:জামায়াত নেতৃবৃন্দ ও আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসিঃ মৃত্যুর সময় কখনোই পরিবর্তিত হয়না
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাইফ ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:৫৪:৩০ রাত
জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যু নিয়ে নানান জনে নানান কথা বলছেন!
জিন্দা-শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাও এখন তাঁর জীবনের সর্বশেষ ও সর্বোত্তম দিনগুলো পার করছেন!
আইনী ঘোরপ্যাঁচের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কিলিং (বিচার-প্রহসনের মাধ্যমে হত্যা) এর হোতারা তো ফাঁসির রজ্জু হাতে নিয়েই নির্ঘুম সময় অতিবাহিত করছেন!
জুডিশিয়াল কিলিং (বিচার-প্রহসনের মাধ্যমে হত্যা) এর ইতিহাসে সক্রেটিসের নামের পাশে হয়তো আব্দুল কাদের মোল্লার নামটিও লেখা হয়ে যাবে!! [/i]
আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যু নিয়ে নানান জনে নানান কথা বলছেন!
বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ (এবং বিশেষ+অজ্ঞ) কেউই ছাড়ছেননা, বিভিন্নভাবে যার যার মত বিশ্লেষণ ও মতামত দিয়ে চলেছেন! যারা তাঁর মৃত্যুদন্ডে উল্লসিত তারাও নিজেদের ভালো-মন্দ ইচ্ছা-আকাংক্ষা স্বপ্নের কথা বলছেন, কবরটা কোথায় হবে তার গবেষণা এবং অভিমতও ইতিমধ্যে বিশ্ববাসী জেনে গেছে! আর বিপরীতে আব্দুল কাদের মোল্লার শুভাকাংক্ষীরাও নিজেদের আবেগ-আকাংক্ষা প্রকাশে কার্পণ্য করছেননা!
এমন সময়ে আমারও কর্তব্যবোধ থেকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি! আর এজন্য নিজের থেকে কিছু না বলে বরং ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়াটাই উত্তম মনে হচ্ছে!
তাহলে আসুন, এবার একটি মৃত্যুর ঘটনার ইতিহাসে চোখ বুলাই....
******
মৃত্যুর সময় কখনোই পরিবর্তিত হয়না
হযরত উমার রাঃএর উপর যখন আততায়ী হামলা করেছিল সে সময় তিলি শুধু অজুসহই ছিলেননা, বরং সেই মুহুর্তে নবীজির(সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেহরাবে নামাজে ইমামতি করছিলেন! অজু মুমিনের হাতিয়ার, নামাজ হচ্ছে মুমিনের মেরাজ! এই হাতিয়ার থাকা সত্বেও হযরত উমার রাঃ অত্যাচারী দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়েছিলেন এবং শাহাদাত বরণ করেছিলেন! তিনি এমন সময় শহীদ হয়েছিলেন যখন তিনি ছিলেন মুসলমানদের সবচেয়ে দয়ালু, সবচেয়ে কল্যানকামী এবং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের অধিকার প্রত্যার্পনকারী!
নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু এবং ভাগ্য কখনো পরিবর্তন করা যায়না! হযরত উমার রাঃ তাঁর ব্যক্তিত্বের এমন প্রখরতা বজায় রাখতেন যে তাঁর সামনে বসে অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পেতোনা! কিন্তু এ ধরণের ব্যক্তিত্ব সত্বেও তাঁর প্রতি হামলা ঠেকানো যায়নি এবং তাঁর মৃত্যুও ঠেকানো যায়নি! দারুল খোলাফার মধ্যে এবং সংগী-সাথীদের উপস্থিতিতে হযরত উমার রাঃএর উপর হামলা করা হয়! মসজিদে নববীর ভেতরে জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগানে হযরত উমার রাঃ তখন অবস্থান করছিলেন! সেই পবিত্র জায়গায়ও মৃত্যুর আগমন ঠেকাতে কেউ সক্ষম হয়নি!
বন্ধুদের সান্নিধ্যে মৃত্যু
হযরত উমার রাঃ বরকতময় সময়ে আততায়ীর হামলার শিকার হয়েছিলেন! নামাজের সময়ে মানুষকে আল্লাহর রহমত ঘিরে রাখে! খুশু-খুযু আশা-নিরাশা দোয়া কবুলিয়াতের সেই সময়ে বান্দা আল্লাহর খুব কাছে পৌঁছে যায়! নামাজের সময়ে একমাত্র মুনাফিকরাই মসজিদ থেকে দূরে থাকে! কিন্তু এতোসব সত্বেও নির্ধারিত মৃত্যুকাল ঠেকানো যায়নি! হযরত উমার রাঃ শাহাদাতবরণ করেন!
ফজরের নামাজের ইমামতি, মসজিদে নববীর মেহরাব, সাহাবা রাঃদের পবিত্র পরিচ্ছন্ন অন্তর, জিকির ও দোয়ায় সিক্ত জিহ্বা... এতোসব নিয়ামত সত্বেও আততায়ীর হামলা রোধ করা যায়নি! সেই হামলা ছিল ভাগ্যলিখন! হযরত উমার রাঃ শাহাদাতের সময়ে সেইসব সাথীদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত ছিলেন যাঁরা তাঁকে ভালবাসতেন এবং তাঁর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন! সেইসব নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি, তাঁদের উচ্চতর সংকল্প, বাহুবল, প্রেরণা... এতোসব কিছুও এ অপরাধ ঠেকাতে সক্ষম হয়নি! আল্লাহর সিদ্ধান্ত কি কেউ ঠেকাতে পারে!
হযরত উমার রাঃ যখন শহীদ হয়েছিলেন তখন তাঁর পাশে অসংখ্য লোক ছিল, অথচ আততায়ী ছিল একা! ইসলামী খেলাফত ইতিমধ্যেই মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল! অন্যায়ভাবে হত্যা এবং রক্তপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো! অন্যায়ভাবে হত্যা এবং রক্তপাতকে ভয়াবহ অত্যাচার এবং ঘৃণ্যকাজ মনে করা হতো! মুসলিম উম্মাহর শক্তি তখন অপ্রতিরোধ্য! কিন্তু তা সত্বেও কোনকিছুই এ অপরাধটি বন্ধের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেনি!
আল্লাহর সিদ্ধান্তের রহস্য
স্থান কাল সমাজ পরিবেস বন্ধু সাহায্যকারী অনুভব অনুভূতি ব্যক্তি ব্যক্তির শক্তি দুর্বলতা ইত্যাদি আমরা আমাদের অপূর্ব বুদ্ধি-বিবেচনায় নিরিণয় করে তাকি! আল্লাহর প্রাজ্ঞ বিবেচনায় আমাদের অপূর্ব বিবেচনার গুরুত্ব কতটুকু! আল্লাহর বিধান অপরিবর্তনীয়! আল্লাহর কাছে উমার রাঃএর মর্যাদা অনেক! আল্লাহ তাঁর উপর সন্তু্ষ্ট ছিলেন! তা সত্বেও একজন দুর্বৃত্ত কাফেরের হাতে তাঁকে শহীদ হতে হলো! এটাকে আল্লাহর কুদরতের এক বিস্ময়কর ক্যারিশমা বলা যায়! আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করলেই তাঁকে রক্ষা করতে পারতেন! কিন্তু যা হয়েছে সেটাই ছিল তাঁর ইচ্ছা!
আল্লাহতায়ালা তাঁর বন্ধুদের অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখেন! অবশ্য তাঁদের সাহায্য করেননা এমন চিন্তা করা আদৌ ঠিক হবেনা! আল্লাহর শত্রুদের আল্লাহতায়ালা তাঁর বন্ধুদের উপর বিজয়ী হবার সুযোগ দেন- এমন মনে করাও ঠিক হবেনা! হযরত উমার রাঃএর শাহাদাতের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে সেটা আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে! আল্লাহর সিদ্ধান্তের রহস্য আল্লাহতায়ালা নিজেই জানেন, সেটা কোনো বান্দার পক্ষে জানা সম্ভব নয়!
মানুষের জীবনে খন বালামুসিবত এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা আসে তখন শয়তান তার মনে সন্দেহ-সংশয় জাগিয়ে দিতে শুরু করে! এ সময় দির্বল ঈমানের লোক এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদেরকে শয়তান নানারকম ফেতনা-ফাসাদে লিপ্ত করে! সবকিছু সহজ-স্বাভাবিক থাকার সময়ে মানুষ যথেষ্ট সাহস দেখায়, কিন্তু কোন সমস্যা দেখা দিলে বা বিপদের সম্মুখীন হলেই মানুষের সাহস হারিয়ে যায়! কিন্তু আন্নাহর মুখলেছ বান্দারা সর্বাবস্থায় একই রকম থাকেন! শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বিপদ-আপদ সুখ-শান্তি সর্বাবস্থায় তাঁদের উচ্চারণ হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ....!!
মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পথ
হযরত উমার রাঃ যেভাবে সাহাদাতবর করলেন সেটা তাঁর জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পথ বলা য়ায়! আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে উপস্থিত হবার আগে তিনি মসজিদে নববীতে নামাজের ইমামতি করছিলেন! এই নামাজ হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্যলাভের সবচেয়ে নিশ্চিত উপায়!
শহীদে মেহরাবের শাহাদাতের কথা কী বলবো! রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই তো তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন! তারই সাথে শাহাদাতের সৌভাগ্যের বাণীও শুনিয়েছিলেন! ইসলাম গ্রহনের দিন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হযরত উমার রাঃ তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে একবিন্দুও সরে যেননি! তিনি ছিলেন যথাক্রমে মুসলিম, ইখলাছের অধিকারী অর্থাত প্রকৃত নিষ্ঠাবান, মুমিন মুহসীন মুত্তাক্বী আমলকারী পবিত্র পরিচ্ছন্ন স্বভাবের অধিকারী, আল্লাহর আদেশের যথাযথ পালনকারী, জ্ঞানী, ফকীহ, বাহাদুর, উচ্চসাহসিকতাসম্পন্ন ও চূড়ান্ত আত্মসংযমী! একই সাথে ন্যায় ও সুবিচারের ফায়সালাকারী! সকল নেকী সকল পূণ্যের ওপর আমলকারী, সকল প্রকার পাপ ও অন্যায়ের জুলুম কালিমা থেকে মুক্ত এবং পবিত্র পরিচ্ছন্ন!
হযরত উমার রাঃএর শাহাদাত তাঁর জন্য মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পথ তৈরী করেছে, আর আমাদের জন্য রেখে গেছে এক উচ্চতর শিক্ষা ও আদর্শ! এ ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন য়ে, হযরত উমার রাঃ শাহাদাতের যে গোপন ইচ্ছা পোষণ করতেন সেই শাহাদাত তাঁর নসীব হয়েছে!
ঈমান ও পরীক্ষা
হযরত উমার রাঃএর মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত! কিন্তু তা সত্বেও তিনি পরীক্ষার মধ্যে পড়েছিলেন! সেই পরীক্ষায় তাঁর জীবন উতসর্গ করতে হয়েছিল! আমাদার উপর যদি কোন পরীক্ষা আসে তবে এতে আমরা যেন অবাক না হই! মনে রাখা আবশ্যক, কোনো ক্ষেত্রেই আমরা হযরত উমার রাঃএর ধারেকাছে পৌঁছার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারিনি! এমন দাবী কেউ করতেও পারবেনা! বিপদ মুসিবত এবং পরীক্ষা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে!
ভাগ্যে যা আছে তা হবেই
রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, চারটি বিষয়ের উপর ঈমান ছাড়া কোন ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন হতে পারেনা!
(১)আল্লাহর তাওহীদ ও আমার রিসালাত (২)মৃত্যুর উপর ঈমান (৩)মৃত্যুর পরের জীবনের উপর ঈমান ও (৪)ভালোমন্দ আল্লাহর তরফ থেকেই হয়ে থাকে এর উপর ঈমান!!
ভাগ্যের উপর ঈমান শুধু মুখে উচ্চারণের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়না!বরং অংগ-প্রত্যংগ, কথা, কাজ ও মনের বিশ্বাস, সবকিছু মিলিয়েই ঈমান অর্জন করা যায়!
বিপদ-মুসিবত এলে মানুষকে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বুঝতে হবে এ পরীক্ষা আল্লাহর নির্ধারণ করা ভাগ্যের কারণেই ঘটেছে! সে অবস্থায়ও আল্লাহর প্রশংসা অব্যাহত রাখতে হবে! বিপদ-মুসিবত সময়ে সময়ে আসতেই থাকবে! মুমিন বান্দা আনন্দের সময় যেমন আল্লাহকে স্মরণ করে ঠিক তেমনি বিপদ-মুসিবতের সময়েও আল্লাহকে স্মরণ করবে! কখনোই তাঁকে ভুলে থাকবেনা! বান্দার আমল হলো তার শোকরের নিদর্শণ!
************
সূত্রঃ বই "শহীদে মেহরাব হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ"
মূলঃ সাইয়্যেদ ওমর তিলমিসানী রাহঃ
অনুবাদঃ মাওলানা কামাল উদ্দীন শামীম
অনুবাদ সম্পাদনাঃ হাফেজ মুনীরউদ্দীন আহমদ
আলকোরআন একাডেমী লন্ডন, ৬ষ্ঠ সংস্করণ ২০১২
বিষয়: বিবিধ
১৬৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন