রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-১৮)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ৩১ মার্চ, ২০১৪, ০৪:৫৮:৪১ রাত
পর্ব-১৭
ব্যাংকে প্রমোশনটা একটা জটিল বিষয়। অনেক উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সবা্ই জুনিয়র হতে সিনিয়র ক্লার্ক হয়ে যায়। কিন্তু সিনিয়র ক্লার্ক হতে অফিসার হওয়াটা যেন অলীক স্বপ্ন। এ ধাপটি পার হওয়া অনেক কঠিন। এখানে এসেই অফিসার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অনেককে বছরের পর বছর প্রতিযোগীতায় লেগে থাকতে হয়। কর্মে কঠিন পরিশ্রম করেও এটি হাসিল করা যায়না। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় দিতে হয়। আর এ পরীক্ষায় একশতে একশত পাবার পরও নিশ্চয়তা থাকেনা অফিসার হওয়ার। আর এ প্রাকটিকেল পরীক্ষাটির নাম হল - তেল। একবার এক নাটকে দেখেছিলাম, প্রমোশনের জন্য শাখার কর্মচারীদের তোষামোদের শেষ নেই। অবশেষে ম্যানেজার বদলী হয়ে যাবার সময় সবাইকে ভারাক্রান্ত মনে বলল, আমিতো সবাইকে খূশী করা সম্ভব নয়। অথচ আপনাদের সবাইকে প্রমোশন দিয়ে খুশী করাটা সময়ের দাবী। আর এ জন্য আপনারা সবাই আমাকে এত তেল মেরেছেন যে, আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্ত বিনিময়ে কিছু দিতে পারিনি বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে খূশীর বিষয় হল, এতদিনতো আপনারা তেল মারার জন্য অনেক পয়সা খরচ করেছেন। এখন বেশী পয়সা খরচ করতে হবেনা। কারণ বাংলাদেশের হরিপুরে তেলের খনি আবিস্কৃত হয়েছে। এ তেল নিজেরা ব্যবহার করে আমরা বিদেশেও রপ্তানী করতে পারব।
চাকুরী মানেই একটু ভাল বেতন। সাথে সাথে ভাল একটা অবস্থান। কর্মস্থলে অফিসার পদোন্নতিটা অনেকটা মর্যাদার ও বিষয় বটে। তাই ব্যাংকের সিনিয়র ক্লার্কদের মাঝে এ নিয়ে প্রতিযোগীতার পাশাপাশি চরম হতাশাও লক্ষ্য করা যায়। প্রমোশনের এ প্রতিযোগীতার সুবাধে ব্যাংকের প্রতিটি শাখা ব্যবস্থাপক কড়ায় গন্ডায় কর্মচারীদের থেকে বিভিন্ন ভাবে সুযোগ সুবিধা নিয়ে থাকে।
অফিসের বয়োজোষ্ঠ সিনিয়র ক্লার্ক ক্যাশিয়ার আহমদুল্লাহ অনেকটা আদু ভাইয়ের মত। আশাহত একজন মানুষ। মেয়ে বড় হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে। প্রমোশনটা হলে মেয়ের বিয়েটা একটু ভাল দিতে পারতো। বর পক্ষ বলতো, আহ। মেয়ের বাবা ব্যাংকের অফিসার! ছেলের বাবার মুখটাও উজ্জল হত একজন ব্যাংক অফিসারের মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের কথোপকথনে বুক ফুলিয়ে কন্যা দায়গ্রস্থ বাবা বলত, আমি ব্যাংকের অফিসার। কিন্তু আজ এতটা বছর হয়ে গেল প্রমোশনটা....।চায়ের দোকানে বসে এসব কথাগুলো অনেক আক্ষেপের সাথেই আহমাদুল্লাহ সাহেব আমাকে বললেন। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বেচারার জন্য মায়া হল। নিজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললা, মজুমদার সাহেব, আপনার কপালেও এমন দুঃখ ধেয়ে আসছে।
এ শাখায় নতুন কোন সিনিয়র ষ্টাফ আসলেই পুরোনোদের কলিজায় আর পানি থাকেনা। ভাবে, আহ। এ বুঝি আর একজন অফিসার পদে পদপ্রাথী প্রতিযোগী এসে গেল। না জানি ম্যানেজারের সাথে সখ্যতাটা বেশী হওয়ার কারণে আমাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।
এখানে যোগ্যতার চেয়ে জী হুজুরের অভিনয়ে যত তৈল মর্দন করা যায় এতেই ম্যানেজার সাহেব খূশী। সেকান্দর সাহেব, রবি সাহেব ম্যানেজারের সাথে সঙ্গোপনে একটা গভীর সম্পর্ক রেখে চলেছেন। কেউ না দেখলেও স্যারের মেয়েকে পড়ানোর সুবাদে আমার দৃস্টিগোচর হয়েছে। দুজনকে ম্যানেজারের বাসায় দেখার কারণে আমার হাত ধরে একে অন্যর পেছনে একটাই অনুরোধ করল - " মজুদার সাহেব। প্লীজ বিষয়টা কাউকে বলবেন না। বুঝেনতো। প্রমোশনটা খুব দরকার। স্যারের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক গভীর করার চেস্টা করছি। দেখি কি হয়। স্যারতো আশা দিয়েছে। এবার হয়তবা প্রমোশনটা হয়ে যেতে পারে। এইত সেদিন ম্যানেজারের বাসায় গিয়েছিলাম। আপনার ভাবী একান্ত আলোচনায় ম্যানেজারের স্ত্রীর হাত ধরে বলেই ফেলেছে, স্যার যদি আমার স্বামীর প্রমোশনটা এবার দিয়ে দেয়। আপনি যদি একটু.....। ভাবী রাজী হয়েছে। আশ্বস্ত করেছে, চিন্তা করবেন না। আমি বিষয়টা অবশ্যই দেখব।
এইতো সেদিন সেকান্দর সাহেবের সাথে ম্যানেজারের বাসার গেইটে দেখা। রিক্সা থেকে্ নামনেই আমি সামনে পড়লাম। আমাকে দেখে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
বিপুকে পড়িয়ে বের হচ্ছিলাম মাত্র। দেখে জানতে চাইলাম
- অ্যারে। সেকান্দর সাহেব। কি কোন কাজে এসেছেন?
- হুম। কাজে আসছি। দেখেন না। রিক্সায় চাউলের বস্তা। স্যারের বাসার বাজার সদাই অনেক সময় আমাকেই করতে হয়। বুঝেনতো। স্যার মানুষ। আমার উপর স্পেশাল আবদার। তাই মানা করতে পারিনা। স্যারের স্ত্রী আমাকে খুব ভাল জানে। অনেকটা নিজের মত। স্যারের স্ত্রী ও আপনার ভাবীকে একেবারে ছোট বোনের মত আদর করে। আসলে না খেয়ে যেতে দেয় না।
স্যার ব্যস্ততার কারণে বাসার বাজার সওদার দিকে খেয়াল দিতে পারেনা। আর এসব করার সময়ও নেই। তাই..। বুঝেনতো। দেখি একটু তেল মেরে প্রমোশনটা নেয়া যায় কিনা। অনেক দিন হল, সিনিয়ার ক্লার্ক হয়েছি। আর ভাল লাগেনা। এবার একটা পরিবর্তন দরকার।
সবাই এটা বুঝে যে, স্যারের স্ত্রীকে হাত করতে পারলেই সব কিছু সহজ হয়ে যাবে। তাই অফিস শেষে বিভিন্ন উসিলায় ম্যানেজারের বাসায় যাবার হিড়িক পড়ে। যাওয়ার সময় অনেকেই বিভিন্ন ফল মুল কিংবা বড় একটা বোয়াল মাছসহ লোভনীয় দ্রব্য নিয়ে স্যারের বাসায় হাজির হয়। খোশ মেজাকে স্যার জিজ্জেস করে, কি ব্যাপার। ঘরোয়ায় আলোচনার ফাকে প্রমোশনের একটু আশ্বাস সুরের মুখে শুনতে দারুণ তৃপ্তি।
ব্যাংকে যোগ দিয়েছি ছয় মাস হল। শূরু হয়েছে জুন ক্লোজিং। অর্ধ বাৎসরিক হিসাব নিকাশ। জুন ক্লোজিং এর সময় কাজ করে অফিস থেকে বিলম্বে বাসায় ফিরতে হয়। রাতের খাওয়া ব্যাংক আয়োজন করে থাকে। সর্বশেষ দিন অথ্যাত ত্রিশ এ জুন বড় মক্কেলরাই খাওয়া সরবরাহ করে থাকে। এবারের ক্লোজিং এ ব্যাংকে বিরিয়ানী পাঠিয়েছি হাজী রমজু মিয়া। রিয়াজুদ্দীন বাজারের অনেক বড় আড়তদার। ফল ব্যাবসায়ী।
আজ সবাই খূশী। ক্লোজিং শেষ।আগামী কাল থেকে ব্যাংক দুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে। এ উপলক্ষ্যে ব্যাংকে অনেক বড় আয়োজন চলছে।
রাত আট টা বাজে। ম্যানেজার সেকান্দর সাহেবকে ডেকে বলছে,
- জোনাল ইনচার্জ ইউনুস স্যারকে কি দুটো বিরিয়ানীর প্যাকেট দিয়ে আসতে পারবেন?
ব্যাংকের কয়েকটি শাখা মিলে একটি জোন হয়। আমাদের জোনের হেড অফিস চট্রগ্রাম মিমি সুপার মাকেটে। এ জোনের প্রধান এজিএম ইউনুস সাহেব। ম্যানেজারদের ট্রান্সফার কিংবা প্রমোশনের দায়ীত্বটা জোনাল ইনচার্জের হাতে। তাই ম্যানেজার সাহেব ও তাকে সিরিয়াসলি সমীহ করে চলেন। সময় মত তেল মারতেও দ্বিধাবোধ করেন না। স্যারের সাথে ফোনে কথা বলার সময় মনের অজান্তেই দাড়িয়ে যান। মনে হয় যেন স্যার তাকে দেখছে।
আজ অন্যান্য শাখার মত আমাদের শাখায়ও পার্টি হচ্ছে। তাই এজিএমকে আগেই ফোন করে ম্যানেজার বলে দিয়েছে, স্যার আপনার জন্য বিরিয়ানী পাঠাচ্ছি। স্যার বিরিয়ানীর জন্য অপেক্ষা করছে।
সেকান্দর সাহেবকে জোনাল অফিসে বিরিয়ানী নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিতে লাফিয়ে উঠল। খূশীতে একেবারে আটখানা। ভাবছে, যাক। অনেক দিন পর এক উচিলায় এজিএম স্যারের সাথে দেখা হবে। ভাগ্যটা বড় সুপ্রসন্ন। এটাই সুযোগ। স্যার অফিসে একা বসে আছেন। আমি বিরিয়ানীর প্যাকেট নিয়ে সালাম দিয়ে স্যারের রুমে ঢুকতেই নিশ্চয়ই আমাকে জিজ্ঞেস করবে
- কি সেকান্দর। আপনি কেমন আছেন?
- কথোপ কথনের ফাঁকে স্যারকে প্রমোশনের কথাটা বলেই ফেলবো।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৭৮০ বার পঠিত, ৭৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার দ্বারা প্রমোশন পাওয়া সম্ভব হতো না ভাই!!!!
হাতে রাখবেন তেলের শিশি।
মাখিবেন দিবানিশি,
তাতেই হবেন বস খুশি।
প্রধান মন্ত্রীকে সবাই
সারাদিন মারে তেল,
কম বেশি হলে তবে
মন্ত্রী হয়ে গেল ফেল।
ঘরে বাইরে উচু নীচু
তলে তলে মারে তেল
তেল ছাড়া সব ফাঁকে
যোগ্যতাও মারে ফেল।
খুব ভাল লাগছে চলতে থাকুক............
আমি প্রমোশন চাই না রে ভাই!
মান ইজ্জত আর সম্ভ্রম বাচাতে চাই।
আমি তৈল মর্দনে অভ্যস্ত না রে ভাই
তৈলের ডিব্বা যে আমার কাছে নাই।
পার্থিব জস খ্যাতি আমিও চাই
মাগার
পারলৌকিক পাথেয় সংগ্রহে ভাটা দিতে নাই।
কত স্বপ্ন দেখেছি কত ছবি একেছি শুধু প্রমোশন নিয়ে শুধু প্রমোশন নিয়ে....। Click this linkপথ শিশু.......... আহা......।
কাটে যাদের জীবন খেলায়
কুড়িযে নিয়ে পায়না খেতে
...
ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ আমাদের এই সুযোগ করে দেয়ার জননো।
তুমি তাহা বলে বেড়াও....।
ধন্যবাদ। আমি জানিনা কত ভাল লিখি । তবে এতটুকু বুঝি যে, যাহা লিখি তাহা তুলনামুলকভাবে অনেক পিছিয়ে। মনে হয় আরও ২-৪ বছর লিখতে হবে। আমরা হলাম হুযোগের লেখক। দেয়ালিকা বের হবে তা্ই লিখি। ম্যাগাজিনে আমার নাম আসবে. .ইত্যাদি।
আজ আমাদের সমাজের যে চিত্র তুলে এনেছেন। তার সমুহ কারণ গুলোর মধ্যে একটি হল - আমরা অতিরিক্ত সেকুলার হয়ে যাচ্ছি।
রাজারে রানী
ম্যানেজারের বউ!!
প্লাষ্টিকের ফূল দাও
নইলে কাগজের ফূল
হেগেনে বেশীদিন লাস্টিং করে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন