ভাল খবর শুনালে আজ।
বিপু বলতে লাগল, স্যার, বিশাল মিছিল। হাজার হাজার মানুষ গলাফাটা শ্লোগানে এগিয়ে যাচ্ছে। থম থমে অবস্থা। আমি অনেক দুরে দাঁড়িয়ে দেখছি, আপনি মিছিলের একেবারে অগ্রভাগে। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ। আমি আতংকিত মনে এগিয়ে গেলাম আপনাকে দেখতে। দেখি, রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন আপনি ।
- আচ্ছা, গুলিটা কোথায় লেগেছে? - আবেগতাড়িত কথনে বাধা দিয়ে বিপুর কাছে জানতে চাইলাম।
- কিছুটা লজ্ঝার দৃস্টিতে মাথা নীচু করল। তারপর বলতে লাগলম, স্যার, গুলিটি আপনার বুকের মাঝামাঝি লেগেছে।
আহ। একি বল। আমার ভাললাগা, ভালবাসার তীর্থস্থান কলিজাতে! ইস! সব শেষ হয়ে গেল!....খুব ভাল স্বপ্ন দেখেছ।
দ্যাখ। স্বপ্ন মানুষের কল্পনার বাস্তব রুপ। তুমি যদি কাউকে নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা কর, ভাবতে থাক, তাহলে স্বপ্নে সে লোকটিই ধরা দেবে।
- স্যার। বিপুযে আপনাকে কত ভালবাসে বুঝতে পারছেন - তাহুরা জবাব দিল।
এটাই স্বাভাবিক। স্যারের প্রতি ছাত্রীর ভালবাসা কিন্তু এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ। বিপুকে দেখলেই আমি বুঝি। ও আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। ওর বাবাও বলে, আপনি আসার পর আমার মেয়েটার রেজাল্ট অনেক ভাল হয়েছে। ও সব সময় আপনার কথা বলে।
অতীতে পড়ানো ছাত্রীদের টেবিলের নিচে ঠ্যাং দিয়ে প্রেমের চেস্টা, স্যারকে নিয়ে দুবোনের ঝগড়া, খাতায় মিছে প্রেমের কবিতা লিখা, এসব পাগলামির কারণে সব মিলিয়ে তেরটি লঝিং পাল্টিয়েছি। অভিজ্ঞতালব্দ লজিং জীবনে অনেক পদস্খলিত স্যারকে অপমানিত হতে দেখেছি। দেখেছি, স্যারের হাতে পড়তে দেয়া একটা অবুঝ মেয়েকে বিপথে নেয়ার কারণে আশাহত মাতাপিতার হৃদয়ের করুণ আর্তনাদ। ধর্মীয় দৃস্টিতে এসব মাখামাখি সমর্থনযোগ্য না হলেও জীবন যৌবনের চাওয়া পাওয়ার দর কষাকষিতে অবুঝ মন অবুঝের মতই কাজ করে বসে। এটি সৃস্টির মাঝে স্রস্ঠার এক বিস্ময়কর মোজেজা! রং নেই। গন্ধ নেই। আকার নেই। তবু মিছে ছোয়ার প্রাণান্তকর প্রচেস্টা।
ভাবছিলাম, ছাত্রীর সাথে বেশী কঠোর হলে উল্টোটাই বেশী হয়। মধ্যম পন্থাবলম্বনে কখনো ক্লাশ মেইট, কখনো তাহুরার মত মেয়েরা উস্কে দেয় স্যারকে নিয়ে কল্পনায় ভালবাসার মিছে জাল বুনতে। বিপু আমাকে নিয়ে বিপুর স্বপ্ন দেখা তারই ইঙ্গিত বৈ কিছু নয়।
আমি মুচকি হাসি দিয়ে সহজভাবে বিপুর স্বপ্ন দেখাকে উৎসাহ দিলাম। তার পর পাঠে মনোনিবেশ করে সেদিনের মত এটির সমাপ্তি টানতে চাইলাম। কিন্তু শেষ হলনা। পড়ার ফাঁকে বিপুর প্রশ্ন,
- স্যার। আপনি এত ভাল মানুষ কেন? যে কোন মানুষকে সহজে কাছে টানতে পারেন। আমার মত কি আর কোন ছাত্রী আপনাকে স্বপ্নে দেখেছে?
বড় আদরের দুলালী বিপু। ম্যানেজারে সাহেবের দ্বিতীয় ও একমাত্র ছোট মেয়ে। সবাই তাকে খুব আদর করে। তাকে যদি কোন কারণে ধমক দেই, তাহলে ম্যানেজার সাহেবকে সোজা বলে দেবে,
- আমি স্যারের কাছে আর পড়বোনা?
ম্যানেজার জানতে চাইবে, কি হয়েছে? আমি প্রতিত্যুরে সত্য কথাটা বললে, বিপুকে পড়ানো আর হবেনা। উল্টো আদরের বিপুর পক্ষালম্বন করে সবাই আমাকেই দোষারুপ করবে। এটি নিরেট বাস্তবতাও বটে।
তাই রাগ না করেই বললাম, দ্যাখ, জীবন চলার পথে আমিও কত মানুষকে স্বপ্নে দেখেছি। আবার আমাকে কতজন স্বপ্নে দেখেছে। এতে কি আর যায় আসে। স্বপ্ন যদি সব সত্য হত, তাহলে মানুষ কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখার জন্যই ব্যস্ত হয়ে যেত।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৭২৮ বার পঠিত, ৬১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
" আই লাভ ইউ"
ধন্যবাদ। ভাল লাগল প্রতিযোগীতার শীষে অবস্থান করার জন্য।
খুব ভালো লেগেছে এই অংশটুকু।
আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়।
দারুন পদ্ধতি, তো ঘরেও কি রিতীমত এই থেরাপী চলে, নাকি বাহিরে গেলে।
আপনার পড়াগুলো আমি ঘরে বসে 'আইপ্যাড' দিয়ে পড়ি, তখন মন্তব্য করতে পারিনা। এখন সুযোগ হল মন্তব্য করার। চলতে থাকুক, তবে সুন্দর ও সাবলিল রচনা অবশ্যই বই আকারে প্রকাশ করবেন।
ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি আর অামার লিখা পড়ার জন্য। আসলে ব্লগে পড়তে লিখতে সিরিয়াস হতে চাই। পারিনা। এটিকে আমরা যত হাল্কা করে দেখি এমনটি ভাবা ঠিক নয়।
আপনার মক্কা মদীনা জিয়ারত নিয়ে অবশ্যই লিখবেন আশা করি। কারন এ বিষয়ে সবার অনুভুতি এক নয়।
আচ্ছা, ভালো না লাগলেও প্রশংসা করাটাকি উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ঠ হতে পারে? এটাতো "মনে একরকম মুখে অন্য রকম" নিজের বিবেককে ধোকা দেয়ার মতো মনে হলো আমার কাছে।
তবে আপনার অবিজ্ঞতাথেকে বুঝতে পারলাম যে সব গৃহিনীরাই নিজেদের রান্নার প্রশংসা'র আশায় থাকে। কিন্তু আমার মজা না লাগলে সরাসরি বলেদিই "এটাতে বোধহয় লবন কিংবা মসলা বেশ-কম হয়েছে"
ধন্যবাদ প্রাণখুলে মন্তব্য করার জন্য।
থ্যাংক এন্ড লাভ ইউ গুরুজ্বী
আপনার ইংগিতটা খুবই সোজা সাপটা হয়েছে। তবে উপসংহারের সাথে আমি একমত নই। বাস্তবতা হতে পারে কিন্তু মানুষের মানবিক আর নৈতিক শক্তি বলে তো কিছু আছে।
আবার সবাই যদি এমন ই হয় - তাহলে কেমন করে হবে।
আপনি কি বলেন।
শিক্ষক কে মেরেই ফেলল!!! তাও বুকে গুলি করে।
ধন্যবাদ।
"সব প্রশংসা তীরের মত কাজ করে। মুহুর্তেই তার কলিজায় স্থান করে নেয়ার পদ্ধতি এটি।" -সত্যি আপনি গুরু।
ভাবছি আপনি যখন বই হিসাবে এটা বের করবেন - তখন কমেন্টগুলোকে কি এমন কোনভাবে বিন্যাস করা যায় কিনা - যাতে ঐ বইয়ের পাঠক একটা ভিন্নমাত্রার উপন্যাসের আস্বাদ পাবে আর বিশ্বও এক নতুন উপন্যাসের কথা জানবে।
কে জানে এতে করে হয়তো ২ডি বা ৩ডি ভিউ উপন্যাস নামে কিছুর প্রচলন হবে।
অারে আম্নে দেখি সকল কাজের কাজী। ইংরেজীতে মনে হয় এক শব্দে উহারে কয় Panacea. কি ঠিক? কবে যে ওস্তাদের লগে সরাসরি দেখা অইবো।
মেয়েরা এমনি হয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন