বিশ্বাস ও বুদ্ধির দ্বন্দ্বঃ আত্মা ও দেহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাইফ ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫০:৪২ বিকাল
বিশ্বাস ও বুদ্ধির দ্বন্দ্বঃ আত্মা ও দেহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
ইহুদী পাদ্রী ও বিতৃষ্ঞ খ্রীস্টানের বিতর্ক
========================
সেই মুহর্তে আমার ঠিক এরূপই মনে হলো- এবং আমি প্রায় অনিচ্ছাকৃতভাবেই স্বগতঃ বলে উঠলামঃ
-‘ যে কেউ এ সমস্তকে তার ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উপলব্ধি করতে পারবে সেই পারবে তার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে।’
ফাদার ফেলিক্স জবাব দেন-
’তুমি কী বলতে চাইছো, আমি জানি’,
‘কিন্তু নিয়তির উপর প্রভুত্ব করার ইচ্ছা মানুষের কেন হবে?
দুঃখ –কষ্ট থেকে রেহাই পাবার জন্য?
তার চেয়ে কি নিয়তি থেকে মুক্ত হওয়াই উত্তম নয়?’
-‘আপনি তো প্রায় একজন বৌদ্ধের মতোই কথা বলছেন, ফাদার ফেলিক্স! তাহলে কি আপনিও মনে করেন নির্বাণ-ই সকল জীবের লক্ষ্য?’
-‘না, না, নিশ্চয় নয়- আমরা খৃশ্চানরা জীবন এবং অনুভূতির বিনাশ চাই না- আমরা কেবল চাই জীবনকে বস্তু আর ইন্দ্রিয়ের এলাকা থেকে আত্মার জগতে উন্নীত করতে।’
-‘কিন্তু তা কি সন্ন্যাস নয়?’
-‘এ সন্ন্যাস নয়, তরুণ বন্ধু, এ সন্ন্যাস নয়! এ-ই একমাত্র পথ প্রকৃত জীবনের.. . শান্তির…’
............
..........
মনে হলো যেনো বহুদূর থেকে এলো ফাদার ফেলিক্সের গলার স্বরঃ
-তুমি ভেবে দেখো- বাসনার … সকল মানুষের বাসনার গভীরতম প্রতীক হচ্ছে- জান্নাতরূপ প্রতীক।
তুমি সকল সময়ই দেখতে পাবে, যদিও সবসময়ই ভিন্ন ভিন্ন চিত্রে, তবু তার অর্থ সবসময়ই এক, মানুষ নিয়তির হাত থেকে মুক্ত হতে চায়।
জান্নাতে মানুাষের নিয়তি বলে কিছু নেই; মানুষ যখন দেহ আর প্রকৃতির প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করলো এবং এভাবে, আমরা যাকে আদি পাপ বলি, সেই পাপ করে বসলো, তখনি এলো নিয়তি।
সেই আদি পাপটি কী?- মানুষের পথে বাধাস্বরূপ দেহের যে প্ররোচনা তাতে আত্মার পদস্থলন, আর প্ররোচনাগুলিই হচ্ছে আসলে মানুষের প্রকুতির মধ্যে অবশিষ্ট পশু –স্বভাব।
মানুষের সার, মানবিক ও মানবিক-ঐশি অংশ হচেছ কেবল তার আত্মা।
আত্মার অভিযাত্রা হচ্ছে আলোর দিকে। কিন্তু আদি পাপের জন্য তার পথ সবসময়ই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এমন সব বাধার দ্বারা, যা দেহের হাড় এবং অদৈব গঠন ও তার প্ররোচনাগুলি থেকে উদ্ভুত।
তাই খৃশ্চান ধর্মের লক্ষ্য হচ্ছে জীবনের অসার, ক্ষণিক পাশবিক দিক হতে মানুষের নিজের মুক্তি এবং তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকরে প্রত্যাবর্তন!’
.......
.........
-‘তা হতে পারে ফাদার ফেলিক্স, কিন্তু আমার মনে হয় এবং আমার বয়সের অনেকেই এরূপ মনে করে-
দেহের গঠনের মধ্যে সার আর অসারের পার্থক্য নিরূপণে এবং দেহ আর আত্মাকে পৃথক করার মধ্যে কোথায় যেনো একটা ভুল রযে গেছে।…
সংক্ষেপে, আমি আপনার মতের সাথে একমত হতে পারছিনা যে, দেহের দাবি, রক্ত-মাংস আর পার্থিব নিয়তির মধ্যে মহৎ পবিত্র কিছুই নেই- আমার কামনার লক্ষ্য অন্যত্র!
আমি জীবনের এমন একটি রূপের স্বপ্ন দেখি যদিও আমি স্বীকার করছি, এখানে তা খুব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না-যাতে-গোটা মানুষ, দেহ-আত্মায় মিলে মানুষ, তার সত্ত্বার গভীর হতে গভীরতরো পূর্ণতার জন্য চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাবে, যাতে আত্মা আর ইন্দ্রিয় একে অপরের শত্রু হবে না-যাতে মানুষ যেমন তার নিজের ভেতরের ঐক্য উপলব্ধি করবে তেমনি ঐক্য উপলব্ধি করবে তার নিয়তির তাৎপর্যের সংগে, যাতে করে সে তার জীবনের চূড়ায় পৌছুনোর পর বলতে পারে-‘আমি আমার নিয়তি।’
-‘এ তো হেলনীয় স্বপ্ন’। ফাদার ফেলিক্স জবাব দেন-‘কিন্তু এ স্বপ্নের পরিণতি কী হয়েছিলো?
প্রথম ওর্ফিক আর ডায়োনোসিয়ান রহস্যে,
তারপর আফলাতুন আর প্লোতিনিয়াসের ভাবধারায়,
আর এমনি করে,আবার এই উপলব্ধিতেও যে,
দেহ আর আত্মা পরস্পর বিরোধী…
দেহের প্রভুত্ব থেকে আত্মার মুক্তি সাধন, এই হচ্ছে খৃশ্চান মুক্তির অর্থ, ক্রুশে আমাদের প্রভুর আত্মোৎসর্গে আমাদের বিশ্বাসের তাৎপর্য.. .
এখানে তিনি থামলেনঃ তারপর আমার দিকে এক ঝলক চেয়ে বললে
‘দেখো আমি সব সময়ই কিন্তু মিশনারী নই.. আমি যদি তোমাকে আমার বিশ্বাসের কথা বলি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, কারণ এ তোমার বিশ্বাস নয়.. .
-কিন্তু আমার কোনো বিশ্বাসই নেই’, আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি।
-হ্যাঁ, ফাদার ফেলিক্স বলেন, আমি তা জানি,
বিশ্বাসের অভাব, বরঞ্চ বলা উচিত বিশ্বাস করার অক্ষমতা- এ হচ্ছে আমাদের জামানার আসল রোগ।
তুমি আরো অনেকের মতোই বাস করছো একটি বিভ্রান্তির মধ্যে, যা হাজার বছরের পুরোনো।
বিভ্রান্তিটি এই যে, মানুষের চেষ্টা –সাধনার দিক বুদ্ধিই দেখতে পারে। কিন্তু বুদ্ধি নিজে আধ্যাত্মিক জ্ঞান পর্যন্ত পৌছুতে পারে না, কারণ জাগতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য জ্ঞান একেবারেই মশহুল। বিশ্বাস –কেবল বিশ্বাসই পারে আমাদেরকে এই আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করতে।
-‘বিশ্বাস? আমি জিজ্ঞাস করি, আপনি আবার এ শব্দটি উল্লেখ করলেন।
একটি বিষয় আমি বুঝতে পারি না, আপনি বলেছেন যে, কেবল বুদ্ধির মাধ্যমে জ্ঞান হাসিল ও সৎ জীবন-যাপন সম্ভব নয়; বিশ্বাসের দরকার-
আপনি বলেছেন, আমি আপনার সাথে ষোলো আনা একমত।
কিন্তু যার বিশ্বাসই নেই সে কী করে বিশ্বাস অর্জন করবে? এর কোনো পথ আছে কি, অর্থাৎ এমন কোনো পথ যা আমাদের ইচ্ছার জন্য উন্মুক্ত?’
-কেবলমাত্র ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়, প্রিয় বন্ধু।
এ পথ খুলে যায় একমাত্র আল্লাহরই রহমতে।
তবে, এ পথ সবসময়ই তারই জন্য উন্মুক্ত হয়, যে তার অন্তরের অন্তস্থল থেকেই প্রার্থনা করে আলোকের জন্য-দিশার জন্য।’
-‘প্রার্থনা করে? কিন্তু ফাদার ফেলিক্স, মানুষ যখন প্রার্থনা করতে পারে তখন তার বিশ্বাস তো রয়েছেই।
আপনি আমাকে একটা বৃত্তের চারদিকে চালাতে চাইছেন-কারণ,
কোনো মানুষ যদি প্রার্থনা করে, যার কাছে সে প্রার্থনা করছে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার প্রত্যয় তো আগে থেকেই রয়েছে। এই প্রত্যয় তার কী করে এলো? তার বুদ্ধির মাধ্যমে? এর অর্থ কি একথা স্বীকার করার শামিল নয় যে, বুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন অসম্ভব?
তা বাদ দিলেও এমন কারো কাছে রহমতের কী অর্থই বা হতে পারে যার এ জাতীয় কোনো অভিজ্ঞতা নেই?
পাদ্রিটি তাঁর কাঁধ ঝাঁকুনি দিলেন অনুশোচনার সংগে, আমার তাই মনে হলো।
কেউ যদি নিজে আল্লাহকে উপলব্ধি করতে না পেরে থাকে তার উচিত অন্যদের অভিজ্ঞতার দ্বারা পথ চলার জন্য তৈরি থাকা, এমন সব লোকের অভিজ্ঞতার দ্বারা যাঁরা তাঁকে উপলব্ধি করেছেন.. .
*******************
উতস্ঃ
মক্কার পথ- (The Road To Mecca) মুহম্মদ আসাদ
অনুবাদঃ শাহেদ আলী
******************
বিষয়: বিবিধ
১১৮২ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রথম মন্তব্যের জন্য অভিনন্দন!!
জাযাকাল্লাহ..
গতবছর প্রথম পড়েছিলাম বইটা! আপনার লিখা পড়ে আবারো স্মরণে চলে এলো! জাযাকাল্লাহু খাইর!
বইটা বার বার পড়তে মন চায়!!!
যতবার পড়ি- নতুন কিছু পাই!!
জাযাকিল্লাহ..
ধন্যবাদ।
ব্যস্ত জীবনে শান্ত হয়ে বই পড়ার মত পাঠকের বড্ড অভাব!!
এ বইটি তাড়াহুড়ো করা পড়ার মত নয়!!
জাযাকাল্লাহ..
ইসলাম ও আরব মানস বুঝতে বইটা খুবই সহায়ক!!
আপনার তো পড়া আছে মনে করি!!!
জাযাকাল্লাহ..
কিন্তু এতো আমার লেখা নয়!!
শেষ পর্যন্ত পড়েছেন তো!!
জাযাকাল্লাহ..
কিন্তু এতো আমার লেখা নয়!!
যদিও ব্যতিক্রম কিছু দিতে চেষ্টা করি!!
তা না হলে কবে আবার "গেলুম" বলে হুমকি দিয়ে বসেন )
জাযাকুমুল্লাহ....
/abusaif.rahman
কিন্তু এতো আমার লেখা নয়!!
কপি-পেস্ট মাত্র, সামান্য সম্পাদনা
জাযাকাল্লাহ..
আপনাকও অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ,
মন্তব্য করতে লগইন করুন