রমযান-আলোচনা:- জেগে উঠুন, জান্নাতের ঐ দুয়ার গুলো সব দিয়েছে খুলে।
লিখেছেন লিখেছেন আবু তাহের মিয়াজী ১৯ জুলাই, ২০১৪, ০৪:২৭:৫৪ বিকাল
আমি এ (কুরআন )নাযিল করেছি কদরের রাতে ৷ তুমি কি জানো ,কদরের রাত কি ? কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো ৷ ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়৷ এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত৷ । (সূরা-আল কাদর)
নামকরন ও পরিচিতি।
এ সূরার প্রথম আয়াতে 'কদর' শব্দটি দিয়ে নামকরন করা হয়েছে। এটি মক্কি সূরা। এতে পাঁচটি আয়াত ও একশত তেরটি ( অক্ষর ) রয়েছে।
শানে নুজুল:
হজরত ইবনে আবি হাতেম (রহ) বর্ননায় পাওয়া যায়, রাসুলুল্লাহ ( সা ) একদা বনি ইসরইলের জনৈক মুজাহিদ সর্ম্পকে আলোচনা করলেন: সে এক হাজার মাস অবিরাম জিহাদে মুশগুল থাকে এবং কখনো অস্র সংবরন করেনি। মুসলমানরা একথা শুনে বিস্মিত হলে এই সূরা কদর অবর্তীন হয়। ইবনে জারির ( রহ ) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনি ইসরাইলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যাক্তি সারাত ইবাদতে লিপ্ত থাকে এবং সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেতএবং এবং সমস্ত দিন জিহাদে রত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরি পেক্ষিতে মহান আল্লাহ তায়লা সূরা কদর নাজিল করএ উম্মতের চেস্ঠত্ব প্রমান করেছেন। ( এবনে কাসীর, মাযহারি )
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :
লোকদেরকে কুরআন মজীদের মূল্য ,মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করাই এই সূরাটির বিষয়বস্তু।কুরআন মজীদের বিণ্যাসের ক্ষেত্রে একে সূরা আলাকের পরে রাখাই একথা প্রকাশ করে যে সূরা আলাকের প্রাথমিক পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে যেপবিত্র কিতাবটির নাযিল শুরু হয়েছিল তা কেমন ভাগ্য নির্ণয়কারী রাতে নাযিল হয় ,কেমন মহান মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব এবং তার এই নাযিল হওয়ার অর্থ কি এই সূরায় সেকথাই লোকদেরকে জানানো হয়েছে।
অশান্ত পৃথিবীর দিশেহারা মানবজাতিকে আল্লাহমুখী করার জন্য মহাগ্রন্হ আল কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল মুহাম্মদ (সা) এর ওপর একটি সম্মানিত ও মর্যাদার্পূন রজনীতে নাজিল করা হয়েছে। মূলত পবিত্র কুর আনের মহত্ব ও র্মযাদা প্রমান করার জন্য এ রাতের র্বননা। পবিত্র রমযান মাস ও লাইলাতুল কদর এ জন্যই সম্মানিত, যেহেতু এমাসে এবং এরাতে পবিত্র কুরআন হজরত মুহাম্মদ (সা)এর প্রতি অবর্তীন হয়েছে । কদর শব্দটির একটি অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান, মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারনে একে লাইলাতুল কদর তথা মহামাম্মবিত রাত বলাহয়।
প্রথমেই আল্লাহ বলেছেন ,আমি এটি নাযিল করেছি ।অর্থাৎ এটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা নয় বরং আমিই এটি নাযিল করেছি ।
আবার সূরা বাকারায় বলা হয়েছে "রমযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে৷" (১৮৫ আয়াতে )
এরপর বলেছেন ,কদরের রাতে আমার পক্ষ থেকে এটি নাযিল হয়েছে। কদরের রাতের দু’টি অর্থ। দু’টি অর্থই এখানে প্রযোজ্য।
এক ,এটি এমন একটি রাত যে রাতে তকদীরের ফায়সালা করা হয়। অথবা অন্য কথায় এটি সাধারণ রাতের মতো কোন মামুলি রাত নয়। বরং ভাগ্যের ভাঙা গড়া চলে ।এই রাতে এই কিতাব নাযিল হওয়া নিছক একটি কিতাব নাযিল নয় বরং এটি শুধুমাত্র কুরাইশ ও আরবের নয় , সারা দুনিয়ার ভাগ্য পাল্টে দেবে।একথাটিই সূরা দুখানেও বলা হয়েছে ।
দুই , এটি বড়ই মর্যাদা ,মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের রাত।
এটি হাজার মাসের চাইতেও উত্তম ।এর সাহায্যে মক্কার কাফেরদেরকে পরোক্ষভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেশকৃত এই কিতাবকে নিজেদের জন্য একটি বিপদ মনে করেছে। তোমাদের ওপর এ এক আপদ এসে পড়েছে বলে তোমরা তিরস্কার করছো। অথচ যে রাতে এর নাযিল হবার ফায়সালা জারী করা হয় সেটি ছিল পরম কল্যাণ ও বরকতের রাত ।এই একটি রাতে মানুষের কল্যাণর জন্য এত বেশী কাজ করা হয়েছে যা মানুষের ইতিহাসে হাজার মাসেও করা হয়নি।একথাটি সূরা দুখানের তৃতীয় আয়াতে অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
সবশেষে বলা হয়েছে ,এই রাতে ফেরেশতারা এবং জিব্রীল (আ) নিজেদের রবের অনুমতি নিয়ে সব রকমের আদেশ নির্দেশ সহকারে নাযিল হন। (সূরা দুখানের চতুর্থ আয়তে একে জ্ঞানময় বা সুষ্ঠু বিধান বলা হয়েছে ) সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত এটি হয় পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার রাত।অর্থাৎ কোন প্রকার অনিষ্ট এ রাতে প্রভাব ফেলতে পারে না ।কারণ আল্লাহর সমস্ত ফায়সালার মূল লক্ষ্য হয় কল্যাণ।মানুষের জন্য তার মধ্যে কোন অকল্যাণ থাকে না।এমনকি তিনি কোন জাতিকে ধবংশ করার ফায়সালা করলেও তা করেন মানুষের কল্যাণের জন্য,তার অকল্যাণের জন্য নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে , এটা কোন রাত ছিল ? এ ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়৷ এ সম্পর্কে প্রায় ৪০ টি মতের সন্ধান পাওয়া যায়৷ তবে আলেম সমাজের সংখ্যাগুরু অংশের মতে রমযানের শেষ দশ তারিখের কোন একটি বেজোড় রাত হচ্ছে এই কদরের রাত৷ আবার তাদের মধ্যেও বেশীরভাগ লোকের মত হচ্ছে সেটি সাতাশ তারিখের রাত৷ এ প্রসংগে বর্ণিত নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলো এখানে ।
হযরত আবু হুরাইরা ( রা) বর্ণনা করেছেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেন : সেটি সাতাশের বা উনত্রিশের রাত৷ ( আবু দাউদ )
হযরত আবু হুরাইরার (রা ) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে সেটি রমযানের শেষ রাত ৷ ( মুসনাদে আহমাদ )
যির ইবনে হুবাইশ হযরত উবাই ইবনে কা'বকে ( রা) কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন৷ তিনি হলফ করে কোন কিছুকে ব্যতিক্রম হিসেবে দাঁড় না করিয়ে বলেন , এটা সাতাশের রাত৷ ( আহমাদ , মুসলিম , আবু দাউদ , তিরমিযী , নাসায়ী ও ইবনে হিব্বান )
হযরত আবু যারকে ( রা) এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়৷ তিনি বলেন , হযরত উমর ( রা) , হযরত হুযাইফা ( রা) এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু সাহাবার মনে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না যে , এটি রমযানের সাতাশতম রাত৷ ( ইবনে আবী শাইবা )
হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত ( রা) বর্ণনা করেছেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন , রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাগুলোর যেমন একুশ , তেইশ ,পঁচিশ , সাতাশ বা শেষ রাতের মধ্যে রয়েছে কদরের রাত৷ (মুসনাদে আহমাদ )
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রা) বর্ণনা করেছেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন , তাকে খোঁজ রমযানের শেষ দশ রাতের মধ্যে যখন মাস শেষ হতে আর নয় দিন বাকি থাকে৷ অথবা সাত দিন বা পাঁচ দিন বাকি থাকে৷ ( বুখারী ) অধিকাংশ আলেম এর অর্থ করেছেন এভাবে যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে বেজোড় রাতের কথা বলতে চেয়েছেন৷
হযরত আবু বকর ( রা) রেওয়ায়াত করেছেন , নয় দিন বাকি থাকতে বা সাত দিন বা পাঁচ দিন বা এক দিন বাকি থাকতে শেষ রাত৷ তাঁর বক্তব্যের অর্থ ছিল , এই তারিখগুলোতে কদরের রাতকে তালাশ করো৷ ( তিরমিযী , নাসায়ী )
হযরত আয়েশা ( রা) বর্ননা করেছেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : কদরের রাতকে রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে তালাশ করো৷ ( বুখারী , মুসলিম , আহমাদ , তিরমিযী )
হযরত আয়েশা (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ( রা) এও বর্ণনা করেছেন যে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত রমযানের শেষ দশ রাতে ইতিকাফ করেছেন৷
এ প্রসংগে হযরত মু'আবীয়া (রা) হযরত ইবনে উমর, হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ যে রেওয়ায়াত করেছেন তার ভিত্তিতে পূর্ববর্তী আলেমগণের বিরাট অংশ সাতাশ রমযানকেই কদরের রাত বলে মনে করেন৷ সম্ভবত কদরের রাতের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহাত্ম থেকে লাভবান হবার আগ্রহে যাতে লোকেরা অনেক বেশী রাত ইবাদাতে কাটাতে পারে এবং কোন একটি রাতকে যথেষ্ট মনে না করে সে জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে কোন একটি রাত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি৷
মুফাস্সিরগণ সাধারণভাবে এর অর্থ করেছেন , এ রাতের সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো ৷ কদরের রাত এ গণনার বাইরে থাকবে ৷ সন্দেহ নেই একথাটির মধ্যে যথার্থ সত্য রয়ে গেছে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রাতের আমলের বিপুল ফযীলত বর্ণনা করেছেন৷ কাজেই বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা ( রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
"যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর সাথে এবং আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদাতের জন্যে দাঁড়ালো তার পিছনের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হয়েছে৷ "
শিক্ষাসমূহ:-
১/ কুরআন অবর্তীন হবার কারনে যেহেতু একটি মাস এবং একটি রাত বিশেষভাবে সম্মানিত সুতরাং কুরআনপ্রাপ্ত মুসলিম জাতি ও বিশেষভাবে সম্মানিত।
২/ লাইলাতুল কদর উম্মতে মুহাম্মাদের জন্য একটি বিশেষ নিয়ামাত। এরাতে ইবাদত করে নিজেকে সম্মানিত করার প্রচেষ্টা চালানো উচিত।
৩/ রমজানের শেষ দশ দিনে লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভের উদ্দিশ্য নিরবচ্ছিন্নভাবে ইবাদত করা উচিত।।।
তথ্যসূত্র: তাফহীমুল কুরআন ।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৭ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মহান রব আমাদেরকে লাইলাতুল ক্বদরের সকল বরকত হাসিল করা তৌফিক দিন! আমীন! জাযাকাল্লাহ খাইরান!
বারাকাল্লাহু ফীক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন