বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমদিকের দিনগুলো

লিখেছেন লিখেছেন সালমান আরজু ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৬:২১:১৯ সন্ধ্যা

(পর্ব -১)

১ম বর্ষ ১ম সেমিস্টারের শুরুর দিকে প্রতিদিন সবার পেছনে বসতাম। মোরশেদ স্যার খুব ভাল পড়াতেন। তাঁর পড়ানোর আন্তরিকতা নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু আমি তারপরও কিছুই বুঝতাম না। আমার মনে হত ইউনিভার্সিটি লেভেলের এসব পড়াশুনা হ্য়তো যারা খুব প্রখর মেধাবী তাদের দ্বারাই সম্ভব। আমি হয়তো ভাগ্যগুনে চান্স পেয়েছি। এসব পড়াশুনা আমাকে দিয়ে হবে না। এর কিছুদিন পরে আমাদের পরিসংখ্যানের ক্লাস শুরু হল। ক্লাস নিতেন জিয়া স্যার। বর্তমানে কানাডায় আছেন। উল্লেখ্য মোরশেদ স্যারও এখন কানাডায়। দু' জনেই পি এইচ ডি করছেন। তো, জিয়া স্যার খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। পেছনে বসলে তাঁর কথা তেমন কিছুই শোনা যেত না। স্যারের বেশিরভাগ ক্লাস ছিল সকাল ৮টায় বা ৯টায়। আমরা ঘুম থেকে উঠেই বাস ধরতাম ক্যাম্পাসে যাবার জন্য। মাঝে মাঝে এমনও হত আমাদের কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে কোন রকমে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে বাসে উঠত একটা ব্যাগ নিয়ে। আর ক্যাম্পাসে গিয়ে ব্রাশ করত। বাসে যাবার ফলে একটু আগে-ভাগেই আমরা ক্লাসে পৌঁছতাম। এতে একটা সুবিধা হল, সামনের সারিতে বসার সুযোগ পেতাম। পাশাপাশি জিয়া স্যারের কথাগুলো ক্লাসে শুনতে পেতাম ভালভাবে। সামনে বসায় এবং স্যারের কথা শুনতে পাবার কারনে, ক্লাসে পূর্ণ মনোযোগ থাকত। ফলে আমি খেয়াল করলাম, আমি স্যারের ক্লাসের অনেক কিছুই ভালভাবে বুঝতে পারছি। কোন কিছু না বুঝলে প্রশ্ন করতে পারছি। এমনকি স্যার কোন একটা বিষয় বোঝাচ্ছেন, বা কোন একটা সিচুয়েশন ব্যাখ্যা করছেন, উদাহরণ দিচ্ছেন এসব ক্ষেত্রে আমি একটু আগ বাড়িয়েও কিছু প্রশ্ন করতে পারতাম। আমার কাছে ঐ কোর্সটা তেমন কোন কঠিন মনে হচ্ছিল না। এর ফলে স্যারের প্রথম পরীক্ষাতেই আমি ২য় সর্বোচ্চ নম্বর পেলাম। আর ফাইনালে পেলাম এ+। আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম, আমাদের ক্লাসে যারা ১-১ এ খুব নেতাগিরি দেখিয়েছিল প্রথম প্রথম তাদের নেতাগিরি পরীক্ষার রেজাল্টের পর সম্পূর্ণই উল্টে গেল। যাঁরা ভাল ফলাফল করল তারাই ক্লাসের নেতৃত্বে অটোমেটিক্যালি চলে এল। দেখা গেল এখন ক্লাসে পড়ালেখায় ভাল যারা তাদেরকেই সবাই দাম দিচ্ছে। ক্লাসে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হলে যেমন পরীক্ষা পেছানো, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সবকিছুতেই প্রথম দিকের নেতাদের গুরুত্ব দিন দিন কমে গেল। বরং ভাল রেজাল্টধারীদের মূল্যায়ন বেড়ে গেল পুরো ক্লাসে। আবার দেখলাম, ক্লাসে কিছু কিছু বন্ধুত্বের সার্কেল তৈরি হল প্রথম প্রথম। দু' এক জোড়া প্রেমও হতে দেখলাম। কিন্তু এর কিছুই বেশি দিন টেকে নাই। কিছুদিন পর আবার নতুন নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হল। নতুন প্রেম হলো কারো কারো। ক্লাসে সিগারেট খোরদের একটা গ্রুপ হল। যারা ভাল পড়ালেখা করে তাদের একটা গ্রুপ হল। সবকিছুই হল অপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু এগ্রুপ আর প্রেম গুলোই দেখলাম পরবর্তিতে টিকে গেল। যাকে বলে টেকসই!

(পর্ব -২)

প্রথম প্রথম একটা ঝামেলায় পড়লাম, পড়াশুনার সিস্টেম নিয়ে। আমাদের কেউ কেউ দেখলাম নিজে নিজেই পড়া-লেখা করে, নোট করে, মুখস্থ করে, practice করে। আমি কোন সিস্টেম না পেয়ে সরাসরি মেইন বই থেকে পড়া শুরু করলাম। আমার একটা সুবিধা ছিল, আমি নিজে নিজে বানিয়ে বানিয়ে ইংরেজিতে লিখতে পারতাম। ফলে আমি কোন কিছু নোট করে মুখস্থ করলেও, পরিক্ষার হলে গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে আরও ভাল লিখতে পারতাম। তখন আমার কাছে পড়াগুলো বুঝাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। আমি যেটা করতাম, প্রথমে মেইন রেফারেন্স থেকে reading পড়তাম। তারপর important point গুলো টুকে নিতাম কোন একটা pad এ। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আর chapter ছিল, একা একা বুঝা সম্ভব হত না। তখন বন্ধুরা মিলে group study করতাম। আমার এখন বলতে দ্বিধা নেই, group study টা যে কী পরিমাণ help করেছে আমাকে। কারন আমাদের কোন private পড়ার সিস্টেম ছিল না। আমাদের একটা বন্ধু ছিল, সে এখন একটা পাবলিক university এর teacher. ও যেটা করত, পরীক্ষা আসলে নিজের বাসায় থাকত না। বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় থেকে পড়াশুনা করে পরীক্ষা শেষ করে তারপর বাসায় যেত। যে- যে subject ভাল বুঝত, ঐ subject এর পরীক্ষার আগে সংশ্লিষ্ট বন্ধুটির বাসায় চলে যেত। আমি আরেকটা জিনিস যেটা করতাম, নিজের friend দেরকে সাধ্যমত help করতাম। ওরা কোন কিছু না বুঝলে যদি আমার কাছে আসত, আমি বুঝিয়ে দিতাম। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হত। আমার বুঝাটাও আরও clear হত। পাশাপাশি ওরা বুঝার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করত বলে, নিজেকে আরে ভাল করে বুঝতে হত। বুঝে বুঝে পড়ার কোন বিকল্প ছিল না আমার জন্য। কারন আমি দেখতাম, পরীক্ষায় স্যারেরা সরাসরি প্রশ্ন খুব কমই করতেন। সুতরাং পুরো chapter না বুঝলে answer করার কোন উপায় থাকত না। তারপরও আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো দেখতাম কীভাবে যে শুধু মুখস্থ করে পাশ করে ফেলত! সেটা এখনও আমার কাছে রহস্য! আমার একটা সুবিধা ছিল, জিয়া স্যারের ক্লাস করার পর বাকি সব ক্লাসেই ১০০% মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করতাম। ফলে কোন কিছু না বুঝলে সেটা ক্লাসেই স্যারের কাছ থেকে বুঝে নিতাম। অনেক সময় এমনও হয়েছে, আমি প্রশ্ন করার পর ক্লাসের অনেকেই বিরক্ত হত। কারন, স্যার উত্তর দিতে গেলে সবার বাস মিস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকত। তারপরও আমি আমার প্রশ্নগুলো ক্লাসেই শেষ করে আসার চেষ্টা করতাম। প্রশ্ন করলে স্যারেরা কখনই mind করতেন বলে মনে হয়নি। যারা ক্লাসে প্রশ্ন করত না, তারা পরবর্তীতে পড়তে গিয়ে স্যারের ১৪ গোষ্ঠী উদ্ধার করত। subject টাকে কঠিন মনে করত। কম পড়ত। শেষ পর্যন্ত course drop দিত। এমনও হয়েছে, কোন একটা কোর্সে আমরা অনেকেই এ+ পেয়েছি, অথচ ক্লাসের একটা বিশাল অংশ ঐ কোর্স drop দিয়েছে।

(পর্ব -৩)

চান্স পাবার পর প্রথম প্রথম বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন থাকে হয় ভাল করে পড়ালেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার হবে কিংবা একটা প্রেম করবে। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রথমটা না থাকলেও দ্বিতীয়টা ছিল। কিন্তু তারপরও এসব প্রেম- টেমের ধারে কাছে ও যাই নি। সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেল স্বপ্ন প্রথমটা বা দ্বিতীয়টা থাকল না। সত্যি বলতে কি টিচার হবার চেয়ে ভাল রেজাল্ট করাটা মুখ্য হয়ে উঠল। এ ক্ষেত্রে আমার বন্ধু মহলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের সাথে থেকে আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম, তারা সবাই ক্যারিয়ারমুখি। তাদের আলোচনায় পড়াশুনার বিষয়গুলোই বেশি আসত। মেয়েদের প্রসঙ্গ যে একেবারেই আসত না তা কিন্তু নয়। তবে সেসব ছিল শুধুমাত্র বিনোদন। আমি উপলব্দি করলাম, পড়ালেখাটাই এই মুহূর্তে মুখ্য। আমাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব দেখলাম শুরুতে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পড়ল। কাউকে দেখা গেল রাজনৈতিক দলের মিছিলে। আবার দু'একজন ছিল এমন তাদের কাজ হল- ক্যাম্পাসে কোন সংগঠন যদি কোন ধরনের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি আয়োজন করত, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হওয়া। এধরনের প্রোগ্রামগুলোর কোন কোনটিতে সার্টিফিকেট দেয়া হত। এখন তাদের CV তে দেখি এগুলো সবই উল্লেখ করা। ফলে কোন একজায়গায় চাকুরি পেতে বিশেষ করে প্রাইভেট চাকুরিতে তাদের কোন বেগ পেতে হয় না। আবার যারা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হয়েছিল, তারাও পরবর্তিতে সেসব সংগঠনের বড় বড় পদে আসীন হল, যা এখন তারা নিজেদের CV তে উল্লেখ করতে পারছে। অপরদিকে যারা রাজনীতি করত তারা কিন্তু এখন CV তে এর কিছুই উল্লেখ করতে পারছে না। তবে নিজের দল ক্ষমতায় থাকলে কিছু সুবিধা পায় তারা। অবশ্য এসব সুবিধাগুলো সবই অবৈধ। আমরা যারা একটু পড়ালেখায় ছিলাম, তাদের মাঝে দু'জন আমাদের বিভাগের টিচার হল। আরেকজন অন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছে। আমরা আরো তিনজন আছি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে জয়েন করেছে। অন্য একজন একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। শুধু মাত্র একজন ভালরেজাল্ট করেও এখন ব্যাংকে চাকুরি করছে। সে অবশ্য বি সি এস -এ পর্যন্ত ২ বার মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত গিয়েছে। এবার আবার প্রিলিমিনারিতে পাশ করেছে।

বিষয়: বিবিধ

১২৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File