পারিবারিক তন্ত্রের মোহমায়ায় আটকে পড়া অবহেলিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যার জন্য নিজেরাই দায়ী নয় কি?

লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ৩১ জুলাই, ২০১৩, ১০:৪৭:৪৫ রাত

সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যা অনেক।এখানে অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের মত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ভাল নেই। ইকামা নবায়ন, ট্রান্সফার , ভিসাসহ আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। এ সমস্যার কারণে নিজের চোখের সামনে হাড় ভাঙ্গা খাটুনী দিয়ে গড়ে উঠা কত প্রবাসীর স্বপ্নে যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। এসব ভোগান্তিযে কতটুকু মর্মান্তিক তা কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে।

এমন কোন প্রবাসী বাংলাদেশী নেই যে, সে কোন না কোন সমস্যায় নেই। কখনও নিজের কখনো আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধূবান্ধবের। বিভিন্ন ফ্যামেলী দাওয়াত কিংবা সভাসমিতিতে ব্যাক্তিগত আলাপ চারিতায় এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উঠে আসে। আমাদের সাথে সৌদি সরকারের এ বৈপিরত্যর জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারের বিরুদ্ধেই অবহেলিত প্রবাসীরা সব সময় সোচ্চার থাকে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধীদলের সমর্থকদেরাই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের মাধ্যমে মঞ্চ গরম করতে কার্পণ্যতা বোধ করেনা। এতে অরাজনৈতিক প্রবাসীরা খূশী হলেও সময়ের বিবর্তে এদেরকেই আবার প্রবাসীদের স্বার্থ বিরোধী কাজ করতে দেখা যায়। দুমুখো সাপের এ সংখ্যাটি তুলনামুলকভাবে কোন অংশে কম নয়। দির্ঘ ত্রিশ বছর যাবত প্রবাসে থেকে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তার কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করছি।

নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সব প্রবাসীরা এক হয়ে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত বাস্ত চিত্রটা সম্পুর্ন ভিন্ন। কোন মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতা এখানে আসলেই রাজনৈতিকভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবাসীরা কেন জানি অন্যরকম হয়ে যায়। তখন সকল প্রবাসীদের কমন সমস্যাগুলোকে বেমালুম ভূলে যায়। হয়ে যায় অন্য জগতের মানুষ। এরা সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশের মতই সিন্ডিকেট রাজনীতির বেড়াজালে প্রবাসীরা এদের কাছে জিম্মি। চিন্তা মননে আমাদের বিভক্তি বরাবরের মতই প্রকাশ পায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, যখনই কোননা কোন মন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেতার আগমন ঘটে, তখনই নতুন একটা ঘটনা ঘটার মাধ্য দিয়ে বাড়তি সমস্যা সংযোজন হয়। এতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়। সম্ভাবনার কিঞ্চিৎ সমাধানটুকুও চাপা পড়ে যায়। আমাদের মন্ত্রী নেতারা বুক উচু করে বলার সাহস থাকেনা। আর এ ধরনের ঘটনা একটি দুটি নয়। অসংখ্য। বাংলাদেশের জনমানুষদের প্রতিনিধিত্বশীল যে সব মন্ত্রী কিংবা নেতাগন এখানে আসলে আমরা প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানের প্রতীক্ষার প্রহর গুণি, তাদের আগমনে ফলাফল নিয়মিত উল্টো হতেই দেখিছি। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সবাই এক হয়ে দাবী দেয়ার পরিবর্তে মন্ত্রী নেতাকে তৈল মর্দন করতে করতে সংশ্লিষ্ট দলীয় লোকেরাই দু গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শূরু হয় মারামারি। পুলিশ এসে বাংগালী জাতির নামে দু চারটা গালি দিয়ে ডান্ডা মারার মাধ্যমে আমরা শান্ত হই। তাই বাংলাদেশের প্রধান দুদলের উধ্বতন কোন নেতা নেত্রী সৌদি আরবে আসলেই আমরা আশংকায় থাকি। এদেরকে নিয়ে আমাদের গর্ব করার মত কিছুই থাকেনা। বরং সৌদিদের সামনে নিজেদেরকে একটা সন্ত্রাসী জাতি হিসেবেই আবার উপস্থাপন করার জন্য নতুন অধ্যয় তৈরী করি।

তিন বছর আগের কথা। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলেন জেদ্দায়। তিনি মদীনা হতে নির্ধারিত সময়ে আসতে পারেননি। দেশের প্রধান মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অনেক গণ্য মান্য সাধারণ মানুষকেও যেতে দেখেছি। কিন্তু দলীয় লোকদের আগে বসার প্রতিযোগীতায় গেটে শুরু হয়ে প্রচন্ড চাপ। ঠেলা সামলাতে না পেরে পুলিশ শুরু করলে পেঠা। এ দৃশ্যটি দেখেই অনুষ্ঠান শুরুর আগে বিদায় নিয়েছি।

অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রধান মন্ত্রী প্রশ্নের জবাব দিলেন। মিছে আশ্বাস দিলেন কিছু একটা হবে অবশ্যই। পরে তাহা মিথ্যা বলেই প্রমানিত হল। দুঃখজনক হল, প্রবাসীদের সন্তানদের ১৮ বছর পর থাকা যাবেনা, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে, তিনি বললেন, এ বিষয়টি সৌদি মিনিষ্ট্রির সাথে আলাপে স্থান পায়নি।

- কেন?

- কারণ আমাকে কেউ জানায়নি।

তাহলে কনস্যুলেট কিংবা দলীয় নেতা কর্মীরা নেত্রীকে খুশী করতে গিয়ে কি সবই ভূলে গেল?

প্রধানমন্ত্রী আর পররাষ্ট্র মন্ত্রীর আগমনে দলের অন্ত কোন্দলের বিষয়টি এ দেশের প্রশাসনকে সব সময় ভাবিয়ে তোলে।

বিরোধী দলীয় নেত্রীর বড় ছেলে তারেক জিয়া এসেছিল গত কয়েকমাস আগে। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মুকিত-রহমান দু গ্রুপের লোকেরাই এয়ারপোর্টে গিয়েছে। নিজেদের দাপটের সীমানা নির্ধারন করতে গিয়ে এয়ারপোটে সিরিয়াস মারামারি। ভিনদেশীরা দেখল প্রবাসী বাংলাদেশী নামের কান্ডজ্ঞানহীন মানুষগুলো তাদের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর।

খালেদা জিয়া আসলেন গত ২৬ তারিখে। প্রথমেই মদীনায় অবস্থান নিলেন মজদিনে নববীর পাশে। একদিন পর তারেক জিয়া ও লন্ডন থেকে আসল। মদিনাতে মুকিত রহমান দুগ্রুই অবস্থান নিয়েছে। নিজেদের অন্তকোন্দল এত চরমে পৌছল যে, দফায় দফায় কয়েবার মারামারি হল। পুলিশ এসে অনেককে ধরে নিয়ে আবার ছেড়ে দিল। আমাদের প্রিয় নবীর রওজার পাশে দফায় দফায় মারামারির মাধ্যমে আপনারা মুসলিম বিশ্বকে কি বুঝাতে চাইলেন? এসব শুনে নিজেকে ধিক্কার দিতে খুব ইচ্ছে করে।

প্রবাসীদের বৈধ করার জন্য সৌদি সরকার ডিক্রী জারি করলেন। আর এটার মাধ্যমে প্রবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে যেন রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের ভাগ্যই রাতারাতি পাল্টে গেল।

পাসপোর্ট বানানোর জন্য হাজার হাজার প্রবাসী জেদ্দা কনস্যুলেটে ছুটে এসেছে দুরের শহরগুলো থেকে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের লাইন। আর এটিকে নিয়েই শুরু হলো রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সিন্ডিকেট ব্যবসা। দলীয় লোকেরা নিয়মিত চেয়ার টেবিল পেতে বসেছে। লম্বা লাইনে গিয়ে কেউ কানে কানে বলছে, ভাই, ভোর ৪টা থেকে দাড়িয়ে আছেন লাইনে। যে অবস্থা। সন্ধ্যা নাগাদ ও সিরিয়াল পাবেন না। এ রৌদে এত কষ্ট না করে আমাকে পাচশত টাকা দিন। সিরিয়াল ২০ এর মধ্যে এনে দেবো। অনেকেই পাসর্পোর্ট দিনে দিনে পাবার জন্য বো্কারী করছে। এমনকি কনস্যুলেটের পাশে যে সব ফটোকপি দোকান কিংবা খাওয়ার দোকান গড়ে উঠেছে, এরা সবাই এখন অন্য জগতের মানুষ। এক কথায় সুযোগের সৎব্যবহার করতে বাঙ্গালী কখনও ভূলে যায়না। হোকনা সে আপন ভাই। যে জাতি ধরাজ কন্ঠে স্বাধীনতার কথা বললেও দেশ বিরোধী কাজ করতে দ্বিধা করেনা, যে জাতির সাধারন জনগনের চেয়ে নেতাদের মাঝেই চোর বাটপার সন্ত্রাসী বেশী, সে জাতি যে তলাহীন ঝূড়ির মত, তা প্রত্যেক নাগরিক হাড়ে হাড়ে বুঝলেও জানের ভয়ে বাকহীন।

দেড় বছর আগের কথা। রিয়াদে প্রবাসী বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা 'বাতা' মাকেটে নাঙ্গা তলোয়ার, চুরি, কিরিচ নিয়ে বাংলাদেশী ষ্টাইলে মারামারির দৃশ্য পুরো সৌদি সরকারকে হতবাক করেছে। এটি আমাদের অর্জিত সব অর্জনকে মাড়িয়ে দিয়েছে।

রাজনৈতিকভাবে আমরা এতটুকু প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছি যে, এখানে প্রতিযোগীতামুলকভাবে বিভিন্ন রাজনীতি বা সমিতি করার মাধ্যমে আমরা যেন সিন্ডিকেটের অধীনস্থ হয়ে গেছি। আর এর পরিণতি হিসেবে প্রবাসী সন্তানদের জন্য গড়ে উঠা স্কুল, মাদ্রাস সহ সব কিছুই যেন জিম্মি হয়ে গেছে।

এদেশের সরকার খূব ভাল করে জানে যে, প্রত্যেক সরকারের দাগী প্রফেশানাল খুনীগুলোর জন্য এটি একটি সেইফ হুম। এখনকার দলীয় নেতাদের পোষ্য এসব গুটিকয়েক বাংলাদেশী সন্ত্রাসী নিরীহ প্রবাসীদের জন্য এক বিষফোড়। এদের অপকর্মের জন্যই আজ প্রবাসীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। আর এর জন্য দায়ী হল

১ - বাংলাদেশকে দুপরিবারে বিভক্ত করে রাখা দু রাজনৈতিক নেত্রী। এরা বাংলাদেশের জনগনের স্বার্থে কখনো এক হতে পারেনা। এদের উচিত, প্রবাসীদের স্বার্থে স্বল্প সংখ্যাক দলীয় দাগী সন্ত্রীকে আপন দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সৌদি সরকারের সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে চুক্তি করা। এটি দলের জন্য স্বার্থ বিরোধী কাজ হলেও এতটুকু দেশপ্রেমিক কি তারা আজও হতে পেরেছে?

২- দলীয় কোন্দল ও মারামারি এড়ানোর জন্য এখানে ওমরাহ করতে এসে কোন দলীয় সমাবেশে যোগ না দেয়া।

দু নেত্রীর অনমনিয়তা যেন প্রকৃতির বেঁধে নেয়া নিয়ম। এটি থেকে উত্তরনের কোন সুযোগ নেই। পাকের ঘরে রান্না করা বুড়ার সাথে আলাপ করার ঢংটা পুরোই যেন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ও প্রয়োগ করা হচ্ছে। দুনেত্রীর সাপে নেউলের এ সম্পর্ক একটি জাতির জন্য কতটুকু লজ্জাস্কর ও ক্ষতিকর, এটুকু শুধু বুঝতো...!!!!!

সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত প্রবাসীরা দুনেত্রীর এত অন্ধ ভক্ত যে, এরা অনেকটা ফার্মে পোষ্য পশু পাখির মত। আর এ অন্ধ ভক্তির কারনে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যেন রাজনৈতিকভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই এখানে একাকার।

এক কথায়, সনাতনী চিন্তায় গড়ে উঠা পারিবারিক তন্ত্রের মোহমায়ায় আটকে পড়া অবহেলিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যার জন্য নিজেরাই দায়ী নয় কি?

বিষয়: বিবিধ

৩১৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File