ভাষা দিবস: কিছু প্রশ্ন কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন শান্তিপ্রিয় ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৩:৪৭:১১ দুপুর
২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মানুষের মুখের বাহনই ভাষা। কে কোন্ ভাষায় কথা বলবে, তা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এজন্য পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তা মানুষের জন্য আল্লাহর এক নিয়ামত। ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু সে অধিকার নিয়েও ইতিহা সের এক কালো অধ্যায় রচিত করলো তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন-শোষনের শেষ লগ্নে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পৃথিবীর মানচিত্রে রাষ্ট্রের অভদ্যয় ঘটে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। মুসলিম অধিবাসীদের দেশ পাকিস্তান।
তৎকালীন পূর্ব বাংলা (আজকের বাংলাদেশ) মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের সমীকরণে র্যাড ক্লিফের সীমানা নির্ধারণী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের মানচিত্রে স্থান পায়। আমাদের পরিচিতি লাভ করে পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। অবশ্য মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালী মুসলমান নেতৃবৃন্দের অবদান ছিল শীর্ষে। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক সমন্বয় না থাকলেও ঐক্যের একটি বড় তথা প্রধান নিয়ামক ছিল ধর্ম, অর্থাৎ ইসলাম। যাদের জীবনে ইসলামের অনুশাসন নেই, তারা কিভাবে ইসলামের সাম্যের ভিত্তিতে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে? তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার সূচনাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর তা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে। উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা করা নিয়ে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, তখন পাকিস্তানের জনগণের ৫৪% ছিল বাঙালী, মাত্র ৪% লোক কথা বলতো উর্দূতে। বাকী ৪২% লোক কথা বলতো পাঞ্জাবী, বালুচী সিন্ধি, পশতু প্রভৃতি ভাষায়। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী শতকরা ৪% ভাগ মানুষের মুখের ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণা করলো। তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিলো অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক। সঙ্গত কারণে বাঙালী জনগণ তা মানতে পারেনি। তবুও বাঙালী জনগণ সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা মেনে নিয়ে এর পাশা-পাশি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে দাবী জানালো। কিন্তু শাসকচক্র এই ন্যায্য দাবী নাকচ করে দিলো। বাঙালীরা দাবী আদায়ে সচেষ্ট হলো। বাঙালী মুসলমানদের বুদ্ধি ভিত্তিক সংগঠন “তমদ্দুন মজলিসের” ব্যানারে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠলো। শাসকগোষ্ঠী আন্দোলন দমাতে অনেক অপকৌশল অবলম্বন করলো। বক ধার্মিকরা সর্বদাই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের প্রয়োজনে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফায়দা হাসিলে সচেষ্ট হয়। তারা প্রচার করলো উর্দূ মুসলমানদের ভাষা, আর বাংলা হিন্দুদের ভাষা। যারা বাংলার পক্ষে বলছে, তারা মূলত হিন্দুদের কথা বলছে!
কিন্তু তাদের অপকৌশল কার্যকর হলো না। কারণ তমদ্দুন মজলিসের নেতৃস্থানীয় ইসলামী অনুশাসনে বিশ্বাসী। তারা গণসচেতনতা সৃষ্টি করলেন। বাংলা হিন্দুদের ভাষা নয়, এবং বাংলাতে ইসলাম চর্চা, ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে বাঁধার কিছু নেই।
ব্যর্থ শাসকগোষ্ঠী তখন হুমকি, ধমকি, জেল, জুলুম, অত্যাচারের পথ বেছে নিলো। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া বাংলা ভাষার সংগ্রামে বাঙালীদের চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ওই দিন রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে মিছিলরত জনতার উপর গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউর নামের দামাল সন্তানদের। তাদের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
আমরা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে পেলাম। একটি শহীদ মিনার পেলাম। একটি স্বাধীন দেশ পেলাম। ২১ শে ফেব্র“য়ারী জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করলো। বাঙালী হিসেবে অবশ্যই এসব আমাদের গর্বের বিষয়। তারপরও কথা থেকে যায়! আমরা কি বাংলাকে স্বাধীন বাংলাদেশে সঠিক মর্যাদা দিতে পেরেছি? আমার মনে হয় জবাব “না”। ২১ শে ফেব্র“য়ারীতে নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরি করে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পন করা। ওই দিন বুকে কালো ব্যাজ ধারন করে পাজামা পাঞ্জাবী পরে খাঁটি বাঙালী সাজার বনিতা করা, এবং দু’একটি আলোচনা সভার আয়োজন করার মাধ্যমেই আমরা একুশের মর্যাদাকে গন্ডিবদ্ধ করে ফেলেছি। কিভাবে সর্বস্তরে বাংলা চালু হবে? এর পঠন-পাঠন, চর্চা বৃদ্ধি পাবে? কিভাবে আমাদের ভাষাকে আরও সমৃদ্ধি করা যাবে? এসব বিষয় আমাদের কাছে উপেক্ষিত থেকেই যাচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে দিনটাতে বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা শহীদ হলো সেদিনটিকে আমরা স্মরণ করি ইংরেজীতে (২১ শে ফেব্রুয়ারি) বাংলাতে নয় (৮ই ফাল্গুন)। তদ্রূপ আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ অন্যান্য দিবসও পালন করা হয় ইংরেজী তারিখে। এসবের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। এ সবকে আমরা যুগের সাথে তাল মেলানো বলবো নাকি বাংলাকে অবহেলা? অবহেলার পাশা-পাশি অক্ষমতাতো আছেই।
আরও আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই যে, আমাদের যে ভাষা সংগ্রাম ছিলো ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ, তা আমাদের কাছে গৌন হয়ে যাচ্ছে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে। আমরা কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝে সে পথে ধাবিত হচ্ছি। আমাদের দাদা-বাবা যাঁরা মরহুম হয়ে গেছেন, তাদেরকে তো আমরা দোয়া ও জিয়ারতের মাধ্যমে স্মরণ করি। তাদের আত্মার মাগফিরাতও কামনা করি ইসলামী পন্থায়। তাহলে আমাদের ভাষা শহীদ, স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে কেন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করি? যদি ওই পন্থা ইসলাম সম্মত না হয়, তাহলে কি আমরা যা করছি এতে তাদের কোন উপকার করতে পারছি ? আসুন আমরা আমদের জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ সকল শহীদদের ইসলামী পন্থায় স্মরণ করি এবং তাদের আত্মার মাগফেরাদ কামনা করি।
বিষয়: বিবিধ
২১৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন