শাহবাগ আন্দোলনের অসঙ্গতি

লিখেছেন লিখেছেন সালমান আরজু ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১২:১২:১৩ রাত

শাহবাগে যারা গত দুই দিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন, তাদের আন্দোলনে রয়েছে ব্যাপক অসঙ্গতি!

প্রথমত, সৌদিআরবে যখন মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়, তখন আমাদের দেশের বিবেকবানরা (?) আর সুশীল সমাজ একে একটা নিষ্ঠুর শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করে হইচই শুরু করেন। এগিয়ে আসে Amnesty International ও। তাছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে রহিত করা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের সুশীলসমাজ আজ একব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার জন্য আন্দোলনে নেমেছে!

দ্বিতীয়ত, দেশের তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’, তাদের ‘উচ্চবর্গীয় তাত্বিকগণ’, ‘আইনের শাসন’, ‘স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বিচার’, ‘গণতন্ত্র’, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’, ‘যুদ্ধাপরাধী ও তাদের হাতে আক্রান্ত উভয়ের সমঅধিকার’, ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় তত্ত্বের কথা বলেন, এবং যা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রীত ড্রইং রুম এবং ফেসবুকের চৌহদ্দিতে আটকে থাকে, তারা জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে পুঁজি করে নতুন করে নতুন করে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছেন। বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অবিশ্বাসের বিষবাষ্প, জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাইছেন – বিভ্রান্ত করতে চাইছেন।

তৃতীয়ত, তাদের দাবি মূলত রায়টা মৃত্যুদণ্ডই হবার কথা ছিল, কিন্তু আওয়ামীলীগ জামায়াতের সাথে আঁতাত করে শাস্তি কমিয়ে দিয়েছে। তাদের অভিযোগটা আওয়ামীলীগের দিকেই। মজার ব্যাপার হল, দেশব্যাপী বামদের আন্দোলনের মঞ্চে এখন আওয়ামীলীগের নেতারাই বক্তৃতা দিচ্ছেন। সরকার এ আন্দোলনে যাবতীয় সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আন্দোলনটা আসলে কার বিরুদ্ধে? আওয়ামীলীগ ? ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা?

চতুর্থত, এই যে ট্রাইব্যুনাল! এর বিচারপতি, প্রসিকিউশন সবাই কিন্তু কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁরা সবাই সরকার কর্তৃক মনোনীত। কিন্তু বিচারকের আসনে বসে সাক্ষী প্রমানের ভিত্তিতেই বিচার করতে হয়। আবেগ দিয়ে নয়। কসাই কাদের আর ৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের ছাত্র কাদের মোল্লা যে একই ব্যক্তি নয়, এটা জেনেও ট্রাইব্যুনাল একটা রায় দিয়েছে। যারা অন্যদেরকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার জন্য সবসময় নছিহত করেন, তাঁরাই এখন মাননীয় আদালতের রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। ভাবখানা এমন, বিচার মানি, তালগাছ আমার!

আর বিচারক যদি জনতার আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রায় দেন, তাহলে প্রশ্ন উঠে তিনি জনতার কোন অংশের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবেন? আপনি হয়তো বলবেন, সংখ্যা গরিষ্ঠ জনতার আবেগের প্রতি। এখন প্রশ্ন হল, কারা সংখ্যাগরিষ্ঠ? শাহবাগ মোড়ের জনতা, নাকি রবিবারের (০৪-০২-১৩) মতিঝিল? জামালখান নাকি গতকালের (০৬-০২-১৩) প্যারেড ময়দান?

পঞ্চমত, প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ''আইন ও আদালতকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সংগ্রাম করে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা মোটেও কাম্য নয়। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন। সরকারি দল এখন তার ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করছে। ওই বিক্ষোভে কেন্দ্রীয় নেতারা এমনকি মন্ত্রীরাও গিয়ে ফাঁসির দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে আরও মামলার রায় অপেক্ষমাণ। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে একটি মেসেজ যাচ্ছে। সামনে যদি কাউকে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক হবে যে, বিচারকরা সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের ভয়ে এই রায় দিয়েছেন। মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে বিচারকদের ঘাড়ে কয়টি মাথা যে তারা ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় দেবেন? কাজেই আমি বলব, ফাঁসির দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন এমনকি ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতেও যারা আন্দোলন করছেন, তারা ঠিক কাজটি করছেন না। এতে করে দেশ ভয়ানক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত।''

অথচ এ লোকগুলোই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ব্যাপারে সোচ্চার হতে দেখি!

ষষ্ঠত, যদি বিতর্কের খাতিরে ধরে নেই শাহবাগের আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেয়া হল। ফাঁসির ঘোষণা আসল কাদের মোল্লার। কিন্তু এ ঘোষণাটা কে দেবে? প্রধানমন্ত্রী? তিনি তো ট্রাইব্যুনালের কেউ না। তবে কি ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা? তাঁরা তো আদালতে না বসে, আপিলের শুনানি না করে নতুন কোন রায় দিতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি কি পারবেন এ ঘোষণা দিতে? তিনি তো সাজা প্রাপ্ত আসামীদের শাস্তি মওকুপ বা কমাতে পারেন। কিন্তু বাড়াতে কি পারেন? প্রধান বিচারপতি কি পারবেন ফাঁসির ঘোষণা দিতে? কিংবা স্পিকার ? শুধু দাবি করলাম, আর রাস্তা ছাড়ব না বললেই হল?

সর্বশেষ, একটা মজার বিষয় হল শাহবাগের সাথে তাহরীর স্কয়ারের তুলনা ! একটা মৌলিক তফাত এরকম: তাহরীর স্কয়ার রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সহায়তা ছাড়াই সফল হয়েছিল। আর শাহবাগ ঠিক তার উল্টো। তাহরীর স্কয়ার আন্দোলনের ফসল হল আজকের মিসরের ইসলামী সংবিধান। আর আমাদের শাহবাগ আন্দোলনের ফলাফল ইতিমধ্যে ধর্ষণের শিকার মহিলা পুলিশ সদস্য......

আরও যে কী কী হতে পারে তা সময়ই বলে দেবে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File