আমি বিজয় দেখেছি-
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০২:১৮:২৩ দুপুর
নেহায়েত ছোট ছিলাম না, সেবছরই বাকলিয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। বাবা আওয়ামিলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাই যুদ্ধের শুরুতেই শহর ছেড়ে রাউজান থানার চিকদাইর ইউনিয়নের ফইল্লাতলী হাটের পাশে এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সপরিবারে। তখনো রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়নি, আশপাশের পরিচিত বিহারী ও মুসলিম লীগের লোকজন বাবার পরিচয় ফাঁস করে দেয় কিনা, সে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া।
পুরা নয়টি মাস ঐ গ্রামেই অবস্থান করেছি। মুক্তি যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ফইল্লাতলী হাটে কয়েকজন রাজাকার আর পাকসেনা হানা দিয়েছিল এক হিন্দু ডাক্তারকে ধরে নেয়ার জন্য। আমিন রহমান খলিফা নামে ষাটোর্ধ বয়সী শ্মশ্রু মন্ডিত এক ভদ্রলোক উর্দুতে বাতচিত করে ঐ ডাক্তারকে পাকসেনাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে ঐ গ্রামে বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আমিন রহমান খলিফার সাথে তিনি ঐ এলাকার একমাত্র জামায়াতের রোকন ছিলেন।
কৌতুহল বশঃত ঐ পাকসেনাদের পিছনে আমরা ছোটরা দৌঁড়াতে ছিলাম। হঠাৎ এক সেনা ‘সালা মাদার চো..’ বলে আমাদের দিকে রাইফেল তাক করেছিল। সে গালির আওয়াজ এখনো ভুলতে পারিনি। কয়েক বছর আগে সামু ব্লগে অমি রহমান পিয়াল নামের নাস্তিকটি আমাকে গালি দেয়ার পর তাকে ঘটনাটি লিখে মন্তব্য করেছিলাম, এখনো যারা ব্লগে ভিন্ন মতাবম্বীদেরকে গালি দেয়, তাদের মধ্যে পাক সেনাদের রক্ত আছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। তারপর থেকে তিনি আমার নিকট থেকে সট্কে পড়েছিলেন।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকান সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বাংলার পথে রওয়ানা দেয়ার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর শান্তু গ্রামটিও অশান্ত হয়ে ওঠলো। বাঁচার জন্য লোকেরা নিজ নিজ উঠানের মধ্যে গর্ত খোঁড়া শুরু করলো। আমরা যে বাড়ীতে থাকতাম বাবার নেতৃত্বে ওই বাড়ীর উঠোনে ‘W’ আকৃতির একটি গর্ত তৈরী করা হলো, যেন বোমা নিক্ষিপ্ত হলে আমার গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারি।
১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে পাক আর্মীর আত্মসমর্পনের গুঞ্জন প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে ঈদের আনন্দের মতো পরিবেশ তৈরী হলো। আশাপাশের মুক্তি যোদ্ধারা ফইল্লাতলী হাটে অবস্থিত চিকদাইর ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে জাড়ো হতে লাগলেন। আমার ফুফাতো ভাই মাহবুবের নেতৃত্বে একদল মুক্তি যোদ্ধা আমাদের বাসায় আসলো। বাবা তাদেরকে আপ্যায়ন করালেন।
সন্ধ্যা নাগাদ এলাকার প্রায় সকল রাজাকার ধৃত হলো মুক্তি যোদ্ধা এবং স্থানীয় জনগণ কতৃক। হঠাৎ আত্মসমর্পন করার কারণে রাজাকারেরা পালানোর সুযোগ পায়নি। তাছাড়া তাদেরতো পালানোর জন্য কোন দেশই ছিল না। ডিসেম্বরের কন কনে শীতের রাতে টিউব ওয়েল দাবিয়ে ঠান্ডা পানি মেরে মেরে রাজাকারদের আপাদ মস্তক ভিজিয়ে দেয়ার কাজে আমরা ছোটরা ছিলাম অগ্রগামী। মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেলের গুতা, লাঠি, কিল-ঘুষি আর লাথি মেরে মেরে তাদেরকে হত্যা করেছিল।
আজকে যাদেরকে রাজাকার বানিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে তারা মোটেই রাজাকার ছিলেন না। আধা সামরিক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল খেটে খাওয়া রিকশা ঠেলা ওয়ালা জাতীয় লোকেরা। বিজয় অর্জনের পর একটা রাজাকারকেও অক্ষত রাখা হয়নি। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
তখন সরকারী বাহিনীর কাছাকাছি ছিল মুসলিম লীগ। তারাই ছিল সরকারে, জুলুম করার কারণে মুসলিমলীগ বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তৎকালীন ক্ষুদ্র দল জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী এবং ছাত্রসংঘ অবশ্যই পাকিস্তান টিকে থাকার পক্ষে ছিল, কিন্তু জুলুম এবং হত্যাকান্ডের মাধ্যমে নয়। জামায়তের নেতারা বিপদগ্রস্তদেরকে সাহায্য করেছিলেন বলেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা বহাল তবিয়তে দেশে ছিলেন এবং জনগণ তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও দায়ের করেনি। পরে তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনে অংশগ্রহন করেছেন। জামায়াতে ইসলামী জনগণের রায় নিয়ে সরকার গঠনের কাছাকাছি আসার কারণে আজকে তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী এবং নাস্তিকেরা মিথ্যা সাক্ষী তৈরী করে ভালো মানুষগুলোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে তাদের অন্তর্জ্বালা প্রশমিত করার চেষ্টা করছে।
আজকে বিতর্কিত হওয়ার ভয়ে যেসব প্রত্যক্ষ সাক্ষী সত্য প্রকাশ না করে চুপ রয়েছেন তাদের এ নিরবতা প্রকারন্তরে সম্মতির লক্ষণ হিসেবে মিথ্যুকদের পক্ষে যাচ্ছে। সুতরাং প্রত্যক্ষ সাক্ষীগণ যারা কলম ধরতে জানেন তাদের উচিৎ ভবিষ্যৎ পজন্মের জন্য সত্য ইতিহাস রেখে যাওয়া।
ইতিহাসের সাক্ষি হিসেবে আমার সাক্ষি রেখে গেলাম।
বিষয়: বিবিধ
১১১৫ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরে জেনেছি- ইহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল ভূখণ্ডের বাইরে সবচেয়ে বড় নৌবহর।
এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের একটি অংশ। বর্তমানে এর গ্যারিসন ঘাঁটি জাপানের ইয়োকোসুকা। এই নৌবহরের অধীনে রয়েছে ৬০ থেকে ৭০টি যুদ্ধ জাহাজ, ২০০-৩০০টি যুদ্ধ বিমান, প্রায় ৪০,০০০ নৌসেনা।
ষষ্ঠ বা অষ্টম সম্পর্কে আমারও ধারণা নেই। ধন্যবাদ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
০ জামায়াতের লেতারা এত ভাল লোক ছিল !!
আপনি ক্রমাগত লিখতে থাকুন এ নিয়ে এবং জনমত গোড়ে তুলুন । বদলে ফেলুন এতদিনের শেখানো ইতিহাস।
আপনার লেখায় আরেকটু সাহিত্য মিশিয়ে ইতিহাস লিখা শুরু করতে পারেন ।
ধন্যবাদ আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন