রঙ্গের মানুষ - পর্ব-৫
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ১২ মার্চ, ২০১৪, ১১:১৪:৪৩ রাত
পর্ব-৪
নতুন চাকুরীর তৃতীয় সপ্তাহে পদার্পন করেছি। উষা দেবীর দেওয়া প্রশিক্ষণ প্রায় শেষ। দেবীর প্রাত্যহিক রুটিন কাজ গুলো অনেকটা রপ্ত হয়ে গেছে। তাই দেবীর দায়িত্বটা আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হল। দেবীকে ট্রান্সফার করা হল শুভ দেব এর জায়গায় । আর শুভ দেবকে বদলী করা হয়েছে কাজীর দেউরি শাখায়।
আমার এ স্থানটাতে ক্যাশ টাকার কোন লেনদেন নেই। ব্যাংকের সব লেন-দেন এর গেটওয়ে এটি। ট্রানজেকশন পিরিয়ড দুপুর একটা পর্যন্ত। তার পর কর্ম বিরতি। মধ্যাহ্ন ভোজ। সময় এক ঘন্টা। এরপর শুরু হয় দিনের দ্বিতীয় প্রহরের কাজ। এ সময়টিতে সকাল থেকে করা নথিভুক্ত কাজের হিসেব মিলাই। অামার ডেস্ক থেকে যাওয়া চেক বা ক্যাশ ভাউচার লেজারে পোষ্টিং হয়েছে কিনা মোট অঙ্কের সাথে মিলিয়ে দেখি। সব শেষে সিনিয়র অফিসার শাহনাজ আপার ফাইনাল চেক। তার পর আপার দস্তখতের মাধ্যমে আজকের দিনের কাজের স্বীকৃতি ও সমাপ্তি।
আমার কাজ মধ্যাহ্ন ভোজের আগে শেষ হবার কথা। কিন্তু হয়না। প্রতিদিনই কর্মবিরতি সেরে এসে দেখি ২-৪ জন কাস্টমার অপেক্ষা করছে। কখনো কখনো এরা বিকেল সাড়ে তিনটার পরও এসে হাজির হয়। মাঝে মধ্যে আমি না থাকলে সেকেন্ড অফিসার খায়ের সাহেব নিজেই নথিভূক্ত করে ষ্টাম্প মেরে লেজার পোস্টিং এ পাঠিয়ে দেন।
রেয়াজউদ্দীন বাজার ফলের আড়তদারের আড্ডা। এরা ডিডি কিংবা টিটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে চাপাঁইনবাবগঞ্জ কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে চট্টগ্রাম লক্ষ লক্ষ টাকা ট্রান্সফার করে থাকে। ফল বেচাকেনার এ ট্রানজেকশান প্রতিদিনই হয়। কিন্তু অনিয়মটা এত চরমে পৌঁছে যে, অনেকটা অতিষ্ট হওয়ার মত। উষা দেবীর এ অবস্থান থেকে বিদায়ের সময় চেহারায় ফুটে উঠা হাসি দেখে বুঝতে বাকী রইলনা যে, সে একটা মহা সমস্যা হতে মুক্তি পেয়েছে।
প্রায়ই দেখি, বিলম্বে টিটি নিয়ে আসা অশিক্ষিত কিংবা আধা শিক্ষিত ফুটপাতের বিক্রেতাগুলো অসময়ে এসে হাজির। খায়ের সাহেব এদেরকে খুব সম্মান করেন। সামনে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দেন। পিয়ন আহমদকে দিয়ে ক্যাশিয়ার থেকে টাকা নিয়ে সসম্মানে হাতে তুলে দেন। কখনও কখনও লেজারে পোস্টিং দেবার আগেই নিজ হাতে ক্যাশ থেকে টাকা এনে হস্তান্তর করেন। অনেকটা ভি.আই.পি ষ্টাইলের সম্মাননা।
বিষয়টি আমার মাথা ব্যথার কারণ হওয়াতে খতিয়ে দেখার শুরু করলাম। এক ব্যবসায়ীর সাথে একান্তে কথা বলে জানতে পারলাম, এদেরকে অসময়ে আসতে খায়ের সাহেব বাধ্য করেন।
- কেন?
কারণ সকাল বেলায় ফোনে টিটির নাম্বারটা নিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে দিলে জালে মাছ আটকানো সম্ভব নয়। কোন এক ফাঁকে ব্যবসায়ীরা টাকা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলে খায়ের সাহেব উপরি নেয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই সকাল বেলায় ফোনালাপে নেয়া টিটিগুলো নিজেই লিখে ড্রয়ারে রেখে দেন।
বিকেলে এসব ব্যবসায়ী ব্যাংকে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে বলেন
- অ্যারে। আমিতো আপনার জন্যই এতক্ষণ বসে অাছি। সেই সকাল বেলায় আপনার জন্য টিটিটা রেডি করে রেখেছি।
এই আহমদ। এদিকে আস। যাও। দু'কাপ চা নিয়ে এসো। সাথে সিঙ্গারা। এই নাও। টিটিটা লেজারে দিয়ে টাকাটা ক্যাশিয়ার থেকে নিয়ে আস। অনেক সময় নিজেই উঠে নিয়ে আসেন। নিজের প্রাপ্য ঘুষ পকেটে ঢুকিয়ে বসতে বসতে ডায়ালগ ছাড়েন
- আজ বেশী নেই নাই। জানি আপনাদের ব্যবসা এখন মন্দা যাচ্ছে। বেচারা অশিক্ষিত ফল ব্যাপারী। এত বড় অফিসারের আতিথেয়তা আর কৌশলে টাকা নেয়ার দৃশ্য দেখে লজ্জায় মাথানত করে সালাম দিয়ে বিদায় নেয়।
খায়ের সাহেবদের এসব কর্ম দেখেই মনে মনে ভাবি, এ জন্যইতো এসব পথে বসা ফল ব্যাবসায়ীদের থেকে ফল মুল কিনতে গিয়ে শেষ ভোগান্তিটা আমাদের উপরই পড়ে। কেনা ফল বাসায় নিয়ে কতবার বকা খেয়েছি। উপরে ঝক ঝক করা ফলের নীচে রাখা সবই পঁচা। বেচারা বিক্রেতা। খায়ের সাহেবদের নেয়া ঘুষটা কি তার বাবার জায়গা বিক্রী করে দেবে?
রবি সাহেবের পাশে বসতে বসতে অবসর সময়ে ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিং এর কাজটিও রপ্ত করে নিলাম। ভাবলাম, জ্ঞানার্জনে শেষ নেই। গ্রামের ডাবল মাষ্টার্স ডিগ্রী পাশ মামুন কাকুকে বললাম, আপনি এত পড়েও তো ভাল একটা চাকুরী পেলেন না। লাভটা কি হল?
- আহারে ভাতিজা। আসল বিষয়টাই বুঝো নাই। পড়ালিখা মানেই জ্ঞানার্জন। জানো, হাদিসে আছে, শিক্ষিত মানুষ মারা গেলেও নাকি কবরের ফেরেশতারা শ্রদ্ধা করে।
- এ হাদিসতো আর শুনি নাই।
- ভাতিজা। সব হাদিসের রেফারেন্স জানা জরুরী নয়।
মামুন কাকুর মতই ভাবলাম শিখে নেই। এক সময় কাজে লাগবে। প্রমোশন পেতেও সাহায্য করবে।
কোন এক দিনের কথা। রবি সাহেব অসুস্থ। অফিসে আসেননি। পাশাপাশি টেবিল হওয়াতে আমাকেই কাজটি করতে হল। একা দুটো কাজ করতে গিয়ে একেবারে হাঁফিয়ে উঠলাম। কাজে নয়। জোর করে দেয়া প্রচলিত ঘুষ খেতে অসম্মতি জানানোর কারণে।
বেচারো ফল ব্যাপারী। একেবারে নাছোড় বান্দা। আমাকে টাকা দেবেই দেবে।
- স্যার আমাকে কাগজটা লিখে দিন।
- লিখে এগিয়ে দিতেই পকেট থেকে ২০/৩০ টাকার উপঢৌকন। জিজ্ঞেস করলাম
- আমাকে টাকা দিচ্ছেন কেন?
- স্যার । আপনি যে কাগজটা লিখে দিলেন, চা পানি খাবার জন্য।
- যান। লাগবেনা।
- না স্যার। প্লীজ। আপনি মাইন্ড কইরেন না। ভাবলো, মনে হয় আরও বেশী দিতে হবে। তাই আরও দশটাকা যোগ করল।
- আমি এসব খাইনা।
- প্লিজ স্যার। নিলে খুব খুশী হবো। রবি সাহেবকে তো আমরা বলতে হয়না। অনেক সময় উনি নিজেই চেয়ে নেন। আমরা লিখা পড়া জানিনা। আপনারা কষ্ট করে লিখে দেন বলে..।
- হুম।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৫ বার পঠিত, ১০৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু পাঠক দের টিউশনির প্রস্তাবের উত্তেজনাতে রেখে আপনি ব্যাংক এর ঘুষ খাওয়া তে গেলেন কেন????
নৌবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁর বক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। উনি হাউজ লোন এর জন্য আবেদন করেছিলেন সোনালী ব্যাংকে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় উনার আবেদন এর বিপরীতে সিদ্ধান্ত আর হয়না। ছয় মাস পর উনাকে চিঠি দিয়ে জানানো হলো- আপনার ঋণ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। বলা বাহুল্য-ততদিনে উনার হাউজ লোন এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। অন্য একটি বেসরকারী ব্যাংক হতে আবেদন এর এক সপ্তাহের মাথায় ঋণ পেয়েছিলেন। একটি সিদ্ধান্ত নিতে যারা ছয়মাস সময় নেয় তারা লাভ করবে কি করে? বিপরীতে বেসরকারী সিদ্ধান্ত দিতে ব্যাংক সময় নিত দুই দিন।
অথচ এ সরকারী ব্যাংকগুলো তেলা মাথায় আরো তেল ঢালতে জানে। ঋণখেলাপীদেরকেই তারা বারবার ঋণ দিয়ে থাকে।
ঘোষটা এখন সয়ে গেছে। আমরাও কিছু মনে করিনা।
ঘোষটা এখন সয়ে গেছে। আমরাও কিছু মনে করিনা
৬ এর।
আর ব্যাংকে টিটি,ডিডি ফরম পূরণ করেও যে টাকা নেয়ার তরিকা আছে তা মাত্রই জানলাম। ধন্যবাদ, চলতে থাকুক.........
পোস্ট স্টিকি করার জন্য মডুদের ধন্যবাদ।
" প্লীজ স্যার। নিলে খুব খুশী হব।
রবি সাহেবকে তো আমরা বলতে হয়না
। অনেক সময় উনি নিজেই চেয়ে নেন।
আমরা লিখা পড়া জানিনা।
আপনারা কষ্ট করে লিখে দেন বলে..।"
Iha dara kinchit khocha dilo naki? Na dileo shikkito hishebe gaye laglo. Oishob durniti bajder jonno e deshe ai haal.
নৌবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁর বক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। উনি হাউজ লোন এর জন্য আবেদন করেছিলেন সোনালী ব্যাংকে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় উনার আবেদন এর বিপরীতে সিদ্ধান্ত আর হয়না। ছয় মাস পর উনাকে চিঠি দিয়ে জানানো হলো- আপনার ঋণ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। বলা বাহুল্য-ততদিনে উনার হাউজ লোন এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। অন্য একটি বেসরকারী ব্যাংক হতে আবেদন এর এক সপ্তাহের মাথায় ঋণ পেয়েছিলেন। একটি সিদ্ধান্ত নিতে যারা ছয়মাস সময় নেয় তারা লাভ করবে কি করে? বিপরীতে বেসরকারী সিদ্ধান্ত দিতে ব্যাংক সময় নিত দুই দিন।
অথচ এ সরকারী ব্যাংকগুলো তেলা মাথায় আরো তেল ঢালতে জানে। ঋণখেলাপীদেরকেই তারা বারবার ঋণ দিয়ে থাকে।
সাথেই আছি।
১। গ্রহীতাকে কাজের মাধ্যমে ফাঁসিয়ে, কিংবা তার অধিকার তাকে না দিয়ে, কিংবা ফাইল আটকিয়ে রেখে যে অর্থ বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি প্রদান করে (যেমন টি আপনার কাহিনী) তাকে কি ঘুষ প্রদান বলা যাবে? অনেকের দৃষ্টিতে এটাকে ঘুষ বলা যায়ন না! এটা হল এক প্রকার জুলুম এবং ডাকাতি। যিনি ফাইল আটকিয়েছেন তিনি জালিম, ভুক্তভোগী মজলুম। জালিম তার পদের অপব্যবহার করেছেন, যেমনটি রাজনৈতিক নেতার করেন। গ্রহীতা প্রতিবাদ করতে পারেন নি, পারেন না! কেননা তার প্রতিবাদ শুনার কেউ নাই সেজন্য তিনি মুজলুম। মূলতঃ এইক্ষেত্রে গ্রহীতার কিছুই করার থাকেনা। এখানে একজন ঠকেন অন্যজন ঠকান মাঝখানে তৃতীয় জন কেউ থাকেনা।
২। দাতা ও গ্রহীতা যদি দু-জনেই অন্য কাউকে ঠকানোর জন্য কারবার করে সেটাকে ঘুষ বলা হবে। যেমন, ৩ লাখ টাকার রাস্তার কাজ কন্ট্রাকটর ১ লাখ টাকায় করিয়ে সরকারী ইন্সপেকটরকে ৫০ হাজার টাকা ঢুকিয়ে রিপোর্ট নিলেন আমি সত্যায়িত করছি কন্ট্রাকটর তিন লাখ টাকার কাজ করিয়েছেন। এখানে দাতা গ্রহীতা কেউ ঠকেনাই, ঠকেছেন তৃতীয় জন যিনি মূল মালীক। এটার নাম ঘুষ।
৩। সরকারী টেন্ডার বাজীতেও এই কাজটি করা হয়, তবে কাজটি শুরু হবার আগে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে কাজ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এটাতেও দাতা-গ্রহীতা ফায়দাবান হয় মূল মালীক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটাও ঘুষ।
৪। এক ব্যক্তির ১০ লক্ষ টাকা দরকার, সকল কাগজ পত্র দেওয়ার পরও বৈধ উপায়ে ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ১ লাখ টাকা জরিমানা (ঘুষ) দিয়ে টাকাটা হস্তগত করলেন। কেননা টাকাটা তার দরকার। এখানেও তিন পক্ষ থাকে, গ্রহীতা ঘুষ গ্রহন করলেন, দাতার প্রথম ভূমিকা তিনি ঘুষ দিলেন, দাতার তৃতীয় ভূমিকা তিনি বিপদে পড়ে ১০ লাখ টাকার দায় মাথায় নিয়ে ৯ লাখ টাকা নিয়ে ফিরে আসলেন! এক্ষেত্রে তিনি মজলুম।
তবে, হলমার্ক, সালমান এফ রহমানের ঋণ কিন্তু এই ধারায় পড়বে না, কেননা এদের তিন পক্ষের কারো মতলব ভাল ছিলনা, তিন পক্ষই দোষি, এটার নাম ঘুষ, দুর্নিতী, চাদাবাজি, ডাকাতি সবই!
৪। রাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে পুলিশ বখরা নেয়, র্যাব মানুষকে আটকিয়ে রেখে টাকা নেয়, নেতারা জোর করে চাদা তুলে, তহসিল দার কাজে দেরী করিয়ে বেশী অর্থ আদায় করা এসব এখন আমাদের দেশে আইন হয়ে গেছে, এগুলোকে ঘুষ বললে ডাকাতি, মাস্তানি, চাঁদাবাজি কাকে বলা হবে?
সুন্দর ও বস্তুনিষ্ট ট্রপিক্সের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ রইল মডারেটরদের প্রতিও।
আশা করি এমন বিশ্লেষনের আলোকে আগামীতে ঐ সব জালিম ও জুলুমবাজদের নামকরন হবে এবং তাদের পরিনতিও তারা যথাযথভাবে পাবে - আল্লাহ সর্বস্রেষ্ট বিচারক।
খুবই চমৎকার করে লিখছেন। সাথে থাকার ওয়াদা রইল।
এ বেডা ব্যাংকের কথা কই প্রেমের গল্প শূরু করছে।
সত্য এবং হকের পথে থেকে একটা হারালে আল্লাহ হাজারো চাকুরীর ব্যাবস্থা করে দিবেন।
পরবর্তী পর্ব পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করছি।
ঘুষের কারনে রাষ্ট্রীয় সততা জাহান্নামে গেছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন