==পিতা-পুত্রের প্রবাস জীবন==
লিখেছেন লিখেছেন সিটিজি৪বিডি ২৩ মার্চ, ২০১৪, ০৫:৩১:৫৩ বিকাল
স্বাধীনতা যুদ্ধের কয়েক বছর পরে আমার জন্ম হয়। সেই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না বলে বাংলার ঘরে ঘরে অভাব অনটন ছিল। গ্রাম-অঞ্চলের বেশীর মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাত। অভাব-অনটন থেকে পরিবারকে মুক্ত রাখার জন্য কাজের সন্ধানে মানুষ বিভিন্ন দেশে ছুটে গিয়েছিল। আমি দুনিয়াতে আসার আসার আগে আমার বাবাও আরব আমিরাতে পাড়ি দিয়েছিলেন।
আমরা তিন ভাই-চার বোন। বুদ্ধি হবার পর থেকে বাবাকে খুব মিস করতাম। দুই বছরে মাত্র দুই মাসের ছুটি পেয়ে বাবা দেশে আসতেন। বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছুই নিয়ে আসতেন। এমনটি আত্বীয়-স্বজনদের জন্যও গিফট নিয়ে আসতেন। বাবাকে কাছে পেয়ে আমরা সবাই খুশীতে দিন কাটাতাম। সারাক্ষণ বাবার কাছাকাছি থাকতাম।
বাড়ীতে এসেও বাবা বসে থাকতেন না। আমাদের জমি-জমা দেখাশুনা করতেন। বাবার সাথে আমিও ঘুরে ঘুরে দেখতাম। বাবা বাড়ীর বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ গ্রহন করতেন। প্রতিবার ছুটিতে দেশে এসেই কিছু না কিছু উন্নয়নমুলক কাজ করে যেতেন। বাবার এই কাজগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাত। আমিও বাবার পথ অনুসরণ করে মানুষের কল্যান করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ছুটি শেষে অশ্রুসিক্ত নয়ণে বাবাকে এয়ারপোটে বিদায় দিয়ে আসতাম।
ভাই-বোনরা সবাই পড়ালেখায় ভাল ছিলাম বলে কোনদিন বাবার বকা শুনতে হয়নি। আমরা সবাই নিজ দায়িত্বে পড়ালেখা করেছিলাম। পড়ালেখার জন্য যা যা প্রয়োজন চাহিবামাত্র আমরা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। বাবার উপার্জনের বেশীর ভাগ অর্থ আমাদের পড়ালেখার পিছনে ব্যয় করেছিলেন।
সেই সময়ে চিঠিই ছিল প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। যারা পড়ালেখা জানতনা তারা ক্যাসেটে কথা বলে পাঠাত। সেই সময়ে মাসের পর মাস একটি চিঠি অথবা একটি ক্যাসেটের জন্য পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করত। নব্বই দশকের পরে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হলে বাবা মোবাইলে সবার সাথে কথা বলতেন। আমরাও দেশ থেকে বাবার সাথে মোবাইলে কথা বলতাম।
ছোট বেলা থেকেই বাবার প্রতি খুব দুর্বল ছিলাম। বাবাকে খুব বেশী কাছে পাইনি বলে বাবার জন্য আমার খুব খারাপ লাগত। তাই পড়ালেখা শেষ করে বাবার অনিচ্ছা সত্বেও ২০০৩ সালে আমিও প্রবাসী হয়েছিলাম। আল্লাহ তা'য়ালা অশেষ রহমতে বাবার বসের প্রতিষ্টানে আমিও কাজ পেয়েছিলাম। মায়ের কথা মনে পড়লে কাজ শেষে বাবার সাথে দেখা করে আসতাম। বাবার রুমে গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখতাম।
ত্রিশ বছরেরও বেশী সময় বাবা প্রবাসে থেকে ২০১১ সালে অবসর গ্রহন করেন। ২০১২ সালে আমার মাকে নিকে পবিত্র হজ্জ পালন করেন। দেশে গিয়েও বাবা বসে নেই। মসজিদে গিয়ে জামায়েতের সাথে নামায আদায় করেন। বাসায় নাতি-নাতনীদেরকে নিয়ে আড্ডা দেন। আমার অসুস্থ মাকে দেখাশুনা করেন। শহর থেকে গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে সবার খোজ-খবর রাখেন। কাজ পাগল এই মানুষটির কোন অবসর নেই।
আমি আমার বাবাকে নিয়ে খুব গর্ব করি। ছোট বেলায় নিজের বাবাকে হারিয়ে আমার বাবা জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন। এই যুদ্ধে আমার বাবা জয়ী হয়েছেন। নিজের সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের জন্য একটি সুখী-সংসার উপহার দিয়েছেন। আজ আমরা বাবার গড়া সুখী-সংসারে সবাই মিলেমিশে সুন্দর ভাবে বসবাস করছি।
আমি নিজেও এখন দুই সন্তানের পিতা। এই দুর প্রবাস থেকে প্রতিদিন সন্তানদের সাথে কথা না বলে ও খোজ-খবর না নিয়ে থাকতে পারি না। কন্যার সাথে কথা বলতে না পেরে অনেক সময় কেঁদেই ফেলি। আর আমার বাবা দীর্ঘ ত্রিশটি বছর কিভাবে প্রবাসে কাটিয়েছেন একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা ভাল জানেন। বাবার সাথে থাকব বলে প্রবাসী হয়েছিলাম। আর এখন বাবাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে এই প্রবাসে আমি একা হয়ে গেলাম।
এই দুর প্রবাসে প্রতিদিন নামায আদায় করে মহান আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে দু'হাত তুলে বলি, "রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা"। আরো বলি, ইয়া আল্লাহ! প্রবাস থেকে মুক্তি দিয়ে বাবার সাথে ও পরিবারের সবার সাথে একত্রে থাকার ব্যবস্থা করে দিও। আমিন।
লেখকঃ দুবাই প্রবাসী
বিষয়: Contest_father
১৯০৭ বার পঠিত, ৪৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই দুর প্রবাসে প্রতিদিন নামায আদায় করে মহান আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে দু'হাত তুলে বলি, "রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা"। আরো বলি, ইয়া আল্লাহ! প্রবাস থেকে মুক্তি দিয়ে বাবার সাথে ও পরিবারের সবার সাথে একত্রে থাকার ব্যবস্থা করে দিও। আমিন।
সরকার আমাদের রেমিটেন্স পেয়ে গর্ববোধ করে। কিন্তু আমাদের জন্য কি করছে?
ফেসবুকে "প্রবাসী" পেইজে জয়েন করুন,লিখুন আপনার সমস্যার কথা,ভাললাগার কথা!
https://www.facebook.com/photo.php?fbid=372982699499015&set=a.372820276181924.1073741828.372804382850180&type=1
আপনার পরিচিত জনকেও পারলে বলবেন।
আল্লাহ সবাইকে ভাল রাখুন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাকে পরিবার পরিজনের সাথে থেকে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিন।
আপনার বাবার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল। সেই সাথে শুভ কামনা রইল আপনার সন্তানদের জন্য তারাও যেন বড় হয়ে বাবার ত্যাগের কথা অনুধাবন করতে পারে এবং লিখতে পারে।
আমিন।
আপনাকে বাবাকে সালাম জানাবেন....
সংগ্রামী এই মানুষটাকে কাজের মধ্যেই ব্যস্ত রাখবেন, দেখবেন সুস্থ থাকবে।সেটা এটলিস্ট সামাজিক কাজ।
হঠাত করে কাজ ছাড়া হয়ে গেলে টেনশন এসে ভর করবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন