রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-৯)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৭ মার্চ, ২০১৪, ০৭:৫৪:১৬ সন্ধ্যা
পর্ব-৮
মধ্যাহ্ন ভোজের কর্মবিরতির এক ফাঁকে সেকান্দর সাহেবকে ডেকে বললাম
- আপনার সাথে একটু কথা ছিল।
- কি বিষয়ে?
- সারের বাসায় আমার যাওয়া নিয়ে।
- বলুন। অসুবিধে নেই। এখন ফ্রি আছি।
আমার সুবিধা-অসুবিধের বিস্তারিত সেকান্দর সাহেবকে খূলে বললাম। শুনতেই তিনি সমর্থন দিয়ে দিলেন। বললেন, আমি আপনার সাথে আছি। এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। ভাল কথা মনে করেছেন। আরে.. নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে স্যারের মেয়েকে পড়ানোর দরকারই বা কি? মাথা খারাপ নাকি? আপনি যে মেয়েটাকে পড়াতে যান এটাইতো যথেষ্ট। স্যারতো আপনার জন্য গাড়ী ভাড়া করা উচিত। আপনার পড়া নিয়ে স্যার একেবারে মহাখূশী। তাহলে দেবেনা কেন? অপেক্ষা করুন। আমি বিষয়টা নিয়ে স্যারের সাথে আজ না হয় কাল অবশ্যই কথা বলব।
- স্যার যাতে আবার কিছু মনে না করে। আমি অনুরুধ করলাম।
- দু্ত্তরী। স্যারকি আপনাকে বাপের টাকা দিবে? আপনাকে যা দিবে সবই ব্যাংকের টাকা।
- মানে?
- মানে আর কি? দেখেন না। প্রত্যোকদিন অফিস থেকে যাবার সময় স্যার কি করে? পিটি ক্যাশ ভাউচার দিয়ে ক্যাশিয়ার থেকে প্রতিদিন ৫০/১০০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়?
- ওটা কিসের টাকা?
- ঐটা আমাদের টাকা। ব্যাংকের অফিস ষ্টাফ কিংবা কাষ্টমারদের চা নাস্তা বাবদ বাজেটের টাকা। ঐটা আমাদেরকে না দিয়ে স্যার ফ্যামেলির বাজার খরচ চালায়। আর আমরা কাষ্টমারের পকেটের টাকা দিয়ে চা নাস্তা খেতে হয়।
আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, খায়ের স্যারের ঘূষ খাওয়া নিয়ে এত অভিযোগ করা হল। কিন্তু স্যার কোন এ্যাকশনই নেন না। আমরা কি এসব বুঝিনা? মুল কারণ হল, খায়ের সাহেব এ টাকা থেকে স্যারকে ও কমিশন দেয়।
- তাই নাকি?
- নতুন এসেছেন তো। এসবের শানে-নুযুল বুঝতে একটু সময় লাগবে। তবে বুঝতে বেশীদিন সময় লাগবেনা।
সেকান্দর সাহেব বলতে লাগলেন - শালার, পুরো দেশটাই যেন চোরের খনি। ঘূষখোরে একেবারে ভরে গেছে। কোথায় গিয়ে যে বিচার দেবো বুঝে উঠতে পারছিনা। ব্যাংক তার কর্মচারীদের ষ্টাফ হাউজিং লোনটা চালু করে মনে হয় ঘূষের পথটা আরও সুগম করে দিয়েছে। ব্যাংক মানেই মনে হয় লুটেরাদের আড্ডাখানা। সিন্ডিকেট চোরের খনি। ব্যাংক কর্মকর্তা - কর্মচারী - কাষ্টমার সবাই যেন লুটে খেতে মহাব্যাস্ত। মাঝখানে আমাদের মত মধ্যবিত্তের লোকগুলো আছি বিপাকে।
- ষ্টাফ হাউজিং লোনের সমস্যাটা কোথায়? এটিতো আপনাদের স্বার্থেই দিয়ে থাকে।
- দেখেন মজুমদার সাহেব। মনে করুন ব্যাংক আমাকে ৩ লাখ টাকা হাউজিং লোন দিয়েছে। আমি জায়গা কিনলাম ৩ কাঠা। এটার উপর বিল্ডিং করার জন্য বাকী টাকা কোথা থেকে এনেছি ব্যাংক কি খোজ খবর রাখে? যে লোকটা মাসিক বেতন দিয়ে তার ষ্টাটার্স রক্ষা করতে পারেনা, তাকে হাউজিং লোন দেয়ার পর মাসিক বেতন থেকে লোনের টাকা কেটে নেয়ার পর কিভাবে তার সংসার চালায় ব্যাংক কি খবর রাখে?
তাহলে তার মানেটা কি দাড়ালো? নিশ্চয়ই কোন না কোন অসদুপায় অবলম্বন করেই লোকটি সংসার চালায়। জায়গায় বিল্ডিং উঠায়। আমাকে দেয়া হা্উজিং লোনে কতটুকু জায়গা কিনতে পারবো, বিল্ডিং তুলতে পারবো কিনা, মাসিক বেতন থেকে লোন কাটার পর অসদুপায় অবলম্বন করি কিনা, এসবের খবর নিয়ে ব্যাংক কি লোন দেয়?
- তাহলে।
সুতরাং তার মানে কি দাড়াল? তার মানে হল, আমি যদি আগে দশ টাকা ঘূষ খেতাম, এখন খাই একশত টাকা। প্রয়োজনের তাগীদে্ই তো মানুষ চুরি করে। আমিও তাই করি। আর এটি করার জন্য ব্যাংকও আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে।
ম্যানেজার সাহেবকে সরকার যে টাকা দিয়েছে তার চেয়ে বেশী টাকার জায়গা কিনেছে। বাড়ী করেছে। এর বিপরীতে তিনি হাজী সাহেবসহ বড় বড় কাষ্টমারের পকেট হাতিয়ে নিতে গিয়ে নিজেও খেয়েছেন, ওদেরকেও দিয়েছেন। মধ্যখাতে লুট হল ব্যাংকের টাকা।
এই যে কিছুদিন আগে আপনি হাজী সাহেবের ইন্ডাষ্ট্রি ভিজিট করে একটি ষ্টেটম্যান্ট উপরে পাঠিয়ে ছিলেন। এতে কি হয়েছে জানেন?
- না।
- হাজী সাহেব ষ্টীল ইন্ডাষ্ট্রিজের চুল্লী মেরামতের নাম দিয়ে ঐ টাকায় মুলত আন্দর কিল্লায় নিজস্ব জায়গায় পাচ তলা বিশিষ্ট অনেক বড় বিল্ডিং এর কাজে হাত দিয়েছেন। ব্যাংকের কর্মকতাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যদি ২-৪ লক্ষ টাকা ঘূষ দিয়ে দেন, এতে সমস্যা আছে?
- না। নাই।
- এজন্যই আপনার অভিযোগের পর উল্টো হাজী সাহেবকে সাহায্য করার জন্য এজিএম তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। বিনিময়ে ম্যানেজারের পকেট টা আর একটু ভারী হল।
এমনকি, হেড অফিস থেকে আসা অডিট টিম ও এব অপকর্মের সাথে জড়িত। এজন্য দেখেননা। হেড অফিস থেকে অডিট টিম আসল ব্যাংকের কাজে। হাজী সাহেব তাদেরকে চাইনিজ খাওয়ানোর দরকার কি?
- হুম। এতক্ষনে বুঝতে পেরেছি।
কাজেই আপনি তার মেয়ে পড়াতে গিয়ে টাকা নেয়ার ব্যাপারে লজ্জাবোধ একেবারেই অনর্থক। এটি আপনার অধিকার।
পরদিন সেকান্দর সাহেব আমাকে ম্যানেজারের রুম থেকে ডাক দিয়েছেন। ঢুকতেই স্যার হাস্যেজ্জল মুখে আমাকে সম্ভাষন জানিয়ে বসতে বললেন। তারপর বিপুর ব্যাপারে জানতে চাইলেন। অবশেষে আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, আমার মেয়েটাকে পড়ানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আজ থেকে প্রতিদিন গাড়ী ভাড়া বাবদ আপনি মাসে ৫০০ টাকা করে পাবেন। মাসের প্রথমেই এটি ক্যাশিয়ার থেকে আমার কথা বলে নিয়ে নেবেন। আর কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলবেন। অসুবিধে নেই।
- স্যার। আমার একটু কথা ছিল।
- বলেন।
- আসলে দুরত্বের কারণে প্রত্যোকদিন আপনার বাসায় যেতে খুব কষ্ট হয়। এজন্য ভাবছি, সপ্তাহে তিন দিন পড়ানোর জন্য।
- অসুবিধে নেই। আপনি আপনার সুবিধামত দিন ধায্য করে নিন। আর এখন থেকে দুপুর দুইটায় আপনি আমার মেয়েকে পড়ানোর জন্য চলে যেতে পারেন। বিকেল পাচটা নাগাদ পড়িয়ে বাসায় চলে গেলেন।
- ঠিক আছে স্যার।
স্যারের রুম থেকে আনন্দিত মনে বিদায় নিলাম। এর পরে থেকে ব্যাংকে কখনও দেরীতে আসলেও স্যার আমাকে কোন কিছূ বলতেন না। পক্ষান্তরে স্যারের বাসায় টিউশনি করাটা এক ধরণের তেল মারা হলেও, নতুন চাকরির কারণে গোলে মালে যাক না দিন, এ থিউরি নিয়ে সামনে এগিয়ে চলছি।
পরদিন দুপুর দুইটায় ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেলাম। স্যারের বাসায় গিয়ে বিপুকে পড়াতে বসলাম। বললাম
- অাজ থেকে আমি সপ্তাহে তিন দিন আসবো তোমাকে পড়াতে।
- কেন স্যার?
- স্যার তোমাকে কিছু বলেনি?
- নাতো! বাবা শূধু বলেছে, আপনি আজ থেকে দুপুর দুটার পরে আমাকে পড়াতে আসবেন।
- হুম। বললাম, দ্যাখো, এত দুর এসে তোমাকে পড়াতে আসি। আমার খুব কস্ট হয়। তোমাকে পড়িয়ে সেই আগ্রাবাদের মাদার্য পাড়ায় আমাকে যেতে হয়। বাসায় গিয়ে পাক শাক করে ঘূমাতে ঘুমাতে অনেক দেরী হয়ে যায়।
বিপু আমার কষ্টের কথা শূনে কিছুটা মর্মাহত হয়েছে। তার পড়ালিখায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে জানলেও কিছু বলার নেই। অভয়বে বুঝা গেল ও কিছুটা হতাশও হয়েছে। লক্ষ্য করলাম, ও যেন কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। জিজ্ঞেস করলাম,
- তুমি কি কিছু বলবে?
- জী স্যার। যদিও বলাটা ঠিক হচ্ছেনা..।
- অসুবিধে নেই বলতে পার।
- স্যার। আপনার বাসাটা কি এদিকে নিয়ে আসলে অসুবিধা হবে?
- দ্যাখ। আমি যে বাড়ীর বাংলায় থাকি জায়গাটা অনেক সুন্দর। তিন বন্ধু মিলে এক সাথে থাকি। পাকশাক করি। আড্ডা দেই। তাছাড়া, ওখানকার বাড়ীওয়ালী সম্পর্কে আমার খালাম্মা। ওদেরকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করেনা।
- কেন স্যার? ওরা কি আপনার খুব আপন। মানে নিজের খালাম্মা?
- না। ডাকতে ডাকতে খালাম্মা। হাওলাতি খালাম্মা।
- হুম। ওদের সাথে এত আপন হলেন কি করে?
তোমাদের চট্রগ্রামের লোকদের একটি জিনিষ আমার খূব ভাল লাগে। আর তা হলো - আতিথেয়তা। যাকে মন দেয়, উজাড় করে দেয়। মনে হয় পুরো কলিজাটাও খাইয়ে দিবে। খালাম্মাটাও হুবহু তাই। ওর সন্তান সন্ততি সবাই যেন আমাদের বড় কাছের লোক। এজন্য আমরা বন্ধুরা তিন জনে মিলেই বাড়ী ওযালীকে খালাম্মা ডাকি। মনে হয় আপন খালা। বাস্তবেও তাই।
আজ বেশী কিছু পড়াইনি। স্কুলের পড়াও তেমন একটা ছিলনা। তাই বিদায় নিতেই, বিপুর প্রশ্ন
- স্যার। আগামীকাল কি আসবেন?
একটু থেমে গেলাম। ভাবলাম, হঠাৎ করে সিডিউলটা তিন দিন করা ঠিক হবেনা। মেয়েটার পড়ালিখার মাঝে একটা সিস্টেম করে তার পর সপ্তাহে তিন দিন করলে ভাল হবে। তাই বিপুকে বললাম
- হা। আগামীকালও আসবো। কালকে বসে তুমিসহ দেখবো কোন দুইদিন না আসলে তোমার পড়ালিখায় সমস্যা হবেনা।
খুব খূশী মনে মাথা নেড়ে বিপু সায় দিল, ঠিক আছে স্যার।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৭৮৯ বার পঠিত, ৫৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
২০ বছর আগেই যদি এই উপলব্দি, তাহলে এই সময়ে সেকান্দার সাহেব কী বলতেন?
সুতরাং আমার মনে হয়, উনি হয়তো মুখে আওড়াতেন, 'শালার, পুরো দেশটাই যেন বাজিকর এর খনি। শয়তানে ভরে গেছে দেশ। বিচার ছাড়া দেশ যে কোন স্বর্গে গিয়ে পৌছাবে বুঝতে পারছিনা।'
হায়রে সরকারী ব্যাংক!
probashimojumder or
dessert deffodil
ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য।
এই কয়টি লাইন আমাদের জন্য- সমাজের জন্য- প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট। আমি একমত। পরিবেশ মানুষকে প্রভাবিত করে। শুকরান বড় ভাই।
আজতো দুটো পোষ্ট দিয়েছি। আছি। এখনো ব্লগে আপনার অনুসরণ করি।
আন্নের কমেন্ট অ্যার বহুত ভালা লাইগছে। সুন্দর।
কত ফুল ফোটে কত ফূল ঝরে।
ধন্যবাদ। ভাল লাগল।
জন্ম থেকেই চোর লালন করছে এই দেশটা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন