মনে হচ্ছে, আমি আর বাঁচবোনা.... ৪ (সমাপ্ত)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৮ জুলাই, ২০১৩, ০৫:১৩:৪০ সকাল
গত তিন দিন ও ভাল আছে বলে মনে হয়েছে। চলার হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছিল ব্যথাটা আর নেই। চার দিনের মাথায় ও আবারও পুরোনো ঢংএ ব্যথানুভবের কথা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। বলছে, ব্যাথাটা কেমন জানি দিন দিন বেড়ে চলেছে।
- ওমা। কি কয়। বেড়েছে মানে?
- কবিরাজী ওষধ খাচ্ছিতো। ভাবছিলাম অপেক্ষা করে দেখি। কিন্তু এখন দেখছি মিছে অপেক্ষা করে লাভ নেই।
- কেমন?
- ব্যথাটা আগে এক জায়গা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হাটাহাটি করছে। ব্যথার গতিবিধি এখন অনেকটা বৃস্টির আগে আকাশে মেঘের মাঝে বিজলী চমকানোর মত। বুকের বিভিন্ন জায়গায় ছুটাছুটি করে আর বিজলী চমকানোর মত চিলিক মারছে।
- মেঘের গর্জনের ফাকেঁ কি ঠাডা কিংবা বজ্রপাত হয়?
- দুত্তরি। তুমিনা। আমার জান যায়। আর তুমি ঠ্রাট্রা করছো।
- আচ্ছা কি করবো বলো?
- ব্যাথা ছড়িয়ে যাবার কারনে নাজু এথন আগের চেয়েও বড় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে । চেহারায় আবারও সেই মলিনতার চাপ। ঠোঁটটা একটু বাঁকা করে উহ করে শব্দ করা। মাথা এড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার দৃশ্য। সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছি আর ভাবছি, তাহলে এখন কি করি?
- চল ডাক্তারের কাছে যাই। নাজু অভিমত ব্যক্ত করল।
- ওকে। বসে থেকে লাভ নেই। চল যাই। দ্রু রেডি হয়ে নাও। ছূটে চলেছি আবারও সেই আল আবির হাসপাতালে। সেদিন ডাক্তার তাহিরের পরিবর্তে ছিল হার্টের মহিলা ডাক্তার। মিশরী ডাক্তার। অনেকক্ষণ পর সিরিয়াল পেয়ে বিস্তারিত খূলে বলতেই ও কোন কথা না বলে সরাসরি রেফার করে দিল অন্য হাসপাতালে। বললাম
- ডাক্তার, তুমি একটু পরামর্শ দাও।
- না। আমি পারবোনা। আগে তোমার স্ত্রীকে এখানে চিকিৎসা না করে বাহীরে করতে বলা হয়েছে। তুমি তাই কর। আমি রেফার করছি অন্য হাসপাতালে। ..ডাক্তার আমাকে আর বেশী কথা বলতে দেয়নি। এতিমের মতই হতাশা নিয়ে বের হয়ে রিসিপশনে গেলাম। বলা হল, আপনি আগামীদিন আসুন। কারন হার্টের রুগীকে রেফার করতে একদিন সময় লাগে।
- জানতে চাইলাম, রোগীকে কোথায় রেফার করা হয়েছে?
- জেদ্দা ন্যাশনাল হাসপাতাল।
- হিছামার। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঐ হাসপাতালটা আমার কাছে গরু ঘরের মত মনে হয়। ভাবলাম কোম্পানীতে গিয়ে হাসপাতাল পরিবর্তনের কথা বলি। কিন্তু কাজ হয়নি। ইন্সু্রেন্স কভার করবেনা।
সৌদি বিনলাদেন গ্রুপে এ ক্লাশের মেডিকেল কার্ড ফেলেও এখানে বাংলাদেশী ম্যানেজমেন্ট হওয়ার কারনে হিংসুটে লোকটা আমাকে বি ক্লাশের কার্ড দিয়েছে। কি আর করি। আফিস হতে বাসায় যাবার সময় একাকী পুরো পথ জুড়ে গান গাইলাম
.. মনের দুঃখ মনে রইলরে বুঝলিনারে সোনার চান
চন্দ্র সুর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান....।
প্রিয় ব্ন্ধূ ফার্মাসিষ্ট আজাদ ভাইকে ফোন করলাম। খুব ভাল পরামর্শদাতা ও উপকারী। বন্ধুপ্রিয এ মানুষটি ভেতরটা আমার খুব ভাল লাগে। তার এ ভদ্রতা আর পর উপাকারীতার জন্য জেদ্দার বিশাল একটা জনগোষ্টী তাকে খুব পছন্দ করে। পরের দিন বিকেলের দিকে আবির হাসপাতালে আবার ও গেলাম রেফার করা কাগজের জন্য। না। আজও এটি অনুমোদিত হয়নি। মনটা খারাপ।
আকামা মেয়াদোত্তীর্ণ। মেডিক্যাল কার্ডে ইর্ন্সরেন্স কভার না করায় ভাল হাসপাতালের পরিবর্তে গরুর বাজারে রেফার করা হল। আবার অনুমোদনে বিলম্ব। নাজুর অবস্থা দেখে কখনো দোয়া পড়ি, কখনো গান গাই, কখনো ওকে শান্তনা দিয়ে পার করছি প্রতিটি দিন আর ক্ষণ। মনে মনে ভাবছি, আল্লায় জানে, না জানি কখন বিদায়ের ঘন্টা বাজে। হার্টের ব্যাপারতো্। বলা যায়না।
আজাদ ভাই পরামর্শ দিল, সিকদার মেডিকেলে মহিলা ডাক্তার মুনিরার কাছে যেতে। সে গাইনো বিষয়ে অভিজ্ঞ হলেও হয়তবা কোন কাজে লাগতে পারে। আজাদ ভাইয়ের যুক্তি হল, ভাবীর সম্ভবত 'থাই রড' এর সমস্যা রয়েছে।
ছুটে চললাম ডাঃ মুনিরার কাছে। গত সপ্তাহে ওর সাথে এক বাসায় আমরা দাওয়াত খেয়েছি। এ প্রথম পরিচয়। যেয়ে দেখি। কাজ হলেও হতে পারে। তখন রাত ৯টা। এদিকে তিন বন্ধু অফিসে বসে আছে। আমাকে না জানিয়ে ওরা ভূল বঝাবুঝি একটি বিষয় সমাধানের জন্য মিটিং ডেকেছে। অথচ আমি জানিনা। রাত নটায় ফোন করে বলছে
- ভাই আপনি কোথায়?
- হাসপাতালে দৌড়াচ্ছি।
- কেন?
- আপনার ভাবীর হার্টের সমস্যা।
- আমরা যে আপনার জন্য সন্ধ্যা ৬টা থেকে অপেক্ষা করছি, বলবেন না?
- আপনাদের সভা সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু না বললে কিভাবে জানবো?
- এখন আসা যাবে?
- আপনাদের মাথা ঠিক আছেতো? কারো বাশঁ যায় কেউ গিরা গুনে..। হায়নের নিয়তি।
ডাক্তার মুনিরার কাছে রোগী সংখ্যা বেশী ছিলনা। যেতেই সিরিয়ালটা পেয়ে গেলাম। ও থাই রড জনিত কিছু টেষ্ট করে পরদিন যেতে বলল। আমরা তাই করলাম। বাসায় ফিরে এসে সেই পুরোনো শংকা রাত কাটানো। এভাবেই প্রতিটি বিলম্বিত রাতে অনেকটা নির্ঘুম থাকি। ভয়। না জানি কখন নাজু বলে বসে - এই শুনছ। আমার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমি ....। ভাবতেই কোন এক অজানা ভয় আমাকে নরম করে ফেলে। আমি নুইয়ে পড়ি। নাজুর অজান্তেই দোয়া করি আল্লাহর কাছে। বউ হারানোর ভয় যে কত কস্টের বুঝাতে পারবোনা। মানুষেরা বিবাহপুর্ব প্রেমে চ্যাকা খেয়ে কেন যে এত পাগল হয় এখন হাড়েঁ হাড়ে টের পাচ্ছি।
পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ ডাক্তার মুনিরার কাছে আবরও ছূটে গেলাম। সিকদার পলিক্লিনিকে নিজস্ব ল্যব না থাকায় সব টেষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তাই আপাতত ওষধ দিয়ে বাকি টেষ্টটা অন্য কোথাও করিয়ে নিতে পরার্মশ দিলল।
মুনিরার ওষধ সেবন করার পর বুকে গরম হয়ে থাকাটা চলে গেলো। কিন্তু ব্যথাটা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বাসের ভীতটা কোথাও দাঁড়া করাতে পারছিলাম না। এর মাঝে অনেকেই বলছে, ভাবী, এত বড় রোগ নিয়ে আপনি কি করে বসে আছেন। এমনটা শুনতেই কলিজাটা গাফ কর চিব মারে। স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলবো ভাবতেই যেন মনে হয় এ বুঝি আকাশটা কাঁচের টুকরোর মত মাথায় ভেঙ্গে পড়ল। দুটি সন্তান নিয়ে গড়ে উঠা সংসারকে স্রোতের সাথে ভেসে যাওয়া তৃণ লতার ভাবতেই আঁতকে উঠি। দু্ত্তরী। দেখা যাক। মনকে অভয় দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেই। নাজুকে মিছে গল্প শুনিয়ে ভরসা দেই। আগামী দিনের বেচে থাকার স্বপ্নে কল্পনায় বাসা বাধি।
ডাঃ মুনিরার ওষধ, কবিরাজী হালুয়া সবই একসাথে চলছে। সব নিয়ম কানুন সিরিয়াসলি মেন্টেইন করা হচ্ছে। হালুয়াটা দুবারের জায়গায় তিনবারও খাওয়া হচ্ছে। কারণ এটিকে সাইড ইফেক্ট নেই।
এসব খাওয়ার আগে ব্যাথা এক জায়গায় ছিল। এখন যেন ব্যাথাটা সর্ব শরীরে। কখনো ঘাড়ের নীছে। কখনো হাতে । কথনো বুকে। কখনো বুকের মাঝখানে। কখনো ঠ্যাঙ্গে। .. এই দ্যাখো দ্যাখে বলতেই যেন অন্য জায়গায় গিয়ে প্রচন্ড গতিতে ঝিলিক মেরে পালিয়ে যাচ্ছে।
আমার তিন বাসা পরেই ডাঃ শাহেদ ভাই থাকে। তিনি মক্কায় একটি সরকারী হাসপাতালে চাকুরী করেন। স্কুল সুবিধার জন্য ভাবী বাচ্ছারা এখানেই থাকে। ভাবী ও একজন ডাক্তার। ভাই সপ্তাহ শেষে জেদ্দায় এসে ঘুরে যান। এক কথায় প্রবাসেও প্রবাসী।
শুক্রবারে শাহেদ ভাইয়ের কাছে গিয়েছি। তিনি ইসিজি রিপোর্ট দেখে বললেন, যে সব কারনে ভাবীকে হার্টের রোগী বলা যাবে, ইসিজি দেখে তা বুঝা যায়না। তবুও তিনি কিছু সিমটম জানতেই চাইলেন।
- ভাবী, আপনার ব্যাথা কি বুকের বামে একটু নিছে?
- জ্যী ভাই।
- আপনার ব্যাথা কি ছড়িয়ে পড়ে না বিচ্ছিন্ন ভাবে চিলিক মারে?
- বিচ্ছিন্নভাবে চিলিক মারে।
- সিড়িতে উঠতে ব্যাথা হয়?
- না।
- হাটার সময় কোন ব্যাথা অনুভব হয়/
- না।
- সরি ভাবী। আপনার হার্টের রোগ আছে বলে আমার মনে হয়না। তারপরও এনজিওগ্রাম করলে নিশ্চিত বলা যেতো। কারন হার্টে রোগ অনেক সময় ঘূমিয়ে থাকে। বুঝা যায়না।
ডাঃ শাহেদের শেষ মন্তব্যটির শংকা নিয়ে বিদায় নিলাম। ভয়টা এখনও কাটেনি। ভাবছি, হায়রে কপাল। শেষ পর্যন্ত বুঝি এনজিও গ্রামে যেতেই হবে। না। এটা করা যাবেনা। কারন রুগী এ বিষয়ে নেগেটিভ সংবাদ অগ্রীম পেয়ে যাওয়ায় একেবারে ভীত সন্ত্রস্ত। মনে হয়, এনজিও গ্রাম করার আগেই ও মুর্চা যাবে। এনেসথেসিয়া ছাড়াই রোগী মুমুর্ষাবস্থায় পতিত হবার আশংকা। ওকে কে জানি জ্ঞান দিয়েছে, এনজিওগ্রাম মানে, পায়ের ঠিক পাকস্থলীর নীছে গুতা মেরে একটি রগকে ছিদ্র করা হবে। উহ। কি নিদারুন দৃশ্য। তারপর.. ক্যামেরা যুক্ত অনেক বড় লম্বা একটা পাইপ ঢুকিয়ে দেয়া হবে। তাও জিন্দাবস্থায়! এটি শরীরের বিভিন্ন আকাঁবাঁকা রাস্তা দিয়ে হার্টে গিয়ে পৌঁছবে। কম্পিউটারে ডাক্তার ক্যামেরার মাধ্যমে দেখে নিবে রাস্তায় কোন জ্যনজট সৃষ্টি হয়েছে কিনা। সামান্য সমস্যা হলে কোদাল দিয়েই তা পরিস্কার করা হবে। বেশী জটিল হলে ইট সিমেন্ট ছাড়াই চুঙ্গার মত এক ধরণের রিং বসানো হবে রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য। কোনটিই না হলে পায়ের গোড়ালির একটু উপর থেকে অতিরিক্ত রগের কিছু অংশ কেটে নিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তা জোড়া তালি দিয়ে মেরামত করা হবে। এ জোড়া তালি সিষ্টেমে চোখের সামনেই আমার প্রিয় বন্ধূ সোলায়মান ভাই তিন বছরের মাথায় মারা গিয়েছে..। এটি স্মরন হতেই রোগী মানসিকভাবে আধা মরা হয়ে যায়। নিরাশ চাহনিতে আমার কাছে জানতে চায়, এনজিওগ্রামরে চিকিৎসায় আমি বাচবোনা।
আরো কষ্টের বিষয় হল, এন জিও গ্রামের সময় নাকি রোগীকে হাতের পুতুলের মত উলট পালট করে দেখা হয়। এ সময়ে পুরুষ ডাক্তার ও থাকে। পদা লঙ্গিত হওবার আশংকাটি বাড়তি টেনশন হিসেবে যোগ দিয়েছে রোগীর মাথায়। ডাক্তারদের এসব কথা বার্তায় মনে হচ্ছিল, রোগী মনে হয় অবশেষে হার্টের রোগে না মরে রোগজনিত ভয়ের কারনেই মারা যাবে।
নাজুর হালুয়া আর মুনিরার ওষধ খেয়ে ভাল লাগার কথাটি গ্রামের ভাবী মুকবুলের মায়ের মতই মনে হচ্ছে। তখন আমি সবে মাত্র চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র্র। বড় ভাই ক্লাশ নাইনে পড়ে। চিওড়া হাই স্কুল। স্কুলের পাশেই চিওড়া বাজার। একদিন শীতের সকালে মকবুলের মা রৌদে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল শরীরটা বড় খারাপ। বড় ভাই ও তার বন্ধূ শফিক জিজ্ঞেস করল
- কিগো ভাবী। তোমার কি হয়েছে? খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।
- বলিসনা আর। শরীরের মতিগতি বুঝিনা। গত তিন দিন ধরে মনে হচ্ছে জ্বর জ্বর।
- আহারে। আমাদের বলোনি কেন? চিওড়া বাজারের ডাক্তার এনামের এক ডোজ ওষুধ খেলেই তুমি ভাল হয়ে যাবে। জ্বরতো কোন রোগ নয়। এটি রোগের উপসর্গ।
- কি করতে হবে? মকবুলের মা জানতে চাইল।
- ডাক্তার এনামতো ৪০-৫০ টাকার কম নিবেনা। তবে আমরা যদি বলি, আমাদের ভাবীর জন্য, তাহলে ১০ টাকা দিলেই চলবে। অবশ্য তোমাকে যেতে হবে না। আমরা মুখে বললেই ডাক্তার বুঝতে পারবে তোমার অবস্থা সম্পর্কে।
মকবুলের মা খূশী হয়ে দশ টাকা বের করে দিল। বাজারে যাবার সময় বড় ভাই শফি ভাইকে সাথে নিয়ে সরকারী হাসপাতালে চলে গেল। সেখান থেকে নিজের জ্বরের কথা বলে বিনা পয়সায় টেবলেট নিয়ে বাজারের চা দোকানে বসে এটিকে ভেঙ্গে কাগজের ৬টি পোটলা বানিয়েছে। ফেরার সময় দুপুরে মকবুলের মাকে দিয়ে বলল
- ডাক্তার এনাম বলেছে, এ ৬টি পোটলা সকাল বিকাল করে তিন দিন খাবে। এর উপর ভিত্তি করে আর এক ডোজ দিলে জ্বরের গোষ্ঠী আগামী এক বছরেও কাছে আসবেনা।
তিন দিন পর মকবুলের মা বলল, জ্বর কমেছে। এবং আগের থেকে অনেকটা ভাল লাগছে। উন্নতি দেখে আরও দশ টাকা দিয়ে দিল বাকী ডোজ আনার জন্য। আগের মত এবার ও হাসপাতাল হতে টেবলেট নিয়ে মিহি করে মকবুলের মায়ের হাতে তুলে দিল। এভাবেই মকবুলের মায়ের মানসিক জ্বর ভাল হয়ে গেল। আর বড় ভাই শফিক ভাইকে নিয়ে এক সপ্তাহ চা খাওয়ার একটা ব্যাবস্থা হয়ে গেল। আমি নাজুকে নিয়ে তাই ভাবছি। ডাক্তারদের ভীতিকর পরামর্শে মকবুলের মায়ের মত রোগী হার্টের ব্যথার চেয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার অবস্থা।
আজ আবারও আবির হাসপাতালে গেলাম থাই রডের বাকী টেষ্ট করার জন্য। কিন্তু থাই রডের চিকিৎসক রোগীর বিস্তারিত দেখে কথা বলতেই রাজী হলনা। বলল, তুমি আগে হাটের রোগ সেরে নিয়ে আস। তার পর থাই রড। ওকে কোন রকম বুঝাতে না পেরে বিদায় নিলাম।
এক সপ্তাহ পরের কথা। উপায় না দেখে জেদ্দা ন্যাশনাল হাসপাতাল নামে গরুর ঘরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম দেখা যাক কি হয়। যেতে তো আর সমস্যা নেই।
হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাক্তার দুর্গা। মহিলা ডাক্তার। ওর কাছে দেখা করেই সব কাগজ পত্র দেখালাম। ও ইসিজি রিপোর্ট দেখেই বলল, এ পর্যন্ত তোমাকে যত ওষধ দিয়েছে আজ থেকে সব বাদ।
বড় আশ্চর্য হলাম। এত বড় ডাক্তারদের পরামর্শের সাথে এ বেটির কথা পুরো দিন রাতের তফাৎ। কি কয়। এ মনে হয় আর এক সমস্যা। দুর্গাকে অতীত ডাক্তারদের কিছু কথা বলতেই জবাব দিল, কি তোমার বিশ্বাস হয়না আমাকে? আস। তোমাকে দেখাই। আমি হার্টের উপর পি এইচ ডি নিয়ে এসেছি। রোগী দেখে বুঝতে পারি ওর কি হয়েছে। চল। তোমাকে বাস্তবে দেখাই।
ও আমাদেরকে ইকো টেষ্টে নিয়ে বলল, দ্যাখ, তোমার স্ত্রীর হার্টে কোন সমস্যা নেই। এটি হার্টের সমস্যা নয়। ওর হার্ট বিট কোন সমস্যা নেই। এটি মুলত গ্যাস্টিকের সমস্যা। আজ থেকে অন্য কোন ধরনের ওষধ সেবন নিষিদ্ধ। আমি যা দেই শুধু তাই খাবে। এমনকি তোমার যে ডায়াবেটিকস, সেটিও খাবেনা।
দুর্গার কথায় মনটা ভরে গেল। এনজিওগ্রাম কিংবা অপারেশন থেকে বেঁচে যাওয়ার আশ্বাসে কলিজাটা যেন নিজেই শান্ত হয়ে গেল। রাস্তায় আসার সময় রোগীর ব্যথা যেন উধাও হয়ে গেল। রোগীকে বললাম
- এই। তোমার ব্যাথার আসল কারনটা কি জানো?
- হাহা। কথায় আছেনা, কুইনিন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইননি সারাবে কে?
- মানে, নাজু জানতে চাইল।
- তার মানে হল, একদিকে তোমার গ্যস্টিক, ডায়াবেটিকস, হাইপর টেনশন, অন্যদিকে হার্টের রোগ ভাল হবার জন্য আন্তরিকতার সাথে তুমি যে কবিরাজী ওষধ খেয়েছ, এর মাঝে আদা, রসুন, লেবুর রস, মধু এ সবই তোমার গ্যাস্টিক, ডায়াবেটিকস এর জন্য খুবই ক্ষতিকর। আর এসব কারনেই তোমার বুকের ব্যথা ছড়িড়ে কখনো পীঠে, কখনও ঠ্যাংগে, কখনো হাতে জিলিক মেরেছে..।
- হা হা। আসলেতো ঠিক। আচ্ছা না হয় আমি ভূল করলাম। কিন্তু এতগুলো বড় ডাক্তার। ওরা কি বেকুব?
তোমার কোন জিনিষটা আমার মনে বেশী দাগ কেটেছে জানো?
- কোনটা?
- গত পরশু রাতে আমার হাত ধরে যখন এতিমের মত অসহায় স্বরে বলছিলে
" ফাহীমের আব্বুরে। মনে হচ্ছে, আমি আর বাচঁবোনা...।
...দুত্তরি! তোমার কি? আমি মরে গেলেতো তুমি খুব খুশী হতে । আর একটি বিয়ে করার সুযোগ হতো।
- হাহা। তোমাদের মহিলাদের শংকা আর গেলনা। এত কিছুর পরও তোমার ভয়, না জানি.. আসলে বনের বাগের চেয়ে মনের বাঘের ভয়েই তোমরা এত অসুস্থ হও...।
বিগত একটি বছরে ঘটে যাওয়া তান্ডব যেন সব কিছুকে মাড়িয়ে দিয়েছে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সমাজের স্বার্থাম্বেষী মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা ফানুষের আঘাতে যেন মুহুর্তে সব লন্ড ভন্ড হয়ে গেল। গর্জে উঠা ঢেউয়ের অনাকাঙ্খিত ধাক্কায় পাল ছিঁড়ে গেছে। বুঝে উঠার আগেই তলানি ফেটে ঢুবে গেল সব। বেড়ে তীরে উঠার রাস্তাও ছিলনা। পাশে অনেকগুলো লাইফ বোর্ট থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি জানতে। সবার ভয়, সাহ্যয়্যর হাত বাড়িয়ে দিলে না জানি ওদের উপরও বিপদ নেমে আসে। এটি ভাল মানুষের মুখোশে সিন্ডিকেট রাজনীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপ্রতিরোধ্য ইন্দ্রজাল। এ যেন মিছে সীসা ঢালা প্রাচীরের
মাঝে উ্ইপোকার বাসা। ক্ষনিকেই কাঁচের মত প্রচন্ঢ আওয়াজে ভে্ঙ্গে পড়ার ঝনঝনানি শব্দ। ভেসে আসা তৃনলতা ধরে তীরে ভীড়েছি। একটি কঠিন ভালবাসার বন্ধন বিকট শব্দে ভে্ঙ্গে যাওয়ার সে দৃশ্যটি আমাদের আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। আজ আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়েও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এ মানুষটির মাঝে লুকিয়ে থাকা ফানুষটি বুঝি এতই নোংরা। হিংসুটে। এসব কল্পিত সোনালী অতীতকে ভাবতে ভাবতে ধমনীতে রক্তের গতি বেড়ে যায। নিঃশ্বাস আস্তে ঘন হয়ে উঠে ।নাকের ডগা দিয়ে গরম বাতাস বের হয়। শুরু হয় বুকের বাম পাশে চিন চিন করে ব্যাথা। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ও ভাবে, এ বুঝি হার্ট এ্যটাকের ব্যথা। আহ। নিস্পাশ সন্তান দুটোকে বুকে নিয়ে ও বেচে থাকতে চায়। তাই ওর মনে আকুতি জাগে , ওগো! আমার মনে হচ্ছে, আমি আর বাঁচবোনা...।
সমাপ্ত।
বিষয়: বিবিধ
৬৩৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন