রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২১)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১২ এপ্রিল, ২০১৪, ০৬:৫২:০২ সন্ধ্যা
পর্ব-২০
এখন সপ্তাহে তিন দিন যাই বিপুকে পড়াতে। কখনও কখনও তিন দিনের অধিকও হয়ে যায়। ক্লাশে গুরুত্বপুর্ন পাঠ থাকলেই এমনটি হয়। স্কুল থেকে ফোনেই ওর বাবাকে বলে দেয়, স্যার আজকে আসলে ভাল হয়।। এ ধরনের যাওয়া হঠাৎ করে হলেও মানা করতে পারিনা। স্বল্প সময়ের জন্য চলে যাই। কিন্তু এ যাওয়া এখন আর ভাল্লাগেনা। অনেকটা হাঁফিয়ে উঠেছি। ছ্রাত্রীতো জীবনে অনেক পড়ালাম। একজন আদর্শ শিক্ষকের মতই দায়ীত্ববোধের কারণে ছাত্রীর ভালবাসায় নিজে নিজে হাবুডুবু খেয়ে কল্পনায় মিছে প্রেমের পাল উড়াতে বিবেকে বাঁধা দেয়। তবুও প্রেম থেমে থাকেনা। কখন যে কোন দিক থেতে ধেয়ে আসে বুঝা মুশুকিল।
দেনা পাওনার খাতায় দর কষাকষিতে আমি আমার লাভ লোকসান নিয়েই ব্যস্ত। হিসেব কষে দেখি এখানে আয়-ব্যায় অনেকটা সমান সমান। শুধুমাত্র স্যারের আবদার রক্ষার্থে আসা-যাওয়া।
বিপুকে পড়াতে গিয়ে আমাকে কিছুটা ছাড়ও দিতে হয়েছে। আগে দুপুরে লাঞ্চের জন্য বাসা থেকে খাওয়া নিয়ে আসতাম। আমি ডাল-ভাতে অভ্যস্ত মানুষ। হোটেলের খাওয়া একেবারেই পছন্দ করিনা। পেছনের দরজায় তৈরী করা সুস্বাদু খাওয়া প্রস্তুতকারী কর্মচারীদের অবস্থার কথা মনে পড়লে চোয়াল দুটো বন্ধ হয়ে আসে। উগলে বমি আসতে চায়। বাথরুম থেকে আসা অপরিস্কার হাতে ঘেটে ঘুটে খাওয়া বন্টনের পদ্ধতি আর ঘর্মাক্ত মুখ থেকে লবন পানির ফোঁটা টুপ করে পাতিলের উপর পড়ার দৃশ্যটি মনে হলে
খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলী।
অন্যদিকে ভাতের বিকল্প রুটি খাওয়াও আমার একদম অপছন্দ। ভাত খেয়ে বড় হওয়ার কারণে হয়তবা - রুটির পরিবর্তে ভাত খাওয়াটা যেন অনেকটা ভাতের সাথে বেয়াদবী মনে হয়! এটি আমার সাইকোলজিক্যাল ভাবনা। তবুও আমি এমন।
যাইহোক, টিফিন বক্স হাতে নিয়ে ম্যানেজারের বাসায় যাওয়াটা দারুণভাবে প্রেস্টিজে লাগে। না জানি আবার মনে করে, স্যার আনস্মার্ট। তাই এটি বাদ দিয়েছি। এ ব্যাপারে অফিসের প্রদীপ বাবু খুবই সিরিয়াস। ওর ভাষায়, আপনার ভাবীর হাতের পাক অফিসে বসে খাওয়ার সময়ও মনে হয় যে, ওর (স্ত্রীর) ভালবাসা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছি। এটির অনূভুতিও আলাদা। দ্বিতীয়ত নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে হোটেলের বাসি খাওয়া জোর করে পেটে পাঠানোর দরকারই বা কি? বরং এতে খাওয়ার নামে পয়সা দিয়ে রোগ কেনা হয়।
চাকুরীতে যোগ দেয়ার প্রথম দিকে প্রেস্টিজের কারণে হোটেলেই লাঞ্চ সেরে নিতাম। কিন্তু প্রদীপ বাবুর স্বাস্থ্য সম্মত যুক্তিটা খুব মনে পুত হওয়াতে নিজেও টিফিন বক্সে খাওয়া নিয়ে আসা শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর বাসের ভেতর ঘটে যাওয়া একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনায় এটিও অনিয়মিত হয়ে পড়ল।
আমার উপরি নামের কোন আয় নেই। তাই সব সময় পকেট ভর্তি টাকাও থাকেনা। পকেটের উপর নির্ভর করেই বাস- রিক্সা দুটো করেই অফিসে আসতে হত। বাসে আসার জন্য আগ্রাবাদ মাদার্য পাড়া হতে টেম্পুতে দেওয়ান হাট পর্যন্ত এসে বাকী পথ বাসেই আসতাম। সব সময় বাসে সিট পেতামনা। তাই উপরের রড ধরে টিফিন বক্স হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। বাসে উঠলেই হাতে ঝুলানো টিফিন বক্স নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় থাকতাম। কারণ বক্সের ভেতর ডাল নাড়ার শব্দ। না জানি কার ধাক্কা লেগে..। কিন্তু আমার যে ডাল ছাড়া খাওয়া চলেনা। ডালের থৈ থৈ পানিতে ভাত থেকে খুব মজা লাগে। গরম ভাতে পান্তা ভাতের মজা নেয়ার মত!
অন্য এক দিনের কথা। বাসের রড ধরে ঝূলে আছি। হঠাৎ ভাড়া নিয়ে এক যাত্রীর সাথে ধাক্কা ধাক্কি লেগে গেল। তারপর শুরু ধস্তাধস্তির পর মারামারি। একহাতে ডাল। অন্য হাতে রডে বন্দী হাত। কি করি! ঠেলা সামলাতে না পেরে কয়েকবারই কাত হয়ে পড়ার উপক্রম হলাম। আবার সোজা হয়ে গেলাম। অবশেষে ডালের দিকে চোখ পড়ল। তাকিয়ে দেখি পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের সাদা পেন্টটিতে হলুদ কালার দিয়ে সদ্য রং করা চিত্রটি আমার ডাল দিয়ে করার মত মনে হল। বিদ্যুতের গতিতে নিজের বক্সের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গেলাম। সর্বনাশ! এটিতো আমার টিফিন বক্স থেকে পড়া হলুদ মিশ্রীত ডালের স্প্রে করা তাজা রং!
মুহুতেই গলাটা শুকিয়ে গেল। ধরা পড়লে ঠুসি একটিও মাটিতে পড়বেনা। ক্ষনিক সময়ের জন্য বাসে ছড়া যাত্রীদের হৃদয়ে কোন দয়া-মায়া নেই। তাছাড়া হুজুগে বাঙ্গালী বলতে কথা। আর মার যদি কোনরকম একবার শুরু হয়ে যায়, তাহলে যে জীবনে একটি মাছিও মারেনি সেও আসতে মারতে। মারের তীব্রতা অনুভব করে আমি অলিম্পিক দৌড়ের কথা মনে করলাম। এক সেকেন্ডও লাগেনি। আমি বাসের দরজায় গিয়ে উপস্থিত। বাস থেকে নামার ভঙ্গীতে এক পা সামনে এগিয়ে দিয়ে খুব গুরুত্বের সাথেই হেলপারকে বললাম, ভাই, আমি এখানেই নামবো প্লীজ।
এরপর লেংটা বক্সটি ফেলে দিয়ে ইন্ডিয়ান টিফিন বক্স কিনলাম। এটি ধাক্কা ধাক্কিতে সমস্যা হয়না। তাছাড়া বক্স থেকে ডাল পড়ে গেলেও খাওয়া যায়। কিন্তু ম্যানেজারের বাসায় এটি কাঁধে নিয়ে যেতে কেমন জানি আন স্মার্ট লাগে। পাচে লোকে যাই বলুক, নিজের আত্মতৃপ্তি বলতে কথা। তাই টিউশনিতে যাওয়া সপ্তাহের তিন দিনের সিডিউল থেকে এটিও বাদ দিলাম।
সময়, প্রেস্টিজ, অতৃপ্ত মন, বাসায় গিয়ে অন্যদের সাথে আড্ডার লোভ সব কিছু মিলিয়ে বিপুকে পড়ানোর ইচ্ছেটা অনেকটা হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু মানা করার মত পরিস্থিতিও নেই। বিপুকে পড়ানোর কারণে আমার সাথে ম্যানেজারের ব্যবহার, সৌজন্যতাবোদ, বিলম্বে হাজিরা, প্রয়োজনে অবেলায় বাহীরে যাওয়া ইত্যাদির জন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয়না। সবকিছু মিলিয়ে অফিসে আমার অবস্থান অনেকটা দড়ি ছাড়া গাইয়ের মত।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৬৯৭ বার পঠিত, ৬৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাক এবার ব্যাংক থেকে যে একটু গুরু-শিষ্যের দিকে এগিয়েছেন তাও ভালো।
তবে সেসময় তোর রিকশা ভাড়া কমই ছিল আপনি মনে হয় আগ্রাবাদ চেীমুহনি দিয়ে কদমতলি ক্রসিং হয়ে গেলে কম খরচে ও সময়এ পেীছে যেতেন্।
খুব করে মনে পড়ে গেল, ছোটকালে অন্যদের মতো সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখতে না যাওয়ার পক্ষে সুন্দর করে তুলে ধরা আমার যুক্তিটা- "নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সিনেমা দেখার কোন মানে নেই, টাকা দিয়ে গুনাহ কামাইয়ের দরকার আছে নাকি, এমনিতেই তো কত গুনাহ হয়ে যায় দিনভর", তার চাইতে চল ঐ টাকায় আইসক্রীম কিনে খাই।
তোমরা যদি দেখতে যাও
বড় লোকের ঘরে
দেখবে সেথায় বিলাই কুত্তা
সবাই ক্ষুধায় মরে।
দ্বিতীয়ত ব্যাংক হতে দুটোয় বের হলে, বাসায় যেতে যেতে এক ঘনটা লাগত। তখন বৈকালীন নাস্তার সময় হত। ধন্যবাদ।
কর্পোরেট অফিসের চাকুরির চেয়ে বুঝি ব্যক্তি মালিকানার চাকুরি অনেকটা ভাল.....
অফিসের হক আদায় করতে না পারলে শেয়ার হোল্ডার সবার থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া কঠিন। কিন্তু ব্যাক্তি মালিকানার প্রতিস্ঠানে ব্যাক্তির কাছে মাপ চেয়ে নেওয়া সহজ।
অপেক্ষায় আছি। পরের পর্বে নিশ্চয়ই বিপুদের বাসা হতে খাবার আসবে।
দেখতে যাবে তোমরা সবাই
বড় লোকের ঘরে,
যেয়ে দেখ কুত্তা বিলাই
সবাই ক্ষুধায় মরে।
গড্ডালিকায় কিপ্টার আড্ডা
নেইকো রহমত
নিত্য হেথায় কাজের মেয়ে
দি্চেছ নাকে খত।
মুষ্ঠি হাতে চুল টেনে কয়
গয়না গেল কৈ
খোজ দে আজি মারবো না হয়
ছাড়ার পাত্র নই।
ম্যাডাম আমি জানিনাতো
মারছ কেন মিছে,
দাও ছেড়ে নয় মার মোরে
সিসি ভরা বিষে।
আগুন চেকায় কাদে অবুঝ
বড়ই পাষান মন,
টাকার নেশায় বড়ই পাগল
হৃদয়ও ঠন ঠন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন