বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহিলা ইউনিভার্সিটি "নুরা ইউনিভার্সিটি"
লিখেছেন লিখেছেন অচেনা প্রতিবিম্ব ০১ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৫:৪৫:২৩ বিকাল
প্রসংগত কারনেই শুরুতেই কিছু কথা বলতে হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে। এই ভার্সিটির পুরো নাম হচ্ছে (Princess Noura bint Abdul Rahman University). সংক্ষেপে এটিকে বলা হয় (PNU). এই ভার্সিটির পূর্ব নাম ছিল Riyadh University for Women. এই ভার্সিটিটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহিলা ইউনিভার্সিটি এই ভার্সিটির আয়তন প্রায় ১০০ স্কয়ার কিলোমিটার। এটি সৌদি আরবে রিয়াদের কিং খালিদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দক্ষিন পশ্চিম কর্নারে অবস্থিত। এই ইউনিভার্সিটির ভিত্তিপ্রস্তর ও উদ্বোধন করেন সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ। বর্তমান বিশ্বে এটি একটি অত্যাধুনিক মহিলা ইউনিভারসিটি। এবার আশা যাক মূল ভ্রমণ কাহিনিতে।
মূল গেইটে আব্দুল্লাহর একটি ছবি
সেদিন হঠাৎ করে আমরা অফিসে বসে চার কলিগ মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকে আমরা পুরো ভার্সিটি ঘুরে দেখব। ম্যানেজারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পুরো ভার্সিটি ঘুরার উদ্দেশ্যে।
আমাদের অফিস থেকে ভার্সিটির প্রধান গেইট পর্যন্ত আমাদের পৌঁছতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ মিনিট।
গাড়ী থেকে নামতেই আমাদের চোখে পড়ল দৃষ্টিনন্দন একটি ঝর্না, এই ঝর্ণাটি ভার্সিটির মূল ক্যাম্পাসের বাহিরে। আমরা সবাই তড়িৎ গতিতে নেমে ঝর্ণার কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সবাই মিলে যে যার মত ছবি তুলছে। আমিও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলামনা সবার সাথে তাল মিলিয়ে আমিও কিছু ছবি তুললাম। কিন্তু আমার মন যেন কোথায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। কারণ ছিল,ঝর্ণার দুই পাশে এত সুন্দর সৃষ্টিশৈলী দিয়ে সাজানো হয়েছে যা দেখলেই থমকে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এ যেন মনের অজান্তেই মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু কি আর করা সময় সংক্ষিপ্ত আবার চলে যেতে হবে, তাই আমরা মেইন গেইট দিয়ে দ্রুত ভিতরে প্রবেশ করলাম।
গেইটের সামনে সেই দৃষ্টি নন্দন ঝর্ণা।
ভিতরে প্রবেশ করেই আমরা প্রথমে চলে গেলাম সেন্টার লাইব্রেরীতে, এই সেই বিল্ডিং যেখানে কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় ৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। কিন্তু এখন এই লাইব্রেরীটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যা দেখে বুঝার কোন উপায় নেই যে কিছু দিন আগে এই বিল্ডিঙটিরই একটি অংশ ধ্বসে পড়েছিল। উপরন্তু বর্তমানে এটাই হচ্ছে এই ক্যাম্পাসের নজরকাড়া বিল্ডিংগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দর্শনীয় বিল্ডিং। উল্লেক্ষ্য যে, এই লাইব্রেরীতে একসাথে ৪.৫ মিলিয়ন ভলিউম রাখার বেবস্থা আছে। লাইব্রেরীর ভিতরটা অনেকক্ষণ ঘুরে দেখে আমরা চলে গেলাম মূল ক্যাম্পাসের দিকে।
দৃষ্টি নন্দন সেন্টার লাইব্রেরী
এই ক্যাম্পাসে একসাথে ৪০০০০ হাজার ছাত্রি, ১২০০০ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী কাজ করবে, সেই সাথে রয়েছে ৭০০ শয্যা বিশিষ্ট বিশাল আকৃতির একটি হাঁসপাতাল। মূল ক্যাম্পাসটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা না দেখলে বুঝানো সম্ভবনা, চারিদিকে সবুজ আর সবুজ, মাঝে মাঝে খেজুরের ঝাড়। এই ক্যাম্পাসের প্রতিটা বিল্ডিংয়ের চার পাশ সবুজ দূর্বা ঘাস দারা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মরুবুকে সবুজ দূর্বা ঘাস এযে হিরা মুক্তার চাইতেও বেশী, হবেইবা না কেন যেই মানুষগুলো ২ থেকে ৩ হাত বিশিষ্ট ঘাসের সন্ধান পেলে ছুটে যায় দেখতে, সেখানে এত সুন্দর সবুজের সমারোহ। প্রতিটি পরতে পরতে এমনভাবে সাজানো হয়েছে আমি ঠিক খুজে পাচ্ছিনা এই সাজানোটাকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করব। তবে এই মুহূর্তে বলতে পারি, রাজকীয় বিয়েতে বরের জন্য নববধূটিকে যেভাবে সাজানো হয় ঠিক সেইভাবে অথবা বলা যেতে পারে এ যেন তপ্ত মরুর বুকে শীতল সমীরণের মেলা বসেছে। অন্যভাবে বলা যায় এ যেন মরুর বুকে সবুজারন্যের ছোট্ট একটি দ্বীপ। তার পরেও কেন যেন মনে হচ্ছে আমি এই সাজানো পরিবেশটার উপমা ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি।
কিছু সবুজ দূর্বা ঘাসের দৃশ্য।
এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি বিল্ডিংয়ে আমরা প্রবেশ করতে পারিনি, কারন হচ্ছে কিছু কিছু বিল্ডিংয়ে ইতিমধ্যেই মহিলা কর্মচারীরা অবস্থান নিয়েছে। আমরা বাহিরের রাস্তা দিয়ে পথ চলা শুরু করলাম। এই ভার্সিটির ভিতরের রাস্তাগুলো আমাদের দেশের হাইওয়ের চাইতেও চওড়া, এবং মজবুত বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরার পর চোখে পড়ল একটি স্টেশন সেখানে লেখা আছে (APM 13) পরে জানলাম এটার মানে হচ্ছে (Automated People Mover) অর্থাৎ এটা একটা বিশেষ ট্রেন সার্ভিসের জন্য। খবর নিয়ে জানলাম এখানে ছোট ছোট মোট ৩৩টি ট্রেন থাকবে। এখন আপাতত ২ টি আছে। যেই ট্রেনগুলোতে করে এখানকার ছাত্রী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা যার যার গন্তব্যে যাবে। এই বিশেষ সার্ভিসের জন্য ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাই ওভার ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে।
দীর্ঘ ফ্লাই ওভারটির একাংশ।
কিছু তথ্য সংগ্রহ করে আমরা ছুটে গেলাম এই ইউনিভার্সিটির টানাল দেখার জন্য। উল্লেখ্য যে এই টানালটি ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। কথিত আছে এই টানালটির কাজ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় এবং এর নির্মাণ কাজ সবচেয়ে দ্রুতগতিতে শেষ হয়েছে। আমরা যখন টানালের ভিতরে প্রবেশ করলাম অনেক প্রশস্ত একটি জায়গা দেখতে পেলাম যেখানে অনায়াশে ২ টি পিকাপ অথবা ছোট গাড়ী পাশাপাশি চলতে সক্ষম। টানালটি আমরা গাড়ী দিয়ে ভ্রমণ করলাম, টানাল দেখা শেষে আমরা বেরিয়ে আসলাম, এবার আমাদের নতুন যাত্রা শুরু হল ডাটা সেন্টারের দিকে।
টানালের ভিতরে দাঁড়িয়ে আমার বন্ধু
ডাটা সেন্টার অর্থাৎ যেখান থেকে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখান থেকেই পর্যবেক্ষণ করা হয় এই ভার্সিটির ভিতরে কোথায় কি হচ্ছে। এই বিল্ডিংটির সবচেয়ে সুন্দর দিক হচ্ছে NOC Room অর্থাৎ (Network Operation Center Room). এখানে এক বিশাল মনিটরের সাহায্যে কোন যায়গায় কি সমস্যা হচ্ছে তা সনাক্ত করা হয় এবং পরে তা সমাধান করা হয়। তবে এই কক্ষটি অনেক শীতল থাকে। এছাড়াও এই বিল্ডিংয়ে রয়েছে, বিশালাকৃতির অনেকগুলো ক্যাবিনেট, যেগুলোর ভিতরে রয়েছে নেটওয়ার্ক কনট্রোল করার অনেক সার্ভার। এই ডাটা সেন্টারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত রয়েছে Admin & Engineering Building পূর্ব পাশে রয়েছে Ware House Building আমরা সেগুলো পরিদর্শন শেষে ছুটে চললাম থিয়েটারের দিকে। থিয়েটারের দিকে যাবার সময় রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা নানা বর্ণের নাম না জানা অনেক নিত্য নতুন ফুল গাছসহ অনেক ধরণের ছোট ছোট গাছ যা চোখে পড়ার মত। অবশেষে আমরা থিয়েটারের সামনে এসে পৌঁছলাম।
ডাটা সেন্টারের ভিতরে অত্যাধুনিক সেই স্ক্রিন।
থিয়েটারের ভিতরে ঢুকে আমাদের সবার চোখ জুড়ে গেল, একটা থিয়েটারের জন্য না জানি এরা কত টাকা খরচ করেছে। থিয়েটারের চারপাশ অত্যাধুনিক সব সাজ স্বজ্জায় স্বজ্জিত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি দেয়ালে কোন না কোন শিল্প তুলে ধরেছে। যেন মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজানো হয়েছে। কিন্তু দুক্ষের বিষয় হল থিয়েটারের ভিতরে আমরা ছবি তোলার অনুমতি পেলামনা।
পরে সেখানে বেশিক্ষন অবস্থান না করে আমরা চলে গেলাম লেকের পারে। কিন্তু এখনো লেকের কাজ সম্পন্ন হয়নি বিধায় লেকে কোন পানি ছিলনা। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে যখন লেকে পানি দেওয়া হবে তখন এর সৌন্দর্য বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। তবে এখন দেখলে মনে হবে যেন একটা মৃত লেক। তাই কোন ছবি নিলামনা।
সেখান থেকে আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হল অন্য আরেকটি ঝর্ণার দিকে। সেখানে গিয়ে আমরা দেখলাম অনেক বড় একটা ঝর্ণা। যেখানে বিশ্বের বহুদেশ থেকে অনেক মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে সবাই যার যার মত ছবি তুলছে, অবশ্য না তোলার কোন কারণ নেই। ঝর্ণার যে সৌন্দর্য তা দেখলে যে কোন মানুষই চাইবে একটা ছবি তুলে নিজের কাছে রেখে দিতে। ঝর্ণার পাশে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার চলে যাব অনেকতো দেখা হল।
অবশেষে সবাই মিলে একসাথে ছবি ক্যামেরাবন্ধি করে প্রায় দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষ করে আমরা ফিরে এলাম আমাদের অফিসে। তবে এত সৌন্দর্য দেখে বার বার শুধু একটি কথা স্মরণে আসল
“তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর?”
পুরো ঝর্ণাটি একসাথে ক্যামেরাবন্ধি হচ্ছিলনা তাই বিভিন্ন দিক থেকে ছবি তোলা।
(বিঃ দ্রঃ আপনারা যদি কেউ এখানে ভ্রমণে আসতে চান তাহলে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নিবেন, আমাদের সেই ঝামেলায় যেতে হয়নি কারণ আমরা সবাই এই ভার্সিটিতে কর্মরত আছি। সেই সুবাদে আইডি কার্ড দিয়ে ভ্রমণ করে এসেছি।)
বিষয়: সাহিত্য
২৩০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন