রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-২০)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ০৭ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৪৩:৫৪ সকাল
পর্ব-১৯
ব্যাংকের জটবাঁধা প্রমোশনের জটিলতা দির্ঘ দিনের। সিনিয়র ক্লার্কে বিনা বাঁধায় প্রমোশনটা হওয়ার পরই শূরু হয় অফিসার হওয়ার স্বপ্ন। আর এ পদোন্নতিটা একজন মানুষকে এক ধাক্কায় ম্যানেজমেন্ট লেভেলে পৌছে দেয় বলেই এ স্বপ্ন সবার। একজন ক্লার্ক অফিসারে পদোন্নতি হওয়ার পর পদাধিকার বলেই অনেকগুলো সুযোগ সুবিধা পেতে শুরু করে। এর পাশাপাশি ক্ষমতাটাও অনেকগুন বেড়ে যায়। সর্বোপরি কর্মচারীদের তোতা পাখির মত ডাকা স্যার শব্দটি শুনতে কি যে ভাল লাগে। আহ! তাই এটি পাবার জন্য কল্পনার মাঝে সবাই স্বপ্নের জাল বুনতে মরিয়া। ব্যাংকে এ পদোন্নতি নিয়ে সিনিয়ার বনাম জুনিয়ার ক্লার্কদের প্রতিযোগীতাটা সর্বজন বিদিত। আর এ প্রতিযোগীতায় সিনিয়রদেরকে ফেনাল্টি গোলে হারিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য প্রচেষ্টাটা জুনিয়রদের মাঝে বেশী লক্ষ্য করা যায়। এ জন্য পর্দার অন্তরালে ম্যানেজারদেরকে তেল মারার হিড়িকটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ধরনের। এতে ম্যানেজাদেরও বিনামুল্যে সম্মানবোধটা অনেক বেড়ে যায়। মনের অজান্তেই হাজারো সুযোগ সুবিধা পাওয়া শুরু হয়ে যায়। আর এ সুবিধা শুধু ম্যানেজার একাই পায়না। সাথে বাড়তি সুবিধা হিসেবে তার পরিবারের সদস্যরাও ভোগ করে।
আমি ব্যাংকের ঢুকার কিছুদিন পর এ ব্যাংকে সিনিয়র ক্লার্ক আলী সাহেব ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন। একজন মানুষের হৃদয়কে সহজে জয় করার কৌশলটা আলী সাহেব ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন। আর সম্ভবত এ গুনটির কারণেই অল্পদিনের মধ্যেই সিনিয়র ক্লার্ক উষা দেবীর সাথে ভালবাসার জাল বুনতে বুনতে তৈরী করেছিলেন ঈর্ষনীয় কল্প কাহিনী। উষা দেবীর মত স্বল্পভাসী একজন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী মহিলার হৃদয় মন্দিরে ভালবাসার পালতোলার দৃশ্যে সবাই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে। ব্যাংকে প্রথমবারের মত ঘটে যাওয়া ভালবাসার এ অনবদ্য কাহিনী দারোয়ান থেকে শুরু করে অফিসার ম্যানেজার সবার মুখে মুখে থাকতো। কাজের ফাঁকে ফিস ফিস করে গুরুত্ব সহকারে জড়িয়ে পড়তো প্রেম রসের আলোচনায়। আহ। কি মজা সেই রসভর্তি পরিপক্ক ভালবাসার গল্পে। তাও কর্মক্ষেত্রে! সভ্যতা বিকাশে পুরুষ মহিলা একসাথে কাজ করার যে কি মজা, পাশাপাশি কাজ করা লোভতুর লোকগুলো হাঁড়ে হাঁড়ে টের পায়। কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে উঠা একজন পুরুষ যদি পাশে বসা মহিলার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে কিছুটা তৃপ্তি পায়, এতেই বা মন্দ কিসে?
আলী সাহেব দেখতে কিছুটা লম্বা হলেও গায়ের রংটা একেবারেই মন্দা। রুপের দিক থেকে পাশের মার্কের অনেক নিচে। কিন্তু তার রসিকতা, কথা বলার কৌশল, ক্ষনিকের মধ্যে কারো মুখে হাসির খৈ ফুটানো, এসব গুণগুলো তাকে সবার মাঝে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিতে বেশীদিন সময় লাগেনি। এজন্য ম্যানেজারের কাছের মানুষদের লিষ্টেও তিনি নামটা অতি দ্রুত লিখতে পেরেছিলেন।
চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে স্যারকে টাকা দিয়ে আসা, মিছে কোন বাহানায় স্যারকে ফ্যামেলী সহ ভাল হোটেলে আপ্যয়ন। সামান্য কথার ছলে রসিকতা করে স্যারের পেটে হাসির খিল ধরিয়ে দেয়া..। এসবের কারণে স্যারও তাকে খুব পছন্দ করা শুরু করলেন। আর তাই, এ শাখায় বদলী হয়ে আসার এক বছরের মাথায় অপেক্ষাকৃত জুনিয়র হয়েও সোনার হরিণ নামের অফিসার পদের প্রমোশনটা নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন আলী সাহেব! অবিশ্বাস্য এ কাজটিতে অনেকের বিশ্বাসের মাঝেও ফাটল ধরিয়ে দিলেন। আলী সাহেবের এ প্রমোশন সবার মাঝে আলোচনার ঝড় তুলে দিয়েছিল। আবার অনেকেই রাগে ক্ষোভে বলতে শুরু করলেন, শালার, আলী সাহেব মনে হয় ম্যানেজারকে তাবিজ করেছে। আমরা এত বছর চেষ্টা করেও পারলামনা । আর সে নাকি না আসতেই.....।
বেশি দিন হয়নি, হেড অফিস থেকে অডিটের একটা টিম এসেছিল। কোন এক দুপুরে কর্মবিরতির ফাঁকে সবাই আডডায় বসল। হেড অফিস থেকে আসা এসব লোকদের সাথে অনেকেই যেঁচে পরিচিত হতে চায়। শত হলেও হেড অফিস বলতে কথা! এটিও আত্মতৃপ্তির জন্য এক ধরণের মিছে মাখামাখি বৈ কিছুই নয়। মানুষের মনতো!
আড্ডাটা অনেক জমে উঠেছে। আড্ডার আলোচ্য বিষয় ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম। আর এ অনিয়মের মাঝে প্রমোশনের জটিলতাটিও উঠে আসল। সুযোগ করে প্রদীপ বাবু আলোচনার ফ্লোরটা হাতে নিয়ে নিলেন। বলতে লাগল,
- স্যার বুঝেনতো। এ ব্যাংকে শূরু থেকে আছি বলেই যেতে মন চায়না। একটা পরিমন্ডল তৈরী হওয়ার কারণেই এটিকে ঘিরেই এখন সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে। বন্ধুদের অনেকেই প্রাইভেট ব্যাংকে অফিসার রেংকে চাকুরী নিয়ে চলে গিয়েছে। আমি ও সুযোগ পেয়েছিলাম কয়েকবার। কিন্তু যাইনি।
- কেন? একজন সিনিয়র অডিটর প্রশ্ন করল।
- বুঝেনতো। এখানে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসছি। সবকিছু নিজের মতই হয়ে উঠেছে। ভাবছি, শত হলেও প্রাইভেট ব্যাংক। বেশী খেতে গিয়ে না জানি আবার কোন বিপদে পড়ি। আর সব চেয়ে বড় কথা হল, অনেকদিন থেকে সিনিয়র ক্লার্ক হয়ে বসে আছি। প্রতিবারেই প্রমোশনটা পেয়ে যাবো, এমন আশ্বস্ততায় আশায় বুক বেঁধে বসে আছি। কিন্তু আজ এতগুলো বছর হয়ে গেলো, সোনার হরিণের মতই অফিসার নামের সেই চেয়ারটি আজও পাওয়া হলনা। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
সিনিয়র অডিটর মুচকি হাসি দিয়ে বলতে লাগল, দ্যাখেন প্রদীপ বাবু। আমি আপনাকে নিরেট একটা সত্য কথা বলি। আমি হেড অফিসের অডিট টীমে দির্ঘদিন থেকে কাজ করে আসার কারণে অনেক শাখায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। ম্যানেজমেন্টের রগ-রেশা সবই চিনি। তাই, মনে কষ্ট পেলেও আপনাকে একটা অতীব সত্য কথা আজ বলে যাই।
- বলেন স্যার। আমাদেরও জানা হল, প্রদীপ বাবু জানতে চাইল।
- অফিসার হওয়ার সখ প্রতিটি ব্যাংক কর্মচারীরর। আর এটির জন্য এত প্রতিযোগীতা যে, পর্দার অন্তরালে অভিনীত বিভিন্ন কর্মচারীদের তেল মারার কাজটি যে যত বেশী নিপুনভাবে করতে পারে, সে ততটা এগিয়ে। সেদিক থেকে দির্ঘদিন আপনার প্রমোশনটা না হওয়া মানেই হল অভিনয়টা এখনও কাঙ্খিত মানের নয়। মানে পাশ মার্ক পাওয়ার মত নয়। কাজেই আমার পরামর্শ হল, আপনার মত যারাই ব্যাংকে সিনিয়র ক্লার্ক হয়ে দির্ঘদিন থেকে প্রমোশনের অপেক্ষায় অফিসার পদের চেয়ারটির জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে, এ অপেক্ষাটকু আর না করে অন্তত আত্মতৃপ্তির জন্য হলেও নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে একটি চেয়ার কিনে নিজের বাসায় বসে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারেন। এতে অন্তত নিজেকে বুঝানো যাবে যে, ব্যাংকে আমাকে চেয়ার না দিলেও আমি নিজের কেনা চেয়ারেতো বসছি। জীবন চলার পথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য এমন অনেক কিছুই করতে হয়, যা খুব জরুরী। আর প্রমোশনের এ বিষয়টি এখন এতটাই জটিল হয়েছে যে, আমার মনে হয় এটির আশা আর না করাই উত্তম। কারণ, ইদানীং উচ্চ শিক্ষিত ছেলেদের ইন্টারভিউর মাধ্যমে জুনিয়র অফিসার হিসেবে ব্যাংকে নিয়োগের কারণে ইন্টানাল পদোন্নতিটাও নীতিগতভাবে কমিয়ে দিয়েছে। তার কারণ, কোন এক সময়ে শুধু মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা লোকদের অনেকেই আজ অফিসার পদের জন্য পদপ্রার্থী। এদেরকে প্রমোশন দিয়ে ব্যাংক কাঙ্খিত ফলাফল পায়না বলেই নতুনভাবে জনিয়র অফিসার নিয়োগের পদ্ধতিটি চালু করেছে।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
২০১৮ বার পঠিত, ৫০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
:D/
কথাটা সত্য। কিন্তু তৃপ্তির সাথে পরবর্তীতে যে কাজ গুলো হয়। সংসারে ধ্বংস ডেকে আনার জন্য সভ্যতার এই বড় অবদানটা আপনার মত এত উচুমানের লিখায় আশা করি।
গড়ে উঠে মহাদেশ সাগর অতল।
ঊষা দেবী কে করা হাল্কা রসিকতা কে যদি উনি প্রশ্রয় না দিতেন তবে উনার মনের দেয়াল ভাঙ্গা সম্ভব হত না।
এভাবেই টিজিং এর উৎপত্তি হয়।
এভাবেই সুপ্ত কামনা বাসনা জাগে মনে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন