সূরা কাহ্ফ-এ বর্ণিত তৃতীয় ঘটনা - যুলকারনাইন

লিখেছেন লিখেছেন শান্তিপ্রিয় ৩১ আগস্ট, ২০১৫, ০১:০৭:৪২ দুপুর



গ) যুলকারনাইনের কাহিনীঃ-

আসহাবে কাহ্ফ এবং মুছা (আঃ) ও খিযিরের ঘটনার পর মক্কার ইহুদী ও কাফের-রা রাসূলুলল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াতের সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য তৃতীয় প্রশ্নটি করেছিল যে, যুলকারনাইন কে এবং তার কাহিনীই বা কি? তাছাড়াও এ কাহিনী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করার কারণ ছিল এই যে, তৎকালীন সময়ে এ নিয়ে মতভেদ চলছিল। কাজেই কাফের-রা ইহাকে জটিল মনে করেই এ প্রশ্নটি বেছে নিল। তাই প্রশ্ন উস্থাপনকারী ইহুদীদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য মহান রব্বুল আলামীন তার প্রিয় নবীর জবানীতে যুলকারনাইনের কাহিনী বর্ণনা করে শুনান। যুলকারনাইন একজন সৎ ও ন্যায় পরায়ন বাদশাহ ছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করেছিলেন। এসব দেশে তিনি সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁকে লক্ষ্য অর্জনে জন্য সর্ব প্রকার সাজ সরঞ্জাম দান করা হয়েছিল। তিনি দিগি¦জয়ে বের হয়ে পৃথিবীর তিন প্রান্তে পৌঁেছছিলেন। যেমন : প্রথমে পাশ্চাত্যের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ সূর্যাস্তের দেশে, পরে প্রাচ্যের শেষ প্রান্তে অর্থ্যাৎ সূর্যোদয়ের দেশে এবং উত্তরে পর্বতমালার পাদদেশ পর্যন্ত।

যুলকারনাইন নামকরণের হেতু সম্পর্কে বহু উক্তি ও তীব্র মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়, কেউ বলেন তার মাথার চুলে দুটি গুচ্ছ ছিল। তাই তাকে যুলকারনাইন অর্থ্যাৎ দুই গুচ্ছ ওয়ালা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন পাশ্চত্যও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করার কারণে তাকে যুলকারনাইন খেতাব ভূষিত করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যুলকারনাইন নামে পৃথিবীতে একাধিক ব্যক্তি খ্যাতি লাভ করেছেন। এবং এটাও আশ্চর্যের ব্যাপার যে, প্রতিযুগের যুলকারনাইনের সাথে সিকান্দার (আলেকজান্ডার) উপাধিটিও যুক্ত রয়েছে। কুরআনে বর্ণিত যুলকারনাইন কে? তিনি কোন যুগে বা কার আমলের ছিলেন? এ সর্ম্পকে আলেমদের উক্তি বিভিন্নরূপ: ইবনে কাসীরের মতে যুলকারনাইনে আমল ছিল দুই হাজার বছর পূর্বে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর আমল। ইবনে কাসীর ”আলবেদায়াহ ওয়ান্নেহায়াহ” গ্রন্থে বর্নণা করেছেন যে, যুলকারনাইন পদব্রজে হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করলে হযরত ইবরাহীম (আ.) মক্কা থেকে বের হয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর জন্য দোয়া করেন এবং কিছু উপদেশও দেন। আরও বর্ণিত আছে যে, যুলকারনাইন ইবরাহীম (আ.) এর সাথে তাওয়াফ করেন এবং কুরবানী করেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য একজন স¤্রাটও রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে যেসব বিষয় অত্যাবশ্যকীয় ছিল মহান রব্বুল আলামীন যুলকারনাইন-কে ন্যায় বিচার শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও দেশ বিজয়ের জন্য সেযুগে যা যা দরকার ছিল তা সবই দান করেছিলেন। কোন কোন রেওয়াতে রয়েছে যে, সমগ্র বিশ্বে শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাকারী ৪জন সম্রাট অতিক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে দুজন ছিলেন মুমিন ও দুজন ছিলেন কাফের। মুমিন দুজন হলেন হযরত সোলায়মান (আঃ) ও সেকান্দর যুলকারনাইন এবং কাফের দুজন হলেন - নমরূদও বখতে-নসর।

সর্ব প্রথম যুলকারনাইন পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে অর্থাৎ সূর্যাস্তের দেশে জনপদের শেষ সীমার অভিযান শুরু করেন। তিনি পশ্চিম প্রান্তের সে সীমা পর্যন্ত পৌঁছান যার পর আর কোন জনবসতি ছিল না। সেখানে তিনি সূর্যকে এক কালো বর্ণের পানির মধ্যে ডুবতে দেখলেন। অর্থ্যাৎ সমুদ্রের মধ্যে ডুবতে দেখলেন। কেননা সমুদ্রের স্থানে স্থানে পানি কালো বর্ণের হয়। বস্তত: সূর্যের পাড়ে দাড়ালে মনে হয় সূর্য পানিতে ডুবছে। তথায় তিনি এক জাতিকে দেখতে পেলেন যারা কাফের ছিল তখন আল্লাহ বললেন, হে যুলকারনাইন! আপনি ইচ্ছা করলে প্রথমেই কুফরের কারণে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারো অথবা ইচ্ছা করলে সদয় বা নম্র ব্যবহার করতে পারো। অর্থাৎ প্রথমে ইসলামের দাওয়াত, তাবলীগ ও উপদেশের মাধ্যমে তাদেরকে ঈমান আনয়ন ও ইসলাম ধর্মে দাখেল হতে আদেশ করতে পারো। এরপর যারা মানে তাদেরকে প্রতিদান আর যারা না মানে তাদেরকে শাস্তি দিও। প্রতুত্তেরে যুলকারনাইন বললো- আমি প্রথমে তাদেরকে উপদেশের মাধ্যমে তাওহীদের পথে আনার চেষ্টা করব। এরপরও যারা কুফরে দৃঢ়পদ হয়ে থাকবে তাদেরকে শাস্তি দিব। পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং সৎকর্ম করবে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।

সূরা কাহ্ফের ৮৬ নং আয়াত পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যুলকারনাইন-কে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সম্বোধন করে এ ক্ষমতা দিয়েছিলেন। অতঃপর সেকান্দর যুলকারনাইন পাশ্চাত্য দেশসমূহ জয় করার পর প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করার মানসে পৃথিবীর পূর্বদিক অর্থাৎ সূর্যোদয়ের দেশে আরেক অভিযান শুরু করলেন। যখন তিনি সূর্যোদয়ের স্থানে অর্থাৎ পৃথিবীর জন বসতীর শেষ প্রান্তে পৌঁছিলেন সেখানে তিনি সূর্যকে এমন এক সম্প্রদায়ের বসতীর উপর উদিত হতে দেখলেন যাদের জন্য আল্লাহ সূর্যের সম্মুখে কোন আবরণ রাখেননি। অর্থাৎ ঐ জাতি গৃহাদি নির্মাণ করতে জানত না। তারা মুক্ত আকাশের নিচে বসবাস করত। কিন্তু যুলকারনাইন এই সম্প্রদায়ের সহিত কিরূপ ব্যবহার করেছিলেন যা তিনি পাশ্চাত্যের লোকদের সহিত করেছিলেন বলে বুঝা যায় তা তিনি ব্যক্তি করেননি। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করার পর তার তৃতীয় ভ্রমণের লক্ষ্যস্থল ছিল উত্তর দিক। যেহেতু পৃথিবীর উত্তরাংশে জনবসতি অধিক। অবশেষে যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছিলেন তখন সে উহাদের নিকট এক জাতিতে দেখতে পেলেন। এ জাতি কথাবার্তা খুব কমই বুঝত। অর্থাৎ তারা তাদের ভাষাভাষী হওয়ায় অন্য ভাষার কথাবার্তা একেবারেই বুঝত না। অন্যদিকে, জংলী এবং অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়ায় ভাষা বুঝবার চেষ্টাও করত না। তারা বলল, হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্প্রদায় এ অঞ্চলে চরম অশান্তির সৃষ্টি করছে। তারা এশিয়ার উত্তর-পূর্ব দেশগুলির উপর ধ্বংসাত্মক বর্বর হামলা চালিয়ে আসছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ইয়াজুজ-মাজুজ কারা? কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে এতটুকু নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজুজ-মাজুজ মানব সম্প্রদায়ভুক্ত অন্যান্য মনিবের মত তারাও নূহ (আঃ) এর সন্তান সন্ততি। অধিকাংশ হাদীসবিদও ইতিহাসবিদগণ তাদেরকে ইয়াফেস ইবনে নূহের বংশধর সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু ইয়াজুজ-মাজুজ শুধু তাদেরই নাম যারা বর্বর, অসভ্য ও রক্তপিপাসু যালেম ইয়াজুজ-মাজুজের সংখ্যা বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার চাইতে অনেক গুণ বেশি, কমপক্ষে একও দশের ব্যবধান। ইয়াজুজ-মাজুজ যে জনবসতীর উপর হামলা চালায় সে জন বসতীর প্রবেশ পথে দুইটি পাহাড় আছে। এগুলি ইয়াজুজ-মাজুজের পথে বাধা ছিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যবর্তী গিরিপথ দিয়ে এসে তারা আক্রমন চালাত। উক্ত জন বসতীর লোকজন যুলকারনাইনকে একটি বড় প্রাচীর বা দেয়াল নির্মাণ করে দুই পর্বতের মাঝে গিরিপথ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন। প্রয়োজনে তারা যুলকারনাইনকে অর্থ সংগ্রহ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। জবাবে যুলকারনাইন বলেন- আমার রব্ব আমাকে যে সম্পদের অধিকারী করেছেন তাহাই প্রচুর। অতএব, তোমরা কেবল দৈহিক শক্তির মাধ্যমে খাটুনি দিয়ে আমাকে সাহায্য কর। আমি তোমাদের এবং ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায়ের মধ্যে মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করে দিব। যাতে করে তারা এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে না পারে। অবশেষে যখন দুই পর্বতশৃংগের মধ্যবর্তী স্থানকে লৌহপাত দ্বারা স্তরে স্তরে সাজায়ে পর্বতদ্বয়ের সমান করে ফেলল, তখন যুলকারনাইন আদেশ দিলেন এবার তোমরা এটিকে তাপাইতে থাক। যখন তারা ইহাকে তাপাইতে তাপাইতে অগ্নিরমত লাল করে ফেলল তখন বললেন এবার তোমরা আমার নিকট প্রজ্বলিত তামা নিয়া আস, আমি উহাতে ঢেলে দেবো। এভাবেই তিনি দুই পর্বতের গিরিপথকে একটি সুবিশাল লৌহ প্রাচীর দ্বারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে ইয়াজুজ-মাজুজের লুটতরাজ থেকে এ এলাকার জনগণ নিরাপদ হয়ে যায়। এই লৌহ প্রাচীর এমন ছিল যে, উহার উপর দিয়ে পার হয়ে আসা অথবা উহাতে সুড়ঙ্গ তৈরী করে এ পারে আসা তাদের জন্য খুবই দুস্কর ছিল। রাসূল (সা.) এর সময়ে ঐ প্রাচীরে সামান্য ছিদ্র হয়েছিল। ইয়াজুজ-মাজুজেরা প্রত্যহ যর্ষণ করে উহাকে পাতলা করে। কিন্তু পরের দিন আলৌকিকভাবে ইহা আবার পুরু হয়ে যায়। রসূল (সা.) বলেন। ইয়াজুজ-মাজুজরা প্রত্যহ যুলকারনাইনের দেয়ালটি খুড়ঁতে থাকে। খুড়ঁতে খুড়ঁতে এক সময় তারা এ লৌহ প্রাচীরের প্রান্ত সীমার এত কাছা কাছি পৌঁছে যায় যে, অপর পার্শ্বের আলো দেখা যেতে থাকে। কিন্তু তারা একথা বলে ফিরে যায় যে, বাকী অংশটুকু আগামীকাল খুড়ব কিন্তু আল্লাহ তায়ালা দেয়ালটিকে আবার মজবুত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন। কিন্তু যেদিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মুক্ত করার ইচ্ছা করবেন (কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে) সেদিন খনন ও ঘষাশেষে তারা বলবে- ইনশা আল্লাহ আগামীকল্য বাকী অংশটুকু খুঁড়ে ওপারে চলে যাব। বস্তত: সেদিন এ লৌহপাত আর পুরু হবেনা। ফলে পরদিন প্রাচীর ভেঙ্গে সকলে বের হয়ে পড়বে। এরা মানব জাতি হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সংখ্যায়ও অনেক বেশি। ঈসা (আ.) বিশিষ্ট সহচর বৃন্দসহ তুর পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিবেন, ইয়াজুজ-মাজুজেরা সকলে এক অস্বাভাবিক মৃত্যুতে পতিত হবে।

ইয়াজুজ-মাজুজ ও যুলকারনাইনের কাহিনী থেকে প্রশ্নকারীদের কে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, তোমরা দুনিয়াতে সামান্য মাতাব্বারি লাভ করেই গর্বে ও আত্মঅহংকারে ফুলে ফেঁপে উঠেছ। অথচ যুলকারনাইন এতবড় শাসক, দিগি¦জয়ী ও এতসব বিরাট উপায় উপাদানের অধিকারী হয়েও নিজের প্রকৃত অবস্থান কে কখনও ভুলে যান নি। এবং আল্লাহ সম্মুখে সর্বদাই মাথা নত করে রেখেছেন। তোমরা তোমাদের সামান্য ঘর-বাড়ি ও বাগ-বাগীচার বসন্ত চাকচিক্যকে চিরন্তন ও অক্ষয় মনে করে বসেছ। কিন্তু যুলকারনাইন দুনিয়ার সর্বাধিক সুরক্ষিত প্রাচীর নির্মাণ করেও মনে করত যে, আসল ভরসা করার যোগ্য আল্লাহ, এ প্রাচীর নয় আল্লাহর মর্জী যতদিন থাকবে ততদিন এ প্রাচীর দুশমনদের প্রতিরোধ করতে থাকবে। আর যখন উনার মর্জী অন্য রকম কিছু হবে তখন এ প্রাচীরেও ফাটল ও ছিদ্র দেখা দিবে। অর্থাৎ তাওহীদ ও পরকাল নিঃসন্দেহে সত্য। সেই হিসেবে দুনিয়ার মানুষ নিজেদেরকে সংশোধন করে নিবে। তা না করলে নিজেদের জীবন বিনষ্ট হবে এবং যাবতীয় কৃতকর্ম নিষ্ফল ও বরবাদ হয়ে যাবে।

বিষয়: বিবিধ

২২৮৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

338818
৩১ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০২:১৭
কুয়েত থেকে লিখেছেন : মাশা'আল্লাহ খুবই ভালো লাগলো সুন্দর লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
338823
৩১ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০২:৫৩
হতভাগা লিখেছেন : শুনেছি , জুলকারনাইন সোলাইমান (আঃ) এর একজন সেনাপতি ছিলেন
338869
৩১ আগস্ট ২০১৫ বিকাল ০৫:৫০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
তবে এই বিষয়ে সহিহ হাদিস পড়তে চাই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File