অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ (বাস্তব ঘটনার আলোকে গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ২৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১০:৪৮:৫৩ রাত
ছেলেটি একেবারে হন্তদন্ত হয়েই আমার নিটক এসে বল্লো, 'আঙ্কেল, আমাকে এক হাজার দেরহাম দেন তো, আমি কালকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
রুবেল, একজন বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ীর ছেলে। বয়সের কারণে বাবা দেশে ফেরৎ যাওয়ার পর নিজেই এখন ব্যবসায়ের মালিক। তার হঠাৎকরে এক হাজার দেরহাম চেয়ে বসার বিষয়টি স্বাভাবিক না ঠেকলেও টাকাটা দিতে দিতে বসতে বললাম, চা/কফি পান করে যেতে বললাম। লক্ষ্য করলাম, যেন সে প্রায় দৌড়ের উপর আছে। 'একটু তাড়া আছে আঙ্কেল, আরেকবার এসে খাবো' বলে টাকাটা নিয়ে চলে গেলো।
ইতোমধ্যে প্রায় ডজন খানেক 'কাল' চলে গেলো, কিন্তু রুবেল আর এক হাজার দেরহামের কোন খবর নেই। টাকার জন্য তাগাদা দিতে লজ্জা হচ্ছিল আমার। কারণ, ছেলেটি আমাকে যে পরিমাণ সম্মান আর ভালোবাসে তার নিকট এক হাজার দেরহাম কিছুই না। 'হয়ত ভুলে গেছে, মনে হলে নিজেই পাঠিয়ে দেবে'- বলে মনকে বুঝাতে গিয়ে নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম।
মাস খানেক পরের ঘটনা। আবুধাবির একটি ইরানী মালিকানাধীন সুপার মার্কেটের কেশ কাউন্টারের সামনে জটলা দেখে অগ্রসর হয়ে দেখলাম রুবেলকে নিয়েই হৈচৈ। সিকিউরিটি গার্ড তার সার্টের কলার চেপে ধরে আছে এবং মার্কেটের ম্যানেজার পুলিশকে ফোন করার জন্য অধিনস্ত একজনকে নির্দেশ দিলেন। ম্যানেজার আমার পূর্ব পরিচিত। তাঁকে অনুরোধ করলাম, একটু পরে পুলিশে ফোন করতে, বিষয়টি আমি একটু জানতে চাই। আমি মনে করেছিলাম কোন মেয়েকে টিজ করেছে হয়ত সে। আজকাল এই বয়সি ছেলেদের এটি প্রায় কমন সমস্যা।
না, ঘটনা যা শুনলাম তা নিজের কান আর চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। ম্যানেজারের ভাষ্যমতে সে চুরি করতে গিয়ে, মানে মাল নিয়ে বিল না করেই চলে যাওয়ার সময় তাকে ধরেছে। আমি নিশ্চয়তার সাথে ম্যানেজারের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে বললাম, আপনাদের কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। এ ছেলে এমনটি করতে পারে না। সে নিজেই একজন ভালো ব্যবসায়ী। রুবেলও অনেকটা আমাকে সমর্থন করার ভান করছিল।
ম্যানেজার আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভিডিও ফুটেজ দেখার অনুরোধ করলেন। ফুটেজে দেখতে পেলাম, এর আগে আরো কয়েকবার সে এ কাজ করেছে। 'আমরা শতভাগ নিশ্চত হয়েই তাকে ধরেছি'- বললেন ম্যানেজার। রুবেলের দিকে তাকাতেই সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললো, ' আঙ্কেল, আমি আপনার সেই রুবেল নেই। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। বিগত ছয়মাস ধরে আমি সব হারিয়ে পথে পথে ঘুরছি। আপনাকেও বলিনি ব্যপারটা। দয়া করে আমাকে পুলিশে দেয়া থেকে রক্ষা করেন, সব খুলে বলবো।'
ম্যানেজারকে আনুরোধ করলাম, তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। চুরি বাবৎ ক্ষতি পূরণ দিতেও রাজী হয়েছি। কিন্তু তিনি দুঃখ করে জানালেন, এটা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। এধরণের কেইস,যা মালিক পক্ষের গোছরিভূত হয়ে যায়, তা তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়। নাহলে আমাদের উপর বিপদ আসবে। তারা ধরে নেবেন, এতে আমাদের কারো যোগ সাজস আছে। তাকে পুলিশে দিয়ে আইনে যা হবার তা-ই হবে।
পুলিশ আসলো, তার হাওয়াইয়া চেয়ে নিয়ে আমার সমানেই হাত কড়া পরিয়ে নিয়ে যেতে দেখে মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো। কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছিলাম না, এই ভালো ছেলেটি কিভাবে বিগড়ে গেলো এবং তার বাবার রেখে যাওয়া এতবড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই বা হাতছাড়া হলো কি করে?
রুবেলের বাবা ফজল সাহেব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও প্রবাসে এসে নিজ যোগ্যতা এবং কর্মদক্ষতার বলে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের মালিক হয়েছেন। উদার মনের এ মানুষটি ধর্মীয় নামে বেদয়াতী গ্রুপের খপ্পরে পড়ে সে গ্রুপের স্থানীয় নেতৃত্বের আসনে অধিষ্টিত। আসলে কোন ইসলামী জ্ঞানের জন্য নয়, তাঁর নিকট থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে অর্থ আদায় এবং গ্রুপে ধরে রাখার কৌশল হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আমরা কয়েকজন শেখ খলিফা বিন যায়েদ বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর স্কুলের অবকাঠামো সংস্কার, উন্নয়ন এবং নতুন একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণকে সামনে রেখে বাংলাদেশী কমিউনিটির দাতাদের নিকট অর্থ সংগ্রহের জন্য ধর্ণা দিতে হয়েছে। ফজল সাহেবও উল্লেখযোগ্য একটি এমানউন্ট দিয়েছেন স্কুলের জন্য। সেই থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়।
পরিচয়ের পর থেকে তাঁর সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। আমার কথা শুনতে নাকি তাঁর খুব ভালো লাগে। সময় পেলে ছুটে আসেন আমার নিকট। আমিও সময় করে গিয়ে তার সাথে আড্ডা দেই মাঝে মধ্যে। রুবেল তখন ইন্টারে ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা। তাঁর মুখেই শুনেছি ছেল অনেক ভদ্র নিয়মিত নামাজ আদায় করে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিএ পাশ করলেই ছেলেকে ব্যবসায়ে বসিয়ে দিয়ে তিনি দেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন।
সময়ের আবর্তে রুবেল বিএ পাশ করেছে। দু'বছর হলো প্রবাসে এসে বাবার ব্যবসায়ের হাল ধরেছে, বাবা চলে যাওয়ার পর ব্যবসায়ের মালিকও হয়েছে। কিন্তু সেই নামাজী-ভদ্র রুবেলের এই করুন পরিনতি কেন?
সে প্রবাসে আসার ছয় মাসের মধ্যে বাবার সাথে বড়োসরো একটি ঝামেলা হয়েছিল। বাবার বন্ধুরা তাঁকে(বাবাকে) এই বলে কান ভার করেছিলেন যে, তাঁর ছেলে ওহাবী হয়ে গেছে। একজন সুন্নী(!) নেতার ছেলে ওহাবী হয়ে যাওয়া কোন অবস্থাতেই সহ্য করা যায় না। বন্ধুদের প্ররোচনায় বাবা আল্টিম্যাটাম দিয়েছিলেন, যদি সে তাদের সঙ্গ না ছাড়ে তাহলে প্রয়োজনে ছেলেকে ত্যাজ্য পুত্র করবেন, সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
রুবেল ছাত্রজীবনে একটি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের দাওয়াত পেয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রবাসে এসেও সেই সাথীদেরকে খুঁজে নিয়ে তাঁদের সাথে উঠবস করে আসছিল। অন্যথায় বাবার অঢেল সম্পদ, গাড়ি-বাড়ির প্রভাব আর দুষ্টু বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল সেই ছাত্রজীবনেই।
অবশেষে বাবার ভুলের কারণে ছেলেটি অন্ধকারের দিকে ধাবিত হতে চললো। আদর্শ বন্ধুদের নিকট থেকে ক্রমে দূরে সরে গিয়ে মাজার, ওরশ আর গাঁঞ্জা-বাবা পন্থীদের খপ্পরে পড়ে গেলো। তার বাবার কয়েকজন বন্ধু, যারা উপরে উপরে ভালোবাসা প্রদর্শন করে কিন্তু তলে তলে সুকৌশলে ছেলেকে বিপথগামী করে তাদের ব্যবসায়টি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল, তারা চক্রান্তের অংশ হিসেবে রুবেলের পেছনে বন্ধুরুপী মদ আর বেশ্যার দালাল লেলিয়ে দিয়ে ওসবের নেশায় বূদ হয়ে বন্ধুর(!) টাকার অপেক্ষা না করে নিজেই টাকা ওড়ানোর যোগ্যতা সম্পন্ন(!) করে ছেড়ে দিল।
প্রতিরাতে ডিস্কোবারে গিয়ে হাজার হাজার দেরহাম অপচয়, এক ভারতীয় সুন্দরীর খপ্পরে পড়ে সমস্ত ব্যাংক ব্যালেন্স তার পেছনে ঢেলে এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ে অমনোযোগীতার ফলে আয় কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে একসময় প্রতিষ্ঠানের ভাড়া আর স্টাফ সেলারী বকেয়া পড়ে যায়। নিরুপায় হয়ে সে তার বাবার সেই বন্ধুদের দ্বারস্ত হলো, যারা পূর্ব থেকেই তৈরী ছিল সাহায্যের নামে প্রতারণার জালে আটকানোর জন্য। তার নিকট থেকে ব্লেন্ক চেকে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা ধার দিয়ে দিল। ঐ টাকা দিয়ে দোকান ভাড়া, কিছু স্টাফ সেলারী এবং বাকী টাকা ফের ডিস্কোবার এবং ঐ সুন্দরীর জন্য খরছ করে কিছুদিন পর আবার আসলো চাচা(!)দের নিকট টাকার জন্য। পূনরায় টাকা দেয়া দূরে থাক, চেকে বড় একটি এমাউন্ট বসিয়ে মামলার মাধ্যমে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটিই হজম করে নিল তারা। এসব ঘটনা ঘটেছে তার বাবা দেশে চলে যাওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে। আমিও তখন দেশে থাকার কারণে এসবের কিছু জানার সুযোগ হয়নি।
একমাসের সাজা ভোগ করে রুবেল বের হয়েছে জেল থেকে। আমার নিকট থেকে যেভাবে টাকা নিয়েছে সেরকম আরো কয়েকজনের নিটক থেকে নিয়েছে। সংবাদ পেয়ে তারা ছুটে এসেছে আমার নিকট। রুবেল এখন সর্বস্বান্ত, দেশে তার বাবার সম্পদের অভাব নেই, তাঁর নিকট থেকে টাকা আদায় করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সবাইকে শান্ত করলাম।
রুবেলকে নিয়ে দেশে গেলাম। তার বাবা ফজল সাহেবের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করে যাবতীয় ঘটনা তুলে ধরার পর তিনি অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁর নিজের ভুলের কারণে আজ তার ছেলের এই পরিণতি। ছেলে যদি তার লাইনে থাকতো তাহলে ভালো বন্ধুদের সংস্পর্ষে ভালোই থাকতো। তিনি নিজের ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে আগামীতে সহিহ দ্বীনের উপর চলার অঙ্গীকার করে বললেন- এতে কেউ আমাকে ওহাবী বললেও কিছু যায় আসে না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বাপ ছেলে দুজনই শিশুর মতো কান্না করলেন অনেক্ষণ। সম্পদের ক্ষতি হলেও ছেলে ফিরে পাবার আনন্দে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন।
সাহায্যকারী মনে করে আমাকেও ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না। তাদের দীর্ঘ নেক হায়াত এবং সঠিক দ্বীনের উপর অটল থাকার দোয়া করে প্রস্থান করলাম।
(বি:দ্র: নামগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
বিষয়: বিবিধ
১১৭২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন