মতপার্থক্য : উভয় মত সঠিক হওয়ার একটি উদাহরণ ==============================্
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাইফ ২১ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:২৯:৫৯ রাত
মতপার্থক্য : উভয় মত সঠিক হওয়ার একটি উদাহরণ
============================
[বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হলে সুরা হাশরের শানে নযুল ও আনুষংগিক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো জানা থাকা প্রয়োজন! ]
----------------------------------------
সুরা আল হাশর, আয়াত ৫
مَا قَطَعْتُم مِّن لِّينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَائِمَةً عَلَىٰ أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيُخْزِيَ الْفَاسِقِينَ
খেজুরের যেসব গাছ তোমরা কেটেছো কিংবা যেসব গাছকে তার মূলের ওপর আগের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো তা সবই ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে৷ *১*(আল্লাহ এ অনুমতি দিয়েছিলেন এ জন্য) যাতে তিনি ফাসেদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন৷ *২*
*১*এখানে একটি বিষয়ের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে । মুসলমানরা অবরোধ শুরু করার পর তা সহজসাধ্য করার জন্য বনী নাযীরের বসতির চারদিকে যে খেজুর বাগান ছিল তার অনেক গাছ কেটে ফেলে কিংবা জ্বালিয়ে দেয়। আর যেসব গাছ সামরিক বাহিনীর চলাচলে প্রতিবন্ধক ছিল না সেগুলোকে যথাস্থানে অক্ষত রাখে ।
এতে মদীনার মুনাফিকরা ও বনী কুরায়যা এমনকি বনী নাযীর গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজা শ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে । এটি কি "ফাসাদ ফিল আরদ" নয়৷
এই সময় আল্লাহ তা'আলা এই নির্দেশ নাযিল করলেনঃ "তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয়। বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে। "
এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, সামরিক প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর ততপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না ।
"ফাসাদ ফিল আরদ" হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে ।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান । তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেনঃ
ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং তিনি জনবসতি বিরাণ করবে না ।
কুরআন মজীদে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ
"যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে । " (বাকারাহ, ২০৫)
হযরত আবু বকরের (রা) এ নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ । তবে সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্যকোন ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে । তাই হযতর আবদুল্লাহ ইবনে মাস'উদ (রা) এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, (. . ) "মুসলমানগণ বনী নাযীরের গাছপালার মধ্যে কেবল সেই সব গাছপালাই কেটেছিলেন যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থিত ছিল । " (তাফসীরে নায়শাপুরী) ফকীহদের কেউ কেউ ব্যাপারটির এ দিকটার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে মত পেশ করেছেন যে, বনী নাযীরের বৃক্ষ কাটার বৈধতা শুধু এ ঘটনার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল । এ থেকে এরূপ সাধারণ বৈধতা পাওয়া যায় না যে, সামারিক প্রয়োজন দেখা দিলেই শত্রুর গাছপালা কেটে ফেলা এবং জ্বালিয়ে দেয়া যাবে । ইমাম আওযায়ী , লাইস ও আবু সাওর এ মতটিই গ্রহণ করেছেন । তবে অধিকাংশ ফকীহর মত হলো, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে এরূপ করা জায়েজ । তবে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য এরূপ করা জায়েজ নয় ।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কুরআন মজীদের এ আয়াত মুসলমানদের হয়তো সন্তুষ্ট করে থাকতে পারে কিন্তু কুরআনকে আল্লাহর বানী বলে স্বীকার করতো না নিজেদের প্রশ্নের এ জবাব শুনে তারা কি সান্ত্বনা লাভ করবে যে, এ দুটি কাজই আল্লাহর অনুমতির ভিত্তিতে বৈধ?
এর জবাব হলো শুধু মুসলমানদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়েছে । কাফেরদের সন্তুষ্ট করা এর আদৌ কোন উদ্দেশ্য নয় ।
যেহেতু ইহুদী ও মুনাফিকদের প্রশ্ন সৃষ্টির কারণে কিংবা মুসলমানদের মনে স্বতস্ফূর্তভাবে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল আমরা "ফাসাদ ফীল আরদে" লিপ্ত হয়ে পড়ি নাই তো৷
তাই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে সন্ত্বনা দিলেন যে, অবরোধের প্রয়োজনে কিছু সংখ্যক গাছপালা কেটে ফেলা এবং অবরোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না এমন সব গাছপালা না কাটা এ দুটি কাজই আল্লাহর বিধান অনুসারে বৈধ ছিল।
এসব গাছ কেটে ফেলা বা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই দিয়েছিলেন, না মুসলমানরা নিজেরাই এ কাজ করে পরে এর শরয়ী বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন- সে বিষয়ে মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীসসমূহে মতানৈক্য দেখা যায়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে 'উমরের বর্ণনা হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এর নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে জারীর) ।
ইয়াযীদ ইবনে রূমানের বর্ণনাও তাই । (ইবনে জারীর)
অন্যদিকে মুজাহিদ ও কাতাদার বর্ণনা হলো, এসব গাছপালা মুসলমানরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই কেটেছিলেন । তারপর এ বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় যে, কাজটি করা উচিত হয়েছে কিনা৷ কেউ কেউ তা বৈধ বলে মত প্রকাশ করলেন । আবার কেউ কেউ এরূপ করতে নিষেধ করলেন ।
অবশেষে আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করে উভয় দলের কাজেই সঠিক বলে ঘোষণা করলেন । (ইবনে জারীর)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এ রেওয়ায়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায় । তিনি বলেনঃ এ বিষয়ে মুসলমানদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয় যে, আমাদের মধ্যে থেকে অনেকে গাছপালা কেটেছে আবার অনেকে কাটেনি । অতএব এখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা উচিত, আমাদের কার কাজ পুরস্কার লাভের যোগ্য আর কার কাজ পাকড়াও হওয়ার যোগ্য৷(নাসায়ী)
ফকীহদের মধ্যে যারা প্রথম রেওয়ায়াতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তারা এ রেওয়ায়াত থেকে প্রমাণ করেন যে, এটি ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইজতিহাদ । পরবর্তী সময়ে আল্লাহ তা'আলা স্পষ্ট অহী দ্বারা তা সমর্থন ও সত্যায়ন করেছেন ।
এটা এ বিষয়ের একটা প্রমাণ যে, যেসব ব্যাপারে আল্লাহর কোন নির্দেশ বর্তমান থাকতো না সে সব ব্যাপারে নবী (সা) ইজতিহাদ করে কাজ করতেন ।
অপরপক্ষে যেসব ফকীহ দ্বিতীয় রেওয়ায়াতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তারা এ থেকে প্রমাণ পেশ করেন যে, মুসলমানদের দুটি দল ইজতিহাদের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দুটি মত গ্রহণ করেছিলেন । আল্লাহ তা'আলা দুটি মতই সমর্থন করেছেন ।
অতএব জ্ঞানী ও পণ্ডিতগণ যদি সতনিয়তে ইজতিহাদ করে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন তবে তাদের মতসমূহ পরস্পর ভিন্ন হবে । কিন্তু আল্লাহর শরীয়াতে তারা সবাই হকের অনুসারী বলে গণ্য হবেন ।
*২*অর্থাত আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল এসব গাছ কাটার দ্বারাও তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হোক এবং না কাটা দ্বারাও অপমানিত ও লাঞ্ছিত হোক । কাটার মধ্যে তাদের অপমান ও লাঞ্ছনার দিকটা ছিল এই যে, যে বাগান তারা নিজ হাতে তৈরী করেছিল এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তারা যে বাগানের মালিক ছিল সেই সব বাগানের গাছপালা তাদের চোখের সামনেই কেটে ফেলা হচ্ছে । কিন্তু তারা কোনভাবে কর্তনকারীদের বাধা দিতে পারছে না ।
একজন সাধারণ কৃষক বা মালিও তার ফসল বা বাগানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে পারে না । কেউ যদি তার সামনে তার ফসল বা বাগান ধ্বংস করতে থাকে তাহলে সে তার বিরুদ্ধে প্রাণপাত করবে । সে যদি নিজের সম্পদে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে না পারে তবে তা হবে তার চরম অপমান ও দুর্বলতার প্রমাণ ।
কিন্তু এখানে পুরা একটি গোত্র যারা শত শত বছর ধরে এ স্থানে বসবাস করে আসছিলো অসহায় হয়ে দেখছিলো যে, তাদের প্রতিবেশী তাদের বাগানের ওপর চড়াও হয়ে এর গাছপালা ধ্বংস করছে । কিন্তু তারা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি ।
এ ঘটনার পর তারা মদীনায় থেকে গেলেও তাদের কোন মান -মর্যাদা অবশিষ্ট থাকতো না ।
এখন থাকলো গাছপালা না কাটার মধ্যে অপমান ও লাঞ্ছনার বিষয়টি । সেটি হলো, যখন তারা মদীনা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো তখন নিজ চোখে দেখছিল যে, শ্যামল -সবুজ যেসব বাগান কাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় ছিল আজ তা মুসলমানদের দখলে চলে যাচ্ছে । ক্ষমতায় কুলালে তারা ওগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে যেতো এবং অবিকৃত একটি গাছও মুসলমানদের দখলে যেতে দিতো না ।
কিন্তু তারা নিরূপায়ভাবে সবকিছু যেমন ছিল তেমন রেখে হতাশা ও দুঃখ ভরা মনে বেরিয়ে গেল ।
[সূত্র: তাফহীমুল কুরআন]
বিষয়: বিবিধ
১২৪৭ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হোক বিশ্বমুসলিম এক জামাত...
আসলে এভাবেই আল্লাহ দ্বীনকে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন, যেমনটি তিনি ও তার রাসূল (সাঃ) বলেছেন। এ কারণেই উলামায়ে হক্বের মধ্যে মতপার্থক্য উম্মাহর জন্য রহমত স্বরূপ।
জাযাকাল্লাহ খইর।
মতপার্থক্যই ইসলামকে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সর্বযুগোপযোগী করে রাখে-
কিন্তু মতপার্থক্য যখন মতবিরোধে পরিণত হয় তখনই ইবলিশ নেতৃত্ব পেয়ে যায়--
তাই সকলের সতর্ক থাকা উচিত মতপার্থক্য যেন মতবিরোধে পরিণত না হয়
পরমতসহিষ্ণুতা চর্চা করা এখন অগ্রাধিকারযোগ্য কর্তব্য
কুরআন-হাদীস আঁকড়ে ধরার ব্যাপারটা সাধারণের জন্য উলামায়ে কিরামের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব- এ সহজ কথাটা অনেকেই ভুলে যান!!
সরল পথ একটাই হয়- কিন্তু সেটা চিপা গলি নয়!
সরলপথ একটাই হওয়া এবং মতপার্থক্য - এ দুটি বিষয়ের সম্পর্ক ও পার্থক্য বিষয়ে অন্য পোস্টে বলবো ইনশাআল্লাহ..
ইসলাম সংকীর্ণতার উর্ধে [সুরা হাজ্জ]
আল্লাহ ক্ষমা করুন।
ধন্যবাদ এমন পোষ্ট শেয়ার করার জন্য। জাজাকাল্লাহ খায়ের।
সুতরাং "ইখলাস" ও "বিরোধ" একত্রিত হওয়া অস্বাভাবিক- আর মতপার্থক্য তো হতেই পারে!
"রব্বানা লা তাজআল ফী ক্বুলুবিনা গিল্লাল্লিল্লাজীনা আমানু রব্বানা ইন্নাকা রউফুর রহীম
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ
وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
এরকম আরেকটা ঘটনা মনে পড়লো – মনে হয় পারস্যের বা বায়জান্টাইনের কোন এক যুদ্ধে, দূর্গ আক্রমনের জন্য পরিখা পার হতে পারছিলো না, তাই উট মেরে ব্রিজ বানিয়ে বালিদ বিন ওয়ালিদ(রাঃ) দলবল সহ মৃত-উটের-ব্রীজ পার হয়ে দূর্গ আক্রমণ করেছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় এমন ঘটনা আরো থাকতে পারে- এটি রণকৌশলের অংশ!
আপনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম-জাযাকাল্লাহ..
এর পরেও যারা দূরে থাকে বা তর্ক করে তারা কতই না হতভাগা!!
রব্বানা লা তুজিগ ক্বুলুবানা বা'দা ইজ হাদায়তানা...
মাথায় পাগড়ী থাকতে ভয় কি? >-
মন্তব্য করতে লগইন করুন