রঙ্গের মানুষ -(পর্ব-৬)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১৩ মার্চ, ২০১৪, ০৯:১১:২৭ রাত
পর্ব-৫
খায়ের স্যারের বিরুদ্ধে সবাই ক্ষ্যাপা। তলে তলে অনেকে অভিযোগও করেছে। প্রতিবারই ম্যানেজার সাহেব বলেছেন, আমি দেখছি। কিন্তু বাস্তবে কোন এ্যাকশন হয়নি।
অভিযোগের মাত্রাটা ক্রমেই বাড়তে থাকল। ঘুষ কমবেশী অনেকেই খেলেও খায়ের সাহেবেরটা অনেকটা ডাকাতির মত। তাছাড়া, অন্যকে ব্যবহার করে তিনি একই সব খান।
বিষয়টি নিয়ে খায়ের সাহেব ও বিপাকে। তাই একদিন কথা প্রসঙ্গে সবাইকে লক্ষ্য বললেন,
- আমি জানি। আমার বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। করুন। কতদিন করতে পারেন দেখবো। এ বিষয়ে এ্যাকশন নিলে কি হবে আমি জানি। সর্বোচ্ছ শাস্তি হিসেবে বঙ্গোপ সাগরের ঐ পারে আমাকে ট্রান্সফার করবে। এইত! তারপর?
- তবে মনে রাখা উচিত, সমুদ্রের ওপার থেকেও আমি পানিতে ঢিল ছূঁড়ে দেখবো উত্তর কি আসে।
সবাই বুঝতে পারল, এ ব্যাপারে খায়ের সাহেব বড় সিরিয়াস। নো কম্প্রোমাইজ। খায়ের সাহেবের ছুঁড়ে দেয়া ঐদ্ব্যত্য পুর্ন মন্তব্য দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছে। নিশ্চয় এর সিঁকড় অনেক গভীরে।
অনেকদিন পরের কথা। বড় একটা ষ্টীল ইন্ডাষ্ট্রীজ ব্যাংক থেকে ত্রিশ কোটি টাকা লোন নিয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে এটি দেখাশোনা করার দায়ীত্ব ছিল আমার। ইন্ডাষ্ট্রীতে মাসে দু'বার ভিজিট করতে হয়। সেখানে প্রহরী হিসেবে ব্যাংকের দুজন প্রহরীও নিয়োগ করা হয়েছে।
ইন্ড্রাষ্টি্জ এর মালিক ব্যাংকে আসলেই দেখা করে যেতেন। তাকে সবাই হাজী সাহেব নামেই ডাকত। সামনে বসে কিছূক্ষণ মনের কথা বলতেন। চেষ্টা করতেন ভাব জমাতে। তার অভিযোগ একটাই,
- মজুমদার সাহেব। আপনি আমার ইন্ড্রাষ্ট্রিতে পরিদর্শন করতে যান। অথচ আমি একটুও জানিনা। আপনাকে অন্তত একটু আতিথেয়তার সুযোগতো দেবেন? আপনি একটি নিদিষ্ট্র তারিখে ভিজিট করতে গেলে আমার জন্য সুবিধা হয়। সামনে কখন যাবেন, বলুন। আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দেব।
- ধন্যবাদ। আসলে অফিসে কাজের এত চাপ যে, দিন তারিখ ঠিক করে যাওয়া বড় কঠিন। থাক। আমাকে দিয়ে কি আপনার কোন সমস্যা হয়?
- না। তবে আপনিতো কোন কিছুই খাননা। অন্তত একটু চা পানি দিয়ে আপনাকে আপ্যায়নের সুযোগটাতো দেয়া যায়?
- ঠিক আছে। সামনে কোন একদিন আপনার অফিসে বেড়িয়ে আসব।
- হাজী সাহেব বিদায় নিলেন।
কথা প্রসঙ্গে সেকান্দর সাহেব থেকে হাজী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হল। আগে এ ইন্ড্রাষ্ট্রিটি দেখা-শোনার দায়ীত্ব ছিল রফিক সাহেবের। অভ্যাসের দিক থেকে খায়ের সাহেবের ছোট ভাই। লজ্জা শরম বলতে নাকি কিছু্ই ছিলনা। রফিক সাহেব নাকি প্রায়ই হাজী সাহেব থেকে উপরি পেত। কোরবাণীর ঈদ আসলেই সোজা হাজী সাহেবের অফিসে চলে যেত। সাথে করে নিয়ে যেতো এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট । এগিয়ে দেয়া গোল্ড লিফের প্যাকেট দেখেই হাজী বুঝতে পারত, উপরির পরিমাণটা এবার একটু বেশী দিতে হবে।
- কি রফিক সাহেব? কি খবর? হাজী সাহেব জানতে চায়।
- খবরতো আপনার কাছে। এজন্যই এসেছি।
- বলেন কি করতে হবে?
- কোরবানী সামনে। গরু কেনার পয়সা নেই।
- হুম। কত দিতে হবে?
- কত-টত বুঝিনা। আমাকে আপনি গুরু একটা কিনে দিতে হবে।
গরু কিনে না দিলেও মোটামুটি বড় অংকের টাকা যে দিয়েছে এটা নিশ্চিত।
কিছুদিন পরের কথা। হাজী সাহেব তার ইন্ডাষ্টিতে চুল্লীটা নতুন করে প্রস্ততির কাজে হাত দিয়েছেন। আপাতত প্রোডাকশনের কাজ বন্ধ। হাজী সাহেবের ব্যাংক হিসেব খুলে দেখি মা্ত্র ১০ কোটি টাকা ব্যালেন্স আছে। সোজা ইন্ডাষ্ট্রী পরিদর্শনে চলে গেলাম। সেখানেও কোন জমা মালামাল পাওয়া গেলনা। এদিকে প্রোডাকশন ও বন্ধ।
প্রতি মাসের মাঝামাঝি ও শেষ তারিখে ইন্ড্রাষ্ট্রিজ এর ব্যাংক ব্যালেন্স আর মওজুদ মালের ভ্যালূ ধরে আমি আলাদা ষ্টেটমেন্ট তৈরী করতাম। ম্যানেজার কিংবা খায়ের সাহেবের দস্তখত নিয়ে এটিকে পাঠিয়ে দিতাম জোনাল অফিসে। মাসের শেষে জোনাল অফিস হতে সোজা ঢাকা হেড অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হত।
এবারের পরিদর্শন শেষে ব্যাংক ব্যালেন্স ও ইন্ডাষ্ট্রিতে জমা মালের ভ্যালু বাবদ তৈরীকৃত ষ্টেটমেন্ট এর পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। হিসেবের খাতায় আঠার কোটি টাকা উধাও!
সেদিন ম্যানেজার সাহেব অফিসে আসেনি। আমি খায়ের সাহেব থেকে দস্তখত নিয়ে এটিকে জোনাল অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। দস্তখতের আগে খায়ের সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন
- কোন সমস্যা নেইতো?
- না স্যার। যা আছে তা হুবহু লিখে দিয়েছি। বাস।
পরদিন সকালে বিষয়টা ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়েছি। শূনে ম্যানেজার একেবারে অগ্নীশর্মা। লাল কালী দিয়ে চিরুকুট লিখলেন
" আমার অনুমতি ব্যাতিরেকে এ হিসেব থেকে কোন ধরনের টাকা উত্তোলন করা যাবে না"
এটিকে হাজী সাহেবের ক্রেডিট একাউন্টের উপর ষ্টীকি করে দেয়া হল।
সকাল দশটার দিকে হাজি সাহেবের পাঠানো চেক রিটার্ন গেল। কিছুক্ষণ পরেই হাজী সাহেব ব্যাংকে দৌড়ে এলেন। অনেক লম্বা একটা সালাম দিয়ে হাসি মুখে আমার সামনে বসলেন। কৌশল বিনিময়ের মাঝেই সবার অগোচরে একটা ইনভেলপ আমার সামনে রাখা কাগজের ভেতর গুজে দিলেন।
আমি না জবাব। জোরে কথা বলতে গেলেই অন্যদের চোখে পড়বে। হাজী সাহেব খুব আপন জনের মতই মুখটা একটু সামনে এনে ফিস ফিস করে বললেন,
- আমি আপনাকে কিছু দেইনি। আমি বুড়ো মাকে খুব শ্রদ্ধা করি। আপনার মা আমার মা। আমি আমার মায়ের জন্য কিছু কিনার জন্য আপনাকে দায়ীত্ব দিলাম।
জীবনের প্রথম ঘূষ। জানিনা কত দিয়েছে। তবে ইনভেলপের নমুনা দেখে একটু বেশীই মনে হচ্ছে। আবার ভাবলাম, সব একটাকার নোটও তো হতে পারে।
বুকটা দুর দুর করছে। ভয় পাচ্ছি পাশে বসা রবি সাহেবকে নিয়ে। এরাতো এ বিষয়ে মাষ্টার্স। বাতাসেই ঘুষের গন্ধ পায়। হাজীর সাহেব যাবার পরই জিজ্ঞেস করবে, উনার সাথে গুন গুনিয়ে কি কথা হয়েছিল?
আমি ভেতরে ভেতরে অগ্নীশর্মা হয়ে উঠলেও হাজী সাহেবকে মাইন্ড করার মত কিছূ বলা যাবেনা। তাই মাথাটা সামনে ঝূকে ফিস ফিস করে বললাম
- হাজী সাহেব। প্লীজ আপনি এসব নিয়ে যান। সবাই ঘূষ খায় ।আমি খাইনা। আপনি চান যে আমিও খারাপ হয়ে যাই?
- না খেলে আমাকে বাচাঁন, হাজী সাহেব অনুরোধ করলেন। আপনি যে ষ্টেটমেন্ট পাঠিয়েছেন, হেড অফিসে গেলে আমার ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ হয়ে যাবে। জোনাল অফিসের এজিএম সাহেব বলেছে, আপনার সাথে বসতে। একটা কিছু করুন প্লীজ।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম যেখানে সবাই খায়, আমার কি করার আছে? তাই বললাম, আপনি খায়ের সাহেবকে দিয়ে ষ্টেটমেন্টটা বানিয়ে পাঠিয়ে দিন। আমি কিছু বলবনা। তবে শর্ত, কাগজের নীচে ইনভেলপটা নিয়ে যান প্লীজ।
হাজী সাহেব ইনভেলপ নিয়ে বিদায় নিলেন। ম্যানেজারের সাথে কথা বললেন। তার পর বের হয়ে গেলেন। দুুদিন পর আবার ও হাজী সাহেব আসলেন। এ বারে তাকে অন্য সময়ের চেয়ে বেশী উৎফূল্লই মনে হয়েছে। ব্যাংক একাউ্ন্ট কিংবা ইন্ড্রাষ্ট্রিতে সব কিছু অপরিবর্তিত থেকেই টাকা উত্তোলনের কাজ আবারও শুরু হয়ে গেল।
এক সপ্তাহ পর আবার ও ইন্ড্রাস্ট্রি ভিজিটে গেলাম। ব্যাংকের দারোয়ান করিমকে জিজ্ঞেস করলাম
- আপনি কি ইতিমধ্যে ব্যাংক ম্যানেজারের বাসায় গিয়েছিলেন?
- জ্যী স্যার।
- কখন?
- কয়েকদিন আগে।
- কেন গিয়েছেন?
- হাজী সাহেব ৩ কাটূন আম দিয়ে ম্যানেজারের বাসায় পাঠিয়েছিলেন।
- হুম।
কথিত আছে, ম্যানেজার সাহেব ব্যাংকের লোনে বাড়ীটা করার সময় হাজী সাহেব "উপঢৌকন" হিসেবে অনেক রডও সরবরাহ করেছিলেন।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৫ বার পঠিত, ৬২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নাহ সরকারী ব্যাংক এ ঢুকতে হবে যেভাবেই হোক।
ঘুষের যে কত রকম তরিকা আছে বাংলাদেশে। তারপরও বাংলাদেশ কে দুর্নীতিতে আমি প্রথম মনে করি না। ভারত কে আমি দুর্নীতিতে প্রথম মনে করি। আমরা যে সব তরীকা হালে আবিষ্কার করেছি, ভারতীয়রা সে সব ৫০ বছর আগেই আবিষ্কার করেছে।
তথাকথিত পাশ্চাত্য স্টাইলের গণতন্ত্র যত বেশী প্রাতিষ্ঠানিক হয়, দুর্নীতির শিকড় ততবেশী গভীরে প্রবেশ করে ও মোটা তাজা হয়।
আজ থেকে পাচঁ বছর আগের কথা। আমার দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের দুয়েকদিন পর তার সাথে হঠাৎ দেখা হলে তিনিই আমাকে মিষ্টিমূখ করালেন এবং আরো দু’কেজি দামী মিষ্টি আমার বাসায় উপহার হিসেবে কিনে দিলেন। অথচ এই ভদ্র লোকের সাথে আমার সম্পর্কের ঘনিষ্টতা সে পর্যায়ের ছিল না যাতে সে আমার মেয়ের জন্মের খুশীতে আমাকেই মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন ও বাসায় পর্যন্ত প্রেরণের ব্যবস্থা!! অথচ অবস্থানে, তার জাগায় আমি হলে এতো বিলাসীতা পূরনো হাবভাব দেখাতাম না। আল্লাহর ভাল জানেন তার উপার্জিত অর্থবৃত্ত হক পথে অর্জন করেছে কিনা।
সত্যি কথা বলতে কি. সতভাবে ব্যাংকের চাকরি করা বড় অসম্ভব।
ধন্যবাদ্
সরকার কা মাল দরয়িআ মে ডাল নেহি। বলকে সরকার কা মাল আগুন মে ডাল
সাহস দেখিয়েছেন। কতদিন পারবেন। দেখা যাক।অপেক্ষায় আছি।
আমাদের সমাজের এই সব পাঁজি হাজিসাবদেরকে পরিচয় করাবার জন্য ধন্যবাদ।
আপনি ঘুষ খাননি।এ ঘটনা পড়ে অনেকেই খাবে না।আমি খাব না।
খুব ব্যস্ত। গতকাল অফিসিয়াল কাজে অন্য শহরে গিয়েছিলাম। বিকেলে এসেই এ পর্বটি লিখে পোস্ট করে দিলাম। লিখে মাত্র একটিবার রিভাইজড দিিছি। ভয় পাই না জানি পাঠকদের ঘাটতি শুরু হয় । বন্ধ করারও উপায় নেই। তবুু হাল ছাড়বো। চালিয়ে যাবো।
আগামী পর্বে আসছে আমার টিউশনির নতুন ছাত্রীকে নিয়ে নতুন পর্ব। অপেক্ষায় থাকুন। প্রবাসী মজুমদারের ব্লগ প্রেক্ষাগৃহে এটি প্রদশিত হবে।
ধন্যবাদ। বেশী বলে ফেললাম। আজকের জন্য শেষ মন্তব্যকারীতো। তাই।
এই এনভেলপমুক্ত হওয়াটাই মনে হয় অন্ততঃপক্ষে তৃতীয় স্তরের ঈমানদারের পরিচয় বহন করে। ধন্যবাদ।
নইলে কাগজের ফূল
হেগেনে বেশীদিন লাস্টিঙ করে।
ধন্যবাদ।
কোন পর্বের মন্তব্যতে বলেছিলেন, ভালো চাকরি হলেও পয়সা কম। এই অবস্থায় ও ঘুষ খাননি। ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন