স্বামী-স্ত্রীর অধিকার
লিখেছেন লিখেছেন শান্তিপ্রিয় ২৬ জুন, ২০১৮, ১২:৫০:৪৫ দুপুর
একজন স্ত্রী যেমন স্বামী ছাড়া পরিপূর্ণ নন তেমনি একজন স্বামীও স্ত্রী ছাড়া পরিপূর্ণ নন। সৃষ্টিগতভাবেই আল্লাহ মহান এদের একজনকে অপরজনের সহায়ক এবং মুখাপেক্ষী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। একজন আদম দ্বারা কখনোই পরিপূর্ণতা লাভ করত না এই ধরাধাম। একজন হাওয়ার আগমন ঘটিয়েছিলেন তাই আল্লাহ মহান। একজন স্ত্রীর দায়িত্বে স্বামীর যেমন কিছু হক বা অধিকার রয়েছে, একজন স্বামীর দায়িত্বেও তেমনি স্ত্রীর কিছু হক বা অধিকার রয়েছে। -
আজকের আলোচনায় আমরা স্বামী-স্ত্রীর অধিকারগুলো জানার চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ।
প্রথমত: যে সব অধিকারের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সমান
১. দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সততা, বিশ্বস্ততা ও সদ্ভাব প্রদর্শন করা:
যাদের মাঝে নিবিড় বন্ধুত্ব, অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, অধিক মেলামেশা, সবচেয়ে বেশি আদান-প্রদান তারাই স্বামী এবং স্ত্রী। এ সম্পর্কের চিরস্থায়ী রূপ দিতে হলে ভাল চরিত্র, পরস্পর সম্মান, নম্র-ভাব, হাসি-কৌতুক এবং অহরহ ঘটে যাওয়া ভুলচুক ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা আবশ্যক। এবং এমন সব কাজ, কথা ও ব্যবহার পরিত্যাগ করা, যা উভয়ের সম্পর্কে চির ধরে কিংবা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। আল্লাহ বলেন: 18 وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ سورة النساء ‘তাদের সাথে তোমরা সদ্ভাবে আচরণ কর।’[সূরা নিসা: ১৮]
এই বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনخَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
‘তোমাদের মাঝে যে নিজের পরিবারের কাছে ভাল,সেই সর্বোত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে ভাল।’(তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ: ১৯৬৭ )
২. পরস্পর একে অপরকে উপভোগ করা:
এর জন্য আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রস্তুতি ও সকল উপকরণ গ্রহণ করা। যেমন সাজগোজ, সুগন্ধি ব্যবহার এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ দুর্গন্ধ ও ময়লা কাপড় পরিহার ইত্যাদি। স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা। অধিকন্তু এগুলো সদ্ভাবে জীবন যাপনেরও অংশ।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন—عَنْ ابن عباس أنَّه قَالَ: "إِنِّي لَأُحِبُّ أَنْ أَتَزَيَّنَ لِلْمَرْأَةِ كَمَا أُحِبُّ أَنْ تَزَّيَّنَ لِي
‘আমি যেমন আমার জন্য স্ত্রীর সাজগোজ কামনা করি,অনুরূপ তার জন্য আমার নিজের সাজগোজও পছন্দ করি। (বায়হাকী)
তবে পরস্পর এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উভয়কেই হারাম সম্পর্ক ও নিষিদ্ধ বস্তু হতে বিরত থাকতে হবে।
৩. বৈবাহিক সম্পর্কের গোপনীয়তা রক্ষা করা:
সাংসারিক সমস্যা নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা না করাই শ্রেয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে উপভোগ্য বিষয়গুলো গোপন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
عَنْ أَبي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ] قال: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: "إِنَّ مِنْ أَشَرِّ النَّاسِ عِنْدَ اللهِ مَنْزِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ الرَّجُلَ يُفْضِي إِلَى امْرَأَتِهِ وَتُفْضِي إِلَيْهِ ثُمَّ يَنْشُرُ سِرَّهَا" (رواه مسلم: 1437)
কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সর্ব-নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে,যে নিজের স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং যার সাথে তার স্ত্রী মিলিত হয়,অতঃপর সে এর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়। [মুসলিম]
৪. পরস্পর শুভ কামনা করা,সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়া:
আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে একে অপরকে সহযোগিতা করা। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একে অপর থেকে উপদেশ পাওয়ার অধিক হকদার। দাম্পত্য জীবন রক্ষা করা উভয়েরই কর্তব্য। আর এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে,পরস্পর নিজ আত্মীয়দের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করা ।
সন্তানদের লালন-পালন ও সুশিক্ষার ব্যাপারে উভয়েই সমান,একে অপরের সহযোগী। আল্লাহ তাআলা বলেন 2 المائدة وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ব্যপারে পরস্পরকে সহযোগিতা কর।’[সূরা মায়েদা: ২]
দ্বিতীয়ত : স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য
সুখকর দাম্পত্য জীবন, সুশৃঙ্খল পরিবার, পরার্থপরতায় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থে ইসলাম জীবন সঙ্গিনী স্ত্রীর উপর কতিপয় অধিকার আরোপ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলোচনা করছি।
১. স্বামীর আনুগত্য :
স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য। তবে যে কোন আনুগত্যই নয়, বরং যেসব ক্ষেত্রে আনুগত্যের নিম্ন বর্ণিত তিন শর্ত বিদ্যমান থাকবে।
(ক) ভাল ও সৎ কাজ এবং আল্লাহর বিধান বিরোধী নয় এমন সকল বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করা। لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন সৃষ্টির আনুগত্য বৈধ নয়।
(খ) স্ত্রীর সাধ্য ও সামর্থের উপযোগী বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করা। কারণلاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার সাধ্যের বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্বারোপ করেন না।
(গ) যে নির্দেশ কিংবা চাহিদা পূরণে কোন ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, সে ব্যাপারে স্বামীর আনুগত্য করা। আনুগত্য আবশ্যক করে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন; وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ ‘নারীদের উপর পুরুষগণ শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী।’[সূরা বাকারা: 227]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনالرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ. ‘পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বকারী। কারণ আল্লাহ তাআলা-ই তাদের মাঝে তারতম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের বিধান রেখেছেন। দ্বিতীয়ত পুরুষরাই ব্যয়-ভার গ্রহণ করে।’[সূরা নিসা: ৩৪]
উপরন্তু এ আনুগত্যের দ্বারা বৈবাহিক জীবন স্থায়িত্ব পায়, পরিবার চলে সঠিক পথে।
রাসূলে কারীম (সা.) স্বামীর আনুগত্যকে এবাদতের স্বীকৃতি প্রদান করে বলেন—
عَنْأَبِي هُرَيْرَةَ وأَنَسِ بْنِ مَالِكٍ وَعَبْدِ الرَّحْمَن بْنِ عَوْفٍ رَضِيَ الله عَنْهُمْ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا صَلَّتِ المَرْأَةُ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَحَفِظَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ زَوْجَهَا قِيلَ لَهَا ادْخُلِي الجَنَّةَ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الجَنَّةِ شِئْتِ- مسند أحمد
যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে,রমযান মাসের রোযা রাখে এবং নিজের লজ্জাস্থান হেফাযত করে ও স্বীয় স্বামীর আনুগত্য করে,সে,নিজের ইচ্ছানুযায়ী জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে। [মুসনাদে আহমদ: 1573]
স্বামীর কর্তব্য, এ সকল অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করা। স্ত্রীর মননশীলতা ও পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সত্য-কল্যাণ ও উত্তম চরিত্রের উপদেশ প্রদান করা কিংবা হিতাহিত বিবেচনায় বারণ করা। উপদেশ প্রদান ও বারণ করার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ ও উন্নত মননশীলতার পরিচয় দেয়া । এতে সানন্দ চিত্তে ও স্বাগ্রহে স্ত্রীর আনুগত্য পেয়ে যাবে।
২. স্বামী-আলয়ে অবস্থান:
নেহায়েত প্রয়োজন ব্যতীত ও অনুমতি ছাড়া স্বামীর বাড়ি থেকে বের হওয়া অনুচিত। মহান আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নারীদের ঘরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের সম্বোধন করে বলেন وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ সকল নারীই এর অন্তর্ভুক্ত
‘তোমরা স্ব স্ব গৃহে অবস্থান কর, প্রাচীন যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না। ’[সূরা আহযাব: ৩৩]
স্ত্রীর উপকার নিহিত এবং যেখানে তারও কোন ক্ষতি নেই, এ ধরনের কাজে স্বামীর বাধা সৃষ্টি না করা। যেমন পর্দার সাথে, সুগন্ধি ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরিহার করে বাইরে কোথাও যেতে চাইলে বারণ না করা। ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
لَا تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللهِ مَسَاجِدَ اللهِ. البخاري (849)
আল্লাহর বান্দিদেরকে তোমরা আল্লাহর ঘরে যেতে বাধা দিয়ো না।[বুখারী: ৮৪৯]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা: এর স্ত্রী যয়নব সাকাফী রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বলতেন—
عَنْ زَيْنَبَ امْرَأَةِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ، قَالَتْ : قال لَنَا رَسُولُ اللهِ ﷺ إِذَا شَهِدَتْ إِحْدَاكُنَّ الْمَسْجِدَ فَلَا تَمَسَّ طِيبًا . مسلم (674)
তোমাদের কেউ মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছে করলে সুগন্ধি ব্যবহার করবে না।[মুসলিম: ৬৭৪]
৩. নিজের ঘর এবং সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা:
স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ করা। স্বামীর সাধ্যের অতীত এমন কোন আবদার কিংবা প্রয়োজন পেশ না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ البخاري (2546)
‘স্ত্রী স্বীয় স্বামীর ঘরের জিম্মাদার। এ জিম্মাদারির ব্যাপারে তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা হবে।’[বুখারী ২৫৪৬]
৪. যথাযথ মর্যাদা দানঃ স্বামী অবশ্যই তার স্ত্রীকে যথারীতি সম্মান ও মর্যাদা দিবেন। স্বামীকে ভালভাবে মনে রাখতে হবে, স্ত্রী তার অধিনস্থ কর্মচারী, দাসী কিংবা পরিচারিকা নয়। সংসারে স্ত্রী তার সহযোগী। সমাজ সংসারে স্বামী স্ত্রী উভয়ের সম্মান ও মর্যাদা সমান। এসম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ স্ত্রীরা তোমাদের ভূষণ এবং তোমরাও তাদের ভূষণ স্বরূপ।"
৫. স্বামীর অপছন্দনীয় এমন কাউকে তার ঘরে প্রবেশের অনুমতি না দেয়া:
হোক না সে নিকট আত্মীয় কিংবা আপনজন। যেমন ভাই-বেরাদার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন―
وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُونَهُ، فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ مسلم
তোমাদের অপছন্দনীয় কাউকে বিছানায় জায়গা না দেয়া স্ত্রীদের কর্তব্য। তবুও যদি তার এমনটি করে, তাহলে তাদেরকে মৃদু প্রহার করো, যা ফুটে না উঠে [মুসলিম ১২১৮]
৬. স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত নফল রোযা না রাখা:
কারণ, রোযা নফল—আনুগত্য ফরজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي ﷺ قال : لا يَحِلُّ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَصُومَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ إِلا بِإِذْنِهِ . رواه البخاري (5195) ومسلم ( 1026
নারীর জন্য স্বামীর উপস্থিতিতে অনুমতি ছাড়া রোযা রাখা বৈধ নয়। অনুরূপ ভাবে অনুমতি ব্যতীত তার ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়াও বৈধ নয়।[বুখারী: ৫১৯৫, মুসলিম: ১০২৬]
তৃতীয়ত : স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য, সুখকর দাম্পত্য জীবন, সুশৃঙ্খল পরিবার, পরার্থপরতায় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থে ইসলাম জীবন সঙ্গী স্বামীর উপর কতিপয় অধিকার আরোপ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এখানে প্রদত্ত হল।
১. দেন মোহর
নারীর দেন মোহর পরিশোধ করা ফরজ। এ হক তার নিজের, পিতা-মাতা কিংবা অন্য কারো নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন— 4وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً النساء ‘তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে স্ত্রীদের মোহরানা দিয়ে দাও।’ [সূরা নিসা: ৪]
২. ভরণ পোষণ:
সামর্থ ও প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা স্বামীর কর্তব্য। স্বামীর সাধ্য ও স্ত্রীর মর্তবার ভিত্তিতে এ ভরণ-পোষণ কম বেশি হতে পারে। অনুরূপভাবে সময় ও স্থান ভেদে এর মাঝে তারতম্য হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللهُ لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا.
বিত্তশালী স্বীয় বিত্তানুযায়ী ব্যয় করবে। আর যে সীমিত সম্পদের মালিক সে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত সম্পদ হতেই ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ দিয়েছেন, তারচেয়ে’ বেশি ব্যয় করার আদেশ কাউকে প্রদান করেন না। (সূরা তালাক: ৭)
৩. স্ত্রীর প্রতি স্নেহশীল ও দয়া-পরবশ থাকা
স্ত্রীর প্রতি রূঢ় আচরণ না করা। তার সহনীয় ভুলচুকে ধৈর্যধারণ করা। স্বামী হিসেবে সকলের জানা উচিত, নারীরা মর্যাদার সম্ভাব্য সবকটি আসনে অধিষ্ঠিত হলেও, পরিপূর্ণ রূপে সংশোধিত হওয়া সম্ভব নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلَاهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ، فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا صحيح البخاري
তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী। কারণ,তারা পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্ট।পাঁজরের উপরের হাড়টি সবচে’বেশি বাঁকা। (যে হাড় দিয়ে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে) তুমি একে সোজা করতে চাইলে,ভেঙে ফেলবে। আবার এ অবস্থায় রেখে দিলে,বাঁকা হয়েই থাকবে। তাই তোমরা তাদেরকল্যাণকামী হও,এবং তাদের ব্যাপারে সৎ-উপদেশ গ্রহণ কর। (বুখারী)
৪. স্ত্রীর ব্যাপারে আত্মমর্যাদাশীল হওয়া:
হাতে ধরে ধরে তাদেরকে হেফাজত ও সুপথে পরিচালিত করা। কারণ, তারা সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল, স্বামীর যে কোন উদাসীনতায় নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর ফেতনা হতে খুব যত্নসহকারে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন—
عن أُسَامَةَ بْن زَيْدٍ ] عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: "مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنْ النِّسَاءِ. البخاري (4706)
‘আমার অবর্তমানে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর কোন ফেতনা রেখে আসিনি।’(বুখারী: ৪৭০৬)
৫. যৌতুক না নেয়াঃ
যৌতুকের সংজ্ঞা দেয়ার দরকার নাই। এটা সবাই জানেন যে, যৌতুক হারাম। যৌতুক নয় স্ত্রীই বড়। যৌতুক তো নেয়াই যাবেই না উপরন্তু মোহরানা সঠিকভাবে আদায় করতে হবে। এসম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَأُحِلَّ لَكُم مَّا وَرَاءَ ذَٰلِكُمْ أَن تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُم مُّحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ ۚ
অর্থ,বিবাহ নিষিদ্ধ নারী ছাড়া অন্যান্য নারী তোমাদের জন্য বিবাহ করা হালাল। তবে শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে অর্থের মাধ্যমে তালাশ করবে ব্যভিচারের জন্য নয়। (সূরা নিসা: ২৪) (এখনে মহরের কথা বলা হয়েছে)
৬. স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করাঃ
যুক্তিসঙ্গত কারণে যদি একের অধিক বিবাহ করতে হয়, তবে সকল স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে হবে। অধিকার আদায়ের ব্যাপারে কমবেশি করা যাবেনা। তবে একজনকে বিবাহ করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর বানীঃ
فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً
অর্থাৎ, নারীদের মধ্যে পছন্দমত দুই, তিন বা চারজন পর্যন্ত বিয়ে করতে পার। আর যদি তোমরা ভয় কর যে, স্ত্রীদের মাঝে অধিকার আদায়ে ইনসাফ করতে পারবে না তবে একজনকেই বিবাহ কর। (সূরা নিসা: ৩)
৭. শাসন করাঃ
সর্বদা স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে দুর্ব্যবহার করা যাবেনা। তবে যদি স্ত্রী ইসলামী অনুশাসন না মেনে চলে তবে সামীর কর্তব্য হল শাসন করা। এসম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
وَاللاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلا (34)
অর্থ,স্ত্রীদের মধ্যে যারা অবাধ্য হবে তাদের সদুপদেশ দাও। এতেও যদি কাজ না হয় তবে বিছানা পৃথক করে দাও। এরপরও যদি অবাধ্যচারিতা অবলম্বন করে তবে মৃদু প্রহার কর। অতঃপর এতে যদি তারা অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে নতুন কোন পথ চিন্তা কর না। (নিসা:৩৪)
৮. কৌতুক করাঃ
স্ত্রীকে প্রফুল্ল রাখার জন্য নির্দোষ হাসি তামাশা ও কৌতুক করাও রাসুলের সুন্নাত। রাসুল (স আনন্দময় পরিবার অব্যাহত রাখার জন্য স্ত্রীদের সাথে কৌতুক করতেন।
৯. উপহার দেয়াঃ
বিভিন্ন উপলক্ষ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে উপহার দিবেন। তবে উপহার দামি হওয়া শর্ত নয়, সাধ্যমত আর কি! এতে পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর ও সুদৃঢ় হবে। রাসুল (স বলেনঃ
عن أبي هريرة ] قال قال رسول الله ﷺ : تَهَادُّوْا تَحَابُّوْا رواه البخاري في الأدب المفرد،
'তোমরা উপহার দাও, ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে।'
১০. বেশি দিন প্রবাসে না থাকাঃ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অন্যতম কর্তব্য হল, স্ত্রীকে একা রেখে বেশিদিন প্রবাসে না থাকা। এতে স্ত্রীর নিরাপত্তা ও জৈবিক চাহিদা বিঘ্নিত হয়। হযরত ওমর (রা বলেনঃ স্বামীদের চারমাসের বেশি স্ত্রীর সঙ্গ হতে দূরে থাকা ঠিক নয়। সমঝোতা করে এরচেয়ে বেশিদিন থাকা বৈধ।
আজ সমাজ, পরিবার ও দাম্পত্য জীবনে অশান্তির মূল কারণ আল্লাহর দেয়া সীমারেখা মেনে না চলা। স্বামীরা যদি স্ত্রীদের ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য গুলো সঠিকভাবে পালন করত, তবে এই অশান্তি ও কলহ বিবাদ থাকতো না। আর স্ত্রীরাও যদি স্বামীর প্রতি তাদের দায়িত্ব কর্তব্যগুলো সঠিকভাবে পালন করত তবে স্বামীর সাথে কলহবিবাদ হতো না। দাম্পত্য জীবন সুখময় করতে আল্লাহর বিধিমালা মেনে চলা ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নাই। কোন মানবরচিত মতবাদের ভিত্তিতে শিয়াল পন্ডিতরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি দিতে পারবেনা।
তাই আজ থেকে শপথ নেই, আমরা স্ত্রীরদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করবো, তাদেরকে বুঝাবো তাদের অধিকার সম্পর্কে এবং তাদের অধিকার যথাযথ আদায় করবো ইনশা আল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন
বিষয়: বিবিধ
১১১৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যদিও আমি বিবাহিত জেনে রাখলাম কাজে আসবে
০ এখানে তাদের বলতে কাকে বোঝানে হয়েছে এবং তোমরা বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে?
০ পরিবার বলতে কি স্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে ? স্ত্রী যেটা পছন্দ করে বা যেটা চাইবে - সেভাবে চললে ভাল বলা হবে -তাই কি ?
হাদিসে এটাও আছে '' মায়ের পায়ে নিচে সন্তানের বেহেশত'' । আর কে না জানে যে মায়ের প্রতি ছেলের অনুগত থাকা স্ত্রীদের কাছে কখনই ভাল লাগে না । এই ভাল লাগাটা আনতে পারলে সর্বোত্তম হতে আর কি লাগে ! এই ভাল লাগাটাও কি আনতে হবে ?
০ ব্যাপারটা হিন্দী সিরিয়ালের সাজগোজের মত হওয়া লাগবে?
০ কথাটির মানে কি ? স্ত্রী পরকীয়া করলেও সেটা বলা যাবে না ?
০০ স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য কারণ তারা স্ত্রীদের জন্য ব্যয় করে - সূরা নিসা এর ৩৪ নং আয়াতে (সম্ভবত) এরকম বলা আছে।
বাস্তব চিত্র হচ্ছে - ৯০% স্ত্রীই স্বামীর অনুগত হয় না বা থাকে না, তা স্বামী তার জন্য যত বড় ব্যয়ই করুক না কেন ।
সেক্ষেত্রে স্বামী কি এটা করতে পারবে যে , স্ত্রীর জন্য শত ব্যয় করার পরও যেহেতু সে অনুগত হচ্ছে না সেহেতু স্ত্রীর জন্য সে আর ব্যয়ই করবে না !
০ স্বীয় স্বামীর আনুগত্য না করে যদি বাকিগুলো পূরণ করে তাহলেও কি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না ?
০ আল্লাহর ঘরের চেয়ে উনাদের বেশী পছন্দ মার্কেটে যাওয়া।
০ জিম্মাদার এর মানেটা কি হবে ? তার ঘর দোড় ঠিকঠাক রাখা । রান্না বান্না করা , কাপড় চোপড় ধোঁয়া , ঘর মোছা - এগুলো? নাকি শুধুই সন্তান ধারণ করা আর লালন পালন করা?
০ স্বামীর অপছন্দনীয় কাউকে তো স্ত্রীরও পছন্দ হবার কথা না! আর এ অপছন্দনীয় কেউ যদি স্ত্রীর মা , বাবা , ভাই-বোন বা কাছের কোন আত্মীয় হয় - তাহলে তো পরিবার তথা স্ত্রীর কাছে 'ভাল নয়' বলে গন্য হবে এবং সর্বোত্তম হওয়ার চান্স হারাবে।
০ এটার কারণ কি সেক্স করা ছাড়া অন্য কিছু?
০০ মোহরানা নির্ধারণ করবে কে ? যে নিবে সে , নাকি যে দিবে সে ?
ভরণ পোষণই বা কার স্ট্যাটাস অনুযায়ী হবে ?
- স্ত্রী যদি মোহরানার অংকে খুশি না হয় বা ভরণ পোষন তার চাহিদানুযায়ী না পায় - তাহলে?
০ ক্বুরআন ও হাদিস উভয়েই মৃদু প্রহার করার কথাটা এসেছে। এই মৃদু প্রহার করার কারণে যদি ''নারী নির্যাতন '' আইনে মামলা ঠুকে দেয় সেটাতে কি স্ত্রীর দোষ হবে?
০ সেটা কি রকমের ?
০ স্বামী না হয় দিল, এটা ফ্রিকুয়েন্টলিই তারা করে। স্ত্রী কি উপহার দিবে স্বামীকে ?
(আল্লাহ আমাকে ও আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন)
মন্তব্য করতে লগইন করুন