মক্কা-মদিনার স্মৃতি : পর্ব (৯)
লিখেছেন লিখেছেন আবু তাহের মিয়াজী ০৮ মে, ২০১৬, ০৭:৫৫:১৫ সন্ধ্যা
হাজারে আসওয়াদ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে, তা কি পাঠকের মনে আছে। ওটা পড়েছিলাম সেই শৈশবে। হাজারে আসওয়াদকে বলা হয়ে থাকে বেহেশতের পাথর গুলোর একটি। ওটা অনাদিকাল থেকে কাবাঘরের সাথে সংযুক্ত আছে। নবী সা. যখন যুবক, তখন একবার ঢলের পানিতে কাবাঘরের ম্যান্টেনেন্স-এর প্রয়োজন পড়ে গেল। হাজারে আসওয়াদকে সরিয়ে রেখে কাজটা সম্পাদিত হলো। এক সময় হাজারে আসওয়াদকে পূণস্থাপনের পর্যায় এসে গেলো। আরবের প্রসিদ্ধ ৪টি গোত্রের মধ্যে বিবাদ লেগে গেলো। সবাই চাচ্ছে এই রবকতময় কাজটা একা নিজেরা করতে।এবং কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিষয়টা অস্র টানাটানির পর্য্যায়ে চলে গেলো। অবশেষে মুরব্বীরা সিদ্ধান্তে পৌছলেন এই মর্মে যে, আগামী কাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি সবার আগে কাবাঘরের সামনে পৌছবে, সেই এই বিষয়ে ফায়সালা দেবে। আর সবাই তার ফায়সালা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে।
দিনটা ছিল শীতকাল। স্বাভাবসুলভ ভাবেই যুবক মুহাম্মদ প্রত্যুষে উঠে গায়ে চাদর জড়িয়ে পায়চারির উদ্দেশ্যে বাড়ীর পাশে কাবা ঘরের সামনে হাজির। এর পর সবাই এসে দেখলো যে, মুহাম্মদ সা. ই সবার আগে এসেছেন। তাই সবাই টেনশন মুক্ত হলো এই ভেবে যে, কোন গোত্রবাজই আগে আসতে পারেনি। বরং নগরীর সবচেয়ে ভাল আর আস্তাভাজন মানুষটাই প্রথমে এসেছে। তার সিদ্ধান্ত হবে পক্ষপাতিত্বহীন। কারণ তিনি তার আচরণ, ব্যবহার ইত্যাদি দিয়ে ইতিমধ্যে জনতার মন জয় করে আল আমীন উপাধি ধারণ করেছিলেন।
মুহাম্মদ সা. সকলের কথা শুনে নিজের গায়ের চাদরটা জমিনের উপর বিছিয়ে দিয়ে পাথরটাকে সেই চাদরের উপর রাখলেন। আর সেই গোত্রবাজ ৪ গোত্রের ৪জন লিডারকে চাদরের ৪টি কোনে ধরতে বললেন। ৪জন চাদরের চার কোনায় ধরলেন এবং পথরটাকে নিয়ে গেলেন কাবাঘরের সেই স্থানে যেখানে পাথরটা স্থাপন করা হবে। নবী সা. নিজ হাতে পাথরটা উঠিয়ে সেই স্থানে স্থাপন করলেন। আর এভাবেই মিমাংসা হলে গেলো বিষয়টি। জাতি সংঘাত একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে মুক্তি পেলো।
ইতিমধ্যে আমার ৭টি তাওয়াফ শেষ হল। এইবার বগলের নিচ থেকে ইরহামের চাদর খানা বের করে স্বাভাবিক ভাবে পরে নিয়েছি এবং কুরআনের সে আয়াত পড়েছিঃ
وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى
“এবং তোমরা মাক্বামে ইব্রাহীমকে নামাযের স্থান বানাও”।
হ্যাঁ! মাক্বামে ইব্রাহীম হলো কাবা ঘরের দরজার সামনে পিতলের শিকল আর কাঁচ আবৃত একটি বাক্স। যার ভিতরে একটি পাথর রয়েছে এবং যে পfথরে দুই পায়ের চিহ্ন বিদ্যমান।
এই পাথর হচ্ছে সেই পাথর, যার উপরে দাড়িয়ে ইব্রাহীম আ. কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন। পাথরটি সে সময় লিফটের কাজ করেছিল বলে পাথরে চড়ে হযরত ইব্রাহীম আ. উপরে নিচে যে কোন স্থানে যেতেন।
আমি চলে আসলাম মাকামে ইব্রাহীমের এলাকায়। একদম মাকামে ইব্রাহীমের কাছে হতে হবে এমন শর্ত নেই। কিন্তু অবশ্যই আমাকে কাবাঘর মুখী হয়ে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে কাছে বা দূরে কোথাও দাড়াতে হবে। মাকামে ইব্রাহীমকে আমিও মুসল্লা বা নামাযের স্থান বানাতে হবে তথা আমাকে ওখানে ২ রাকাত নামায আদায় করতে হবে। তাই আমি একটু দূরে দাঁড়ালাম। ভীড়ের জন্য কাছে স্থান পাইনি।এই নামাযে প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সুরা কাফিরুন পড়লাম আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা ইখলাছ পড়লাম।
আবারো আল্লাহর ঘর ধরে দোয়া পর্ব শেষ করে চেষ্টা করে দেখলাম ঐতিহাসিক কালো পাথরে চুমু খেতে পারি কিনা। প্রচন্ড ভীড় ঠেলে এগুতে চেষ্টা করলাম। ভীড়ে অনেকক্ষণ প্রতিযোগিতার পর আমি কালো পাথর স্পর্শ করতে তো পারি নি,বরং ক্লান্ত হয়েছি।
নজরুল ভাইয়ের প্রশ্ন ঃ আপনি তাওয়াফ করছেন। এখন আপনাকে একটা প্রশ্ন করি! আপনি কেন একটি নিদিষ্ট ঘরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করছেন? আপনি বলবেনঃ এটা আল্লাহর ঘর-বাইতুল্লাহ। তাই আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে চক্কর দিচ্ছি-তাওয়াফ করছি। যদি তা-ই হয়, তাহলে আপনার প্রতি জিজ্ঞাসাঃ আপনার আমার জীবনের এমন হাজারো চক্কর আছে, জীবনের পথ চলা শুরু থেকে আজ অবধি আমি আপনি সবাই চক্করের মধ্যেই আছি। সেই সব চক্কর কোন জিনিসটাকে কেন্দ্র করে হবে? সহজ উত্তরঃ আল্লাহ নির্দেশকে কেন্দ্র করে। অতএব, আপনি তাওয়াফ করার সময় মনের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টি করতে হবে যে, জীবনের আগামীর সময় গুলোতে যত চক্কর আছে, সকল চক্করে আমি আপনি আল্লাহর নির্দেশকে কেন্দ্র করে চক্কর দেবো।আমার পরিবার, আমার সমাজ, আমার ব্যবসা, আমার রাজনীতি, আমার সামাজিকতা-সকল ক্ষেত্রে আমার চক্কর নিয়ন্ত্রিত হবে আল্লাহর নির্দেশকে কেন্দ্র করে। বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) ছেড়ে যখন আরদুল্লাহ (আল্লাহর জমীনে-সাম্রাজ্যে)প্রত্যাবর্তন করবো, তখন আমার চক্করের কেন্দ্র বদল হবেনা। আপনি আপনার তাওয়াফে এই অঙ্গিকার করুন। ফেলে আসা দিন গুলোতে যে সব চক্বর আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত করা হয়েছে, তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন এই চক্বর গুলো দিতে দিতে।।
এর মধ্যে হাবিব ভাইয়ের কল আসলো, বললেন আমি সাফা পাহাড়ে আছি।এবার আমি চললাম সাফা পাহাড়ের দিকে। ওখানে যাওয়ার পথে দেখতে পেলাম বিভিন্ন কন্টেনারে জমজমের পানি। সবকটি জায়গায় ৩টি করে কন্টেনার রাখা। তার মাঝে ১টিতে ঠান্ডা আর ২টিতে নরমাল পানি থাকে। আমি প্রাণ ভরে জমজম পান করমাল।আমি কিন্তু ঠান্ডা নেই নাই স্বাভাবিকটা নিয়েছি, কারন আমার স্বাস্থ্যগত অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে। জমজমের পানি পান করে আমি এগিয়ে চললাম সাফা পাহাড়ের দিকে।
সাফা পাহাড় পেতে আমি কাবা ঘরের হাজারে আসওয়াদ বরাবর কোন থেকে বিপরীত দিকে তথা মসজিদের দিকে বরাবর অগ্রসর হলাম। পেয়ে গেলাম কাঁচে ঘেরা সাফা পাহাড়।
আমি এখন সাফা পাহাড়ে পৌছেছি এখন সায়ী শুরু করব। যা উমরার দ্বিতীয় অন্যতম কাজ। তাই সাফা পাহাড়ের নিকটে পৌছে পড়লামঃ
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْراً فَإِنَّ اللّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ
“নিঃসন্দেরহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ নিশানী সমূহের অন্তর্ভূক্ত। কাজেই যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহর হজ্জ বা উমরাহ করে তার জন্য ঐ দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাঈ করায় কোন গোনাহ নাই। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে কোন সৎ ও কল্যাণের কাজ করে, আল্লাহ তা জানেন এবং তার যথার্থ মর্যাদা ও মূল্য দান করবেন।”
দ্রষ্টব্যঃ এখানে বেশীরভাগ তথ্য নজরুল ভাইয়ের নোট থেকে পড়ে।
বিষয়: বিবিধ
১২৯৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রিয়তম নবীজির (সাঃ) দেশে আল্লাহর বিধিবিধান পালনে আপনার প্রাণবন্ত উপস্থাপনা অনেক ভালো লাগলো।
মহান রব আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। সুন্দর লিখাটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন