রমাদান উপলক্ষ্যে ব্লগ আয়োজনঃ সেহরী সংক্রান্ত মাসআলা
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাইফ ০৮ জুন, ২০১৬, ০৪:০৪:২২ রাত
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ.....
সবাইকে রমাদানের শুভেচ্ছা-
সকলের সিয়াম কিয়াম সবর ও আমালে সলেহ কবুল হোক এবং জীবনটা ঐদিনের মত পরিচ্ছন্ন হয়ে যাক যেদিন দুনিয়ায় আগমন ঘটেছিল!
আমার দায়িত্বে দেয়া হয়েচে সেহরীর মাসআলা!!
সাধারণ মাসআলা তো কম-বেশী সবারই জানা এবং সহজলভ্য। জটিল ও অসাধারণ কোন পরিস্থিতি সামনে এলে তখনই মাসআলার গুরুত্ব অনুভূত হয়। মাসআলা মানেই সওয়াল ও জওয়াব। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলোচনা এগিয়ে গেলে সেটাই উত্তম হয়। তাই সবার প্রতি আহ্বান রইলো প্রশ্ন বা সমস্যা পেশ করার জন্য- যেন সেগুলোর আলোচনা আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
সাধারণ কিছু মাসায়েল নিচে আলোচিত হলো-
সেহরী বা সাহারী খাওয়া
মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে রোযার জন্য সেহরী খাওয়া মুস্তাহাব এবং যে ব্যক্তি তা ইচ্ছাকৃত খায় না সে গোনাহগার নয়। আর এ কারণেই যদি কেউ ফজরের পর জাগে এবং সেহরী খাওয়ার সময় না পায়, তাহলে তার জন্য জরুরী রোযা রাখা। এতে তার রোযার কোন ক্ষতি হবে না।
বরং ক্ষতি হবে তখন, যখন সে কিছু খেতে হয় মনে করে তখনই (ফজরের পর) কিছু খেয়ে ফেলবে। সে ক্ষেত্রে তাকে সারা দিন পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে এবং রমাদানের পরে সেই দিনের রোযা কাযা করতে হবে।
সেহরী খাওয়া যে উত্তম তা প্রকাশ করার জন্য মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) উম্মতকে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি সেহরীকে বরকতময় খাদ্য বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা সেহরী খাও। কারণ, সেহরীতে বরকত আছে।’’ (বুখারী ১৮২৩, মুসলিম ১০৯৫নং) ‘‘তোমরা সেহরী খেতে অভ্যাসী হও। কারণ, সেহরীই হল বরকতময় খাদ্য।’’ (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৪০৮১নং)
ইরবায বিন সারিয়াহ বলেন, একদা রমাযানে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাকে সেহরী খেতে ডাকলেন; বললেন, ‘‘বরকতময় খানার দিকে এস।’’(আহমাদ, মুসনাদ, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে হিববান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৭০৪৩নং)
সেহরীতে বরকত থাকার মানে হল, সেহরী রোযাদারকে সবল রাখে এবং রোযার কষ্ট তার জন্য হাল্কা করে। আর এটা হল শারীরিক বরকত। পক্ষান্তরে শরয়ী বরকত হল, রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ পালন এবং তাঁর অনুসরণ।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এই সেহরীর গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তা দিয়ে মুসলিম ও আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) রোযার মাঝে পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি অন্যান্য ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা করার মত তাতেও বিরোধিতা করতে আমাদেরকে আদেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া।’’(মুসলিম ১০৯৬, আবূ দাঊদ ২৩৪৩, ফাসিঃ মুসনিদ ৯৮পৃঃ)
সেহরীতে কি খেতে হবে?
অল্প-বিস্তর যে কোন খাবার খেলেই সেহরী খাওয়ার বিধি পালিত হয়ে যাবে। এমনকি কেউ যদি এক ঢোক দুধ, চা অথবা পানিও খায় অথবা ২/১টি বিস্কুট বা খেজুরও খায়, তাহলে তারও সেহরী খাওয়ার সুন্নত পালন হয়ে যাবে। আর এই সামান্য পরিমাণ খাবারেই রোযাদার এই বিরাট ফরয রোযা পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর আনুগত্য করতে বল পাবে এবং ফিরিস্তাবর্গ তার জন্য দুআ করবে।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘সেহরী খাওয়াতে বরকত আসে। সুতরাং তোমরা তা খেতে ছেড়ো না; যদিও তাতে তোমরা এক ঢোক পানিও খাও। কেননা, যারা সেহরী খায় তাদের জন্য আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফিরিসতাগণ দুআ করতে থাকেন।’’(আহমাদ, মুসনাদ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৬৮৩নং)
তিনি আরো বলেন, ‘‘তোমরা সেহরী খাও; যদিও এক ঢোক পানি হয়।’’(আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে হিববান, সহীহ প্রমুখ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ২৯৪৫নং)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘মুমিনের শ্রেষ্ঠ সেহরী হল খেজুর।’’(আবূ দাঊদ ২৩৪৫ নং, ইবনে হিববান, সহীহ, বাইহাকী ৪/২৩৬-২৩৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৫৬২নং)
অবশ্য সেহরী খাওয়াতে বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়। কারণ, বেশী পানাহার করার ফলে ইবাদত ও আনুগত্যে আলস্য সৃষ্টি হয়।
কিছু লোক আছে, যারা গলায় গলায় রকমারী পানাহার করে এমনভাবে পেট পূর্ণ করে নেয় যে, মনে হয় তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যার ফলে ফজরের নামাযে বড় আলস্য ও শৈথিল্যের সাথে উপস্থিত হয় এবং মসজিদে আল্লাহর যিকরের জন্যও সামান্য ক্ষণ বসতে সক্ষম হয় না। আর দিনের বেলায় পেটের বিভিন্ন প্রকার কষ্টের শিকার হয়। অথচ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘উদর অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কোন পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। আদম সন্তানের জন্য ততটুকুই খাদ্য যথেষ্ট, যতটুকুতে তার পিঠ সোজা করে রাখে। আর যদি এর চেয়ে বেশী খেতেই হয় তাহলে যেন সে তার পেটের এক তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং অন্য আর এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ব্যবহার করে।’’ (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী ২৩৮০, ইবনে মাজাহ ৩৩৪৯, ইবনে হিববান, সহীহ, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ৪/১২১, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২২৬৫, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৫৬৭৪নং)
তবে এসবই হলো উপদেশমূলক কথা, প্রয়োজনে ভরপেট খেলেও রোযার কোন ক্ষতি হয়না, যদি অন্য কোন কারণ না ঘটে
সেহরীর শুরু ও শেষ সময়
সেহরী খাওয়ার সময় হল অর্ধরাত্রির পর থেকে ফজরের আগে পর্যন্ত। আর মুস্তাহাব হল, ফজর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না হলে শেষ সময়ে সেহরী খাওয়া। আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, যায়দ বিন সাবিত রাঃ তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে সেহরী খেয়ে (ফজরের) নামায পড়তে উঠে গেছেন। আনাস বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেহরী খাওয়া ও আযান হওয়ার মধ্যে কতটুকু সময় ছিল?’ উত্তরে যায়দ বললেন, ‘পঞ্চাশ অথবা ষাটটি আয়াত পড়তে যতটুকু লাগে।’ (বুখারী ৫৭৫, ১৯২১, মুসলিম ১০৯৭, তিরমিযী ৭০৩নং)
এখানে আয়াত বলতে মধ্যম ধরনের আয়াত গণ্য হবে। আর এই শ্রেণীর ৫০/৬০টি আয়াত পড়তে মোটামুটি ১৫/২০ মিনিট সময় লাগে। অতএব সুন্নত হল, আযানের ১৫/২০ মিনিট আগে সেহরী খাওয়া।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাগণ খুব তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন এবং খুব দেরী করে সেহরী খেতেন। (বাইহাকী ৪/২৩৮, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৮৯৩২নং)
সুতরাং সেহরী আগে আগে খেয়ে ফেলা উচিৎ নয়। মধ্য রাতে সেহরী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া তো মোটেই উচিৎ নয়। কারণ, তাতে ফজরের নামায ছুটে যায়। ঘুমিয়ে থেকে হয় তার জামাআত ছুটে যায়। নচেৎ, নামাযের সময় চলে গিয়ে সূর্য উঠার পর চেতন হলে নামাযটাই কাযা হয়ে যায়। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক। আর নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় মসীবত; যাতে বহু রোযাদার ফেঁসে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত করুন। আমীন।
সেহরীর সময় শেষ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে
উল্লেখ্য যে নিচের এসব আলোচনা হলো তত্ত্বকথা। রোযার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু তাক্বওয়া অর্জন, এবং তাক্বওয়ার দাবী হলো নিষিদ্ধ সীমানা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা, তাই ঘড়ির সময় অনুসরণ করে সেহরীর শেষ সময়ের দু-চার মিনিট আগেই পানাহার ও অন্যান্য বিষয় থেকে বিরত হওয়া উচিত।
ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে রোযাদার ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। আর সন্দেহের উপর পানাহার বন্ধ করবে না। যেহেতু মহান আল্লাহ পানাহার বন্ধ করার শেষ সময় নির্ধারিত করেছেন নিশ্চিত ও স্পষ্ট ফজরকে; সন্দিগ্ধ ও অস্পষ্ট ফজরকে নয়। তিনি বলেছেন,
{وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ}
অর্থাৎ, আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
এক ব্যক্তি ইবনে আববাস (রাঃ)-কে বলল, ‘আমি সেহরী খেতে থাকি। অতঃপর যখন (ফজর হওয়ার) সন্দেহ হয়, তখন (পানাহার) বন্ধ করি।’ তিনি বললেন, ‘যতক্ষণ সন্দেহ থাকে ততক্ষণ খেতে থাক, সন্দেহ দূর হয়ে গেলে খাওয়া বন্ধ কর।’ (ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৯০৫৭, ৯০৬৭নং)
ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেন, ‘ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হওয়া গেছে ততক্ষণ রোযাদার পানাহার করতে পারবে।’ (ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪০৪)
যদি কোন ব্যক্তি ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রেখে খায়, অথবা ফজর উদয় হয়নি মনে করে খায়, অতঃপর জানতে পারে যে, খাওয়ার আগেই ফজর উদয় হয়ে গেছে, অথবা ফজরের আযান হয়ে গেছে, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ এবং তাকে ঐ রোযা কাযা করতে হবে না। যদিও সে আসলে ফজরের পর খেয়েছে। কারণ, সে না জেনে খেয়েছে। আর না জেনে খাওয়া ক্ষমার্হ। অর্থাৎ তা ধর্তব্য নয়। (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪০৯-৪১১)
পক্ষান্তরে যদি কেউ ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে পারে যে, ফজর বা ফজরের আযান হয়ে গেছে এবং তা সত্ত্বে পানি বা অন্য কিছু খায়, তাহলে তার রোযা হবে না। তাকে ঐ দিন পানাহার ইত্যাদি রোযার মতই বন্ধ রেখে রমাযান পর কাযা রাখতে হবে।
জ্ঞাতব্য যে, সেহরীর শেষ সময় হল পূর্ব আকাশে ছড়িয়ে পড়া সাদা আলোক রেখার উদ্ভব কাল। সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘বিলালের আযান এবং (পূর্বাকাশে) আলম্বিত শুভ্র জ্যোতি যেন তোমাদেরকে সেহরী খাওয়াতে বাধা না দেয়। অবশ্য পূর্বাকাশে ছড়িয়ে পড়া জ্যোতি দেখে খাওয়া বন্ধ করো।’’ (আহমাদ, মুসলিম, আবূ দাঊদ ২৩৪৬, তিরমিযী, ইবনে আবী শাইবাহঃ, দারাকুত্বনী, বাইহাকী, ইরওয়াউল গালীল ৯১৫নং)
বলা বাহুল্য, ছড়িয়ে পড়া উক্ত সাদা রেখা পরিদৃষ্ট হলে সাথে সাথে রোযাদারের জন্য পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত হওয়া ওয়াজেব। তাতে সে ফজরের আযান শুনুক, অথবা না শুনুক। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘ইবনে উম্মে মাকতূমের আযান না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার কর। কারণ, সে ফজর উদয় না হলে আযান দেয় না।’’ (বুখারী ১৯১৮, মুসলিম ১০৯২নং)
লক্ষণীয় যে, ফজর উদয় হয়েছে কি না, তা-ই দেখার বিষয়; আযান হয়েছে কি না, তা নয়। অতএব মুআযযিন যদি নির্ভরযোগ্য হয় এবং জানা যায় যে, সে ফজর উদয় না হলে আযান দেয় না অথবা ফজর উদয় হওয়ার পরে দেরী করে আযান দেয় না, তাহলে তার আযান শোনামাত্র পানাহার থেকে বিরত হওয়া ওয়াজেব। পক্ষান্তরে মুআযযিন যদি (ফজর উদয়ের) সময় হওয়ার পূর্বেই আযান দেয়, তাহলে তার আযান শুনে পানাহার বন্ধ করা ওয়াজেব নয়। তদনরূপ মুআযযিন যদি ঢিলে হয় এবং যথাসময় থেকে দেরী করে আযান দেয়, তাহলে সময় শেষ জানা সত্ত্বেও আযান হয়নি বলে খেয়ে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, এতে রোযা হবে না।
কিন্তু মুআযযেনের অবস্থা না জানা গেলে, অথবা একই শহরে একাধিক মসজিদের একাধিক মুআযযেনের বিভিন্ন সময়ে আযান হলে এবং শহরের ভিতরে ঘর-বাড়ি তথা লাইটের ফলে ফজর উদয় হওয়ার সময় নিজে নির্ধারণ না করতে পারলে নির্ভরযোগ্য সেই ইসলামী পঞ্জিকা অনুযায়ী আমল করা জরুরী, যাতে নিখুঁতভাবে ফজর উদয়ের স্থানীয় সময় ঘ¦টা-মিনিট সহ স্পষ্ট লিখা থাকে। অতঃপর নিজের ঘড়ি ঠিক রেখে সেই সময় অনুযায়ী সেহরী-ইফতার করলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সেই হাদীসের উপর আমল হবে, যাতে তিনি বলেন, ‘‘যে বিষয়ে সন্দেহ আছে সে বিষয় বর্জন করে তাই কর যাতে সন্দেহ নেই।’’ (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী ২৫১৮, নাসাঈ, ইবনে হিববান, সহীহ, ত্বাবারানী, মু’জাম প্রমুখ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২০৭৪, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৩৭৭, ৩৩৭৮নং) ‘‘সুতরাং যে সন্দিহান বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে বাঁচিয়ে নেবে।’’ (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২৬৯, ২৭০, বুখারী ৫২, মুসলিম ১৫৯৯নং, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দাঃ)
জ্ঞাতব্য যে, ফজর উদয় হওয়ার ৫/১০ মিনিট আগে সতর্কতামূলকভাবে পানাহার থেকে বিরত হওয়া একটি বিদআত। কোন কোন পঞ্জিকা (বা রমাযান-সওগাতে) যে একটি ঘর সেহরীর শেষ সময়ের এবং পৃথক আর একটি ঘর ফজরের আযানের লক্ষ্য করা যায়, তা আসলে শরীয়ত-বিরোধী কাজ। (দ্রঃ তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৪১৮পৃঃ, সামানিয়া ওয়া আরবাঊন সুআলান ফিস্-সিয়াম ৪৮পৃঃ) কারণ, সেহরীর শেষ সময় যেটাই, সেটাই ফজরের আযানের সময়। আর ফজরের আযানের সময়ের আগে লোকেদের পানাহার বন্ধ করা অবশ্যই শরীয়ত-বিরোধী কাজ।
বলা বাহুল্য, (বিশেষ করে) রমাযান মাসে মুআযযিন-ইমামদের উচিৎ, যথাসময়ে আযান দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রাখা। রাইট-টাইমের ঘড়ি দ্বারা ফজর উদয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আযান দেওয়া মোটেই উচিৎ নয়। যাতে তাঁরা লোকেদেরকে ধোকা দিয়ে এমন সময় আযান না দিয়ে বসেন, যে সময়ে তাদের জন্য আল্লাহর হালালকৃত খাদ্য তাদের জন্য হারাম করে দেন এবং সময় হওয়ার পূর্বেই ফজরের নামায হালাল করে বসেন। আর এ যে কত বড় বিপজ্জনক, তা অনুমেয়। (ইবনে উষাইমীন ফাসিঃ মুসনিদ ৩৬পৃঃ)
আবূ হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ আযান শোনে এবং সেই সময় তার হাতে (পানির) পাত্র থাকে, তখন সে যেন তা থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত রেখে না দেয়।’’ (আহমাদ, মুসনাদ ২/৪৩২, ৫১০, আবূ দাঊদ ২৩৫০, দারাকুত্বনী, সুনান ২১৬২, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/২০৩, বাইহাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩৯৪নং)
অনেক উলামা উক্ত হাদীসটিকে এ কথার দলীল মনে করেন যে, যে ব্যক্তির হাতে খাবারের পাত্র (নিয়ে খেতে) থাকা অবস্থায় ফজর (বা তার আযান) হয়ে যায়, তার জন্য তা থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত রেখে দেওয়া (খাওয়া বন্ধ করা) বৈধ নয়। সুতরাং এ ব্যাপারটি আয়াতের সাধারণ নির্দেশ থেকে স্বতন্ত্র। মহান আল্লাহ বলেন,
{وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ}
‘‘আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
অতএব উক্ত আয়াত তথা অনুরূপ অর্থের সকল হাদীস উপর্যুক্ত হাদীসের বিরোধী নয়। তাছাড়া ইজমার প্রতিকূলও নয়। বরং সাহাবাদের একটি জামাআত এবং আরো অন্যান্যগণ উক্ত হাদীস অপেক্ষা আরো প্রশস্ততা রেখে মনে করেন যে, ফজর উজ্জ্বল হয়ে গেলে এবং ভোরের শুভ্র আলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লেও সে পর্যন্ত পানাহার করা বৈধ। (দ্রঃ ফাতহুল বারী ৪/১৬২-১৬৩, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৩/৩৮২-৩৮৪, তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৪১৭-৪১৮পৃঃ)
অনেকে মনে করেন, উক্ত হাদীসে ‘আযান’ বলতে বিলালের আযানকে বুঝানো হয়েছে; যা প্রথম (সেহরী বা তাহাজ্জুদের) আযান এবং যা ফজরের আগে দেওয়া হত। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘বিলাল রাতে আযান দেয়। সুতরাং তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে থাক, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে উম্মে মাকতূম আযান দেয়।’’ (বুখারী ৬১৭নং, মুসলিম)
অথবা উক্ত হাদীসের অর্থ এই যে, আযান শুনেও যদি ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়, যেমন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার ফলে অন্ধকার থাকে, তাহলে সে সময় কেবল আযানে ফজর হওয়ার কথা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। কারণ, ফজর জানার যে মাধ্যম তা (ফজরের জ্যোতি) নেই। আর মুআযযিন তা দেখে ফজর উদয়ের কথা জানতে পারলে সেও জানতে পারত। পক্ষান্তরে ফজর উদয় হওয়ার কথা এমনিই বুঝতে পারা গেলে মুআযযেনের আযান শোনার প্রয়োজন নেই। কারণ, সে তো (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হলেই পানাহার থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট। এ কথা বলেছেন খাত্ত্বাবী।
বাইহাক্বী বলেন, ‘উক্ত হাদীস সহীহ হলে অধিকাংশ উলামার নিকট তার ব্যাখ্যা এই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জেনেছিলেন, মুআযযিন ফজর হওয়ার আগে আযান দেয়। সুতরাং তখন সে পান করলে ফজর উদয়ের আগেই পান করা হবে।’ (বাইহাকী ৪/২১৮)
আলী আল-ক্বারী বলেন, ‘উক্ত নির্দেশ তখন প্রযোজ্য, যখন ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়।’ ইবনুল মালেক বলেন, ‘উক্ত নির্দেশ তখন প্রযোজ্য, যখন জানতে পারবে না যে, ফজর উদয় হয়ে গেছে। নচেৎ, যখন ফজর উদয় হওয়ার কথা জানতে পারবে এবং তাতে সন্দেহ করবে তখন নয়।’ (আউনুল মাবুদ ৬/৩৪১-৩৪২) এ ছাড়া আরো অন্য ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহই ভালো জানেন।
বলা বাহুল্য, শেষোক্ত উলামাদের মতানুসারে যখন কোন রোযাদার মুখে কোন খাদ্য বা পানীয় থাকা অবস্থায় ফজরের আযান শুনবে, তখনই সে তা মুখ থেকে উগলে ফেলে দেবে। আর এতে তার রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে। (সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ৬১নং)
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন