হেফাজতি শারিয়া আইন চালু হলে নারীরা বাইরে কাজ করতে পারবে?
লিখেছেন লিখেছেন জুলিয়া ০৩ মে, ২০১৩, ০৮:৩২:১২ রাত
মুসলিম নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করতে পারবে কি না এ বিষয়টা ইদানিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশে শারিয়া আইন চালু হওয়া নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গনে কথা চলছে। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে সকল ইসলাম পন্থি রাজনৈতিক দলগুলো দেশে ইসলামি শাসন তথা শারিয়া আইন চালু করার দাবি জানিয়ে এসেছে। সম্প্রতি তাদের সাথে যোগ হয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
যখনই শারিয়া আইনের প্রসঙ্গটা চলে এসেছে তখনই বাংলাদেশে নারীদের জন্য ঘরের বাইরে কাজ করা যাবে কি না সে বিষয়টা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। কারন বাংলাদেশে কম সে কম ৩০ লক্ষের বেশী নারী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। এ ছাড়া আরও বহু নারী সরকারী ও বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। শারিয়া আইন চালু হলে এরা এসব কাজ চালিয়ে যেতে পারবে কি না সে ব্যপারে একটু খোজ খবর নেয়া যাক।
সর্ব প্রথমেই নিচের আয়াতটি দেখা যাক:
হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। সূরা আহযাব-৩৩:৩২
তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে-মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। সূরা আহযাব-৩৩:৩৩
উক্ত আয়াত দ্বয়ে নবির স্ত্রীদেরকে ঘরের বাহির হতে নিষেধ করা হচ্ছে। তাই অনেকে বলতে পারে , যেহেতু বিষয়টি সম্পূর্ন নবির স্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত , তাই তা অন্য সাধারন নারীর জন্য প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু একই সাথে বলা হচ্ছে- একজন মুসলমান নারী জন্য নবির স্ত্রীদের জীবন আদর্শ অনুসরন করাই সর্বোত্তম। এখন নবির স্ত্রীদের জন্য যেহেতু বাইরে যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে , তাহলে সাধারন নারীগনও বাইরে যেতে পারবে না। এটা নিয়ে অনেক তর্ক করা যেতে পারে এখন। তবে এ ব্যপারে আমরা বিখ্যাত কুরান তাফসিরকার ইবনে কাসিরের তাফসির দেখতে পারি-
উক্ত আয়াতে নবি করিম (সা) তার স্ত্রীদেরকে আদব কায়দা শিক্ষা দিচ্ছেন। সমস্ত স্ত্রীলোক তাদের অধীনস্ত। সুতরাং এই নির্দেশ দুনিয়ার সকল মুসলিম নারীদের জন্যই প্রযোজ্য। মূল কিতাবের পাতার ছবি দেখা যাবে এখানে
পৃষ্ঠা নং- ৭৮৩, তাফসির ইবনে কাথির, ১৫শ খন্ড।
সূত্র: http://www.quraneralo.com/tafsir/
উক্ত তাফসিরে দেখা যাচ্ছে- নবিজীর স্ত্রীদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ আসলে সকল মুসলিম নারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। উক্ত তাফসিরে কয়েকটি হাদিসের উদ্ধৃতি সহই সেটা সমর্থন করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা বাড়ীর বাইরে যেতে পারবে না। সে জন্যেই শারিয়া আইনে নারীদের বাড়ীর বাইরে কাজের কোন অনুমতি নেই। আফগানিস্তানে যখন তালিবানরা শারিয়া আইন চালু করেছিল , তখন এক ডিক্রী বলে সকল নারীদের চাকরী থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল, এমন কি তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীদের পড়াশুনাও বাদ দিয়ে দিয়েছিল। তারা যে সেটা করেছিল , সেটা ছিল ১০০% শারিয়া আইন সম্মত।
অথচ খুব অদ্ভুত ব্যপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইদানিং। হেফাজতে ইসলাম যখন তাদের ১৩ দাবি নামার প্রথম দফার দ্বারা প্রকারান্তরে দেশে শারিয়া আইন চালু করতে চাইছে এবং একই সাথে নারীদের জন্য নানা বিধ বাধা নিষেধ আরোপ করতে চাইছে, যাতে মনে হচ্ছে তারা নারীদেরকে বাইরে কাজে যেতে দেবে না , যা অত:পর বিভিন্ন মহল থেকে ব্যপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে , তখন এই হেফাজতে ইসলাম পূনরায় ব্যখ্যা দিচ্ছে- তারা নারীদের জন্য বাইরে কাজ করতে নিষেধ করছে না , বরং তারা বলছে তারা যেন যথাযথ পর্দা প্রথা মেনে বাইরে কাজ করতে যায়। যা বলা বাহুল্য শারিয়া আইনের পরিপন্থি। তারা দেশে শারিয়া আইন বলবত করতে চায় অথচ তার কিছু কিছু বিধান মানতে রাজী নয় , তাদের এ হেন স্ববিরোধীতার রহস্যটা কি ? নিশ্চিতভাবে এটা কি তাদের সাময়িক অপকৌশল? কারন তারা ভালই জানে , দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে , তাই এমন অবস্থায় নারীদেরকে বাইরে কাজ করতে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার মত একটা দাবী করলে গোটা নারী সমাজ তো বটেই দেশের সকল রাজনৈতিক দলও তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই কি তারা এখন প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে ? সেটা বলা বাহুল্য , সেটা করছে তারা সাধারন মানুষের শারিয়া আইন সম্পর্কিত অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে।
মনে হয় না কেউ ইবনে কাথিরের তাফসিরকে অগ্রাহ্য করতে পারে, তা পারেও নি আফগানিস্তানের তালিবানরা। এ ছাড়া এ সম্পর্কিত আরও হাদিস দেখা যেতে পারে। যেমন-
Sahih Al-Bukhari Hadith,3.85:
Narrated Ibn `Abbas: The Prophet said, "A woman should nottravel except with a Dhu−Mahram (her husband or a man withwhom that woman cannot marry at all according to the IslamicJurisprudence), and no man may visit her except in thepresence of a Dhu−Mahram." A man got up and said, "O AllahsApostle! I intend to go to such and such an army and my wifewants to perform Hajj." The Prophet said (to him), "Go alongwith her (to Hajj)
বাংলা তর্জমা: ইবনে আব্বাস বর্ণিত- রসুলুল্লাহ(সা) বলেছেন- একজন নারীর তার নিকটাত্মীয় ( স্বামী বা যার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক হয় না) ছাড়া একাকী ভ্রমন করা উচিত নয় এবং একজন পুরুষও তার সাথে দেখা করতে পারে যখন নারীর কোন নিকটাত্মীয় তার কাছে হাজির থাকে। এক লোক বলে উঠল- হে নবি! আমি যুদ্ধের জন্য একটা সেনাদলে যোগ দিচ্ছি এবং আমার স্ত্রী হজ্জ করতে চায়। নবি বললেন - তার সাথে যাও। সহি বুখারি - ৩: ৮৫
Sahih Al-Bukhari Hadith 2.194
Narrated by Abu Huraira:The Prophet (saws) said, "It is not permissible for a woman, who believes in Allah and the Last Day, to travel for one day and night except with a Mahram."
বাংলা তর্জমা: আবু হুরায়রা বর্ণিত: রসুলুল্লাহ ( সা ) বলেছেন- একজন নিকটাত্মীয় ছাড়া একজন নারীর একদিন ও এক রাতের বেশী দুরত্ব একাকি যাওয়ার অনুমতি নেই। সহি বুখারি- ২: ১৯৪
সূত্র : http://www.slideshare.net/muqithali/hadith-book-sahih-al-bukhari
উক্ত হাদিস দ্বয়ে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে , কোন নারীর একাকি যাওয়া উচিত নয়। আর যদি যেতেই হয় সাথে একজন নিকটাত্মীয় থাকতে হবে। এর পরও যদি যায় তবে নারী কোন ভাবেই একদিন ও এক রাতের দুরত্ব একাকি যেতে পারবে না।
আমরা জানি বাংলাদেশের প্রায় ৯৯% গার্মেন্টস নারী যাদের অধিকাংশই অবিবাহিতা শ্রমিক প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলা থেকে শহরে একাকী যাত্রা করে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মত নগরীতে একাকি থাকে। উক্ত কুরানের আয়াতের তাফসির এবং হাদিস থেকে দেখা যাচ্ছে যা কোন ভাবেই অনুমোদিত নয় যতই সে বোরখা বা হিজাব পরে থাকুক না কেন। সুতরাং এমতাবস্থায় দেশে হেফাজতে ইসলামের দাবী অনুযায়ী শারিয়া আইন চালু করলে , লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক সাথে সাথেই চাকরী হারাবে , গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী বন্দ হয়ে যাবে, দেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে। দেশে দেখা দেবে ভয়াবহ দুরবস্থা। যারা দেশে শারিয়া আইন চালু করতে চায় ,তারা কি এ বিষয় সম্পর্কে অবগত আছে ? যদি তারা বলে যে - না কোন নারীর চাকরি যাবে না , হিজাব বোরখা এসব পরে তারা কাজে যেতে পারবে, তাহলে সেটা তারা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় অসত্য কথা বলছে, সোজা কথা মানুষের শরিয়া আইনের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সাধারন মানুষকে প্রতারনা করছে - এটা কি বলা যায় না ?
হেফাজতে ইসলামের সাধ্য নেই - কুরানের আয়াত , ইবনে কাথিরের তাফসির , হাদিস - এসবের ব্যখ্যাকে উপেক্ষা করে নিজেদের মত করে নতুন কোন তরিকার শারিয়া আইন বানানোর ।
তাই আমাদের দাবী যারা দেশে ইসলামি শাসন চায় , তারা কুরান হাদিস ভিত্তিক শারিয়া আইনের বিধান সমূহ সর্ব সমক্ষে প্রকাশ ও প্রচার করুক। সাধারন মানুষ যদি সেসব পছন্দ করে তাহলে কোন কথা নেই, কিন্তু সাধারন মানুষের ধর্ম ভীরুতা ও শারিয়া আইন সম্পর্কিত অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে হেফাজতে ইসলাম বা ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো সাধারন মানুষকে প্রতারনা করে যাবে , তা হতে পারে না কিছুতেই।
বি:দ্র: এই পোষ্টের লেখক বিদ্রোহী , তার অনুমতি ক্রমে এখানে পোষ্ট করা হলো।
বিষয়: বিবিধ
২৫০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন