প্রবাস কাহিনী- ১১
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ২৬ অক্টোবর, ২০১৫, ১১:৪১:৪৮ রাত
প্রবাসীর হিসাব নিকাশ :
আগেই বলেছিলাম, আমার আব্বাও আবুধাবি প্রবাসী ছিলেন এবং তিনিই আমাকে ভিসা দিয়ে আবুধাবি এনেছেন। আমার প্রবাসে আসার প্রায় বছর খানেক পর আব্বা আমাকে ডেকে বসালেন এবং বললেন আমার নিকট আরো দুই হাজার দেরহাম পাওনা আছেন। আমি থথমত খেয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, আব্বা এসব কী বলেন? কারণ, আব্বার সাথে টাকা কড়ি নিয়ে হিসেব করতে হবে তা আমার মাথায় মোটেই ছিলনা। আমার ধারণা ছিল, আয়ের একটা অংশ আব্বাকে দিয়ে আসছি এবং তা দিতে থাকবো। তাঁর প্রয়োজনের দিক বিবেচনা করে সেটা বেশী-কম হতে পারে। দেখলাম ডাইরির পাতায় আমার নামে একটি হিসাব, এবং এক পাশে আমার ভিসা টিকেট সহ যাবতীয় খরচের এমাউন্ট এবং অন্য পাশে আমি যা দিয়েছি তা লিখে রাখা হয়েছে। ওখান থেকে যোগ বিয়োগ করে জানালেন যে আমাকে ঐ বাবৎ আরো দুই হাজার দিরহাম দিতে হবে। ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে বাবার নিকট থেকে উঠে এলাম।
বিষয়টি আমার নিকট খুবই বেদনাদায়ক ঠেকলো। ভাবনায় এলো- মা নেই, বাবাও কি আমাকে আলাদা করে দিচ্ছেন? আমার একটা দোষ হচ্ছে, আমি অভিনয় পারি না। অর্থাৎ মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা রেখে মুখে নকল হাসি ফোটাতে পারি না। তাই আমার অন্তরের অভিব্যক্তি সহজেই চেহারায় ফুটে ওঠে এবং সঙ্গত কারণে মন খারাপের বিষয়টি আমার চেহারায় ফুটে উঠলো।
আমার মন খারাপ ভাবটি লক্ষ্য করে বাবা হয়ত মনে মনে হাসছিলেন। দু’দিন পর তিনি আমাকে আবার ডেকে বসালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন আমার মন খারাপ কেন? আমি সুযোগ পেয়ে মনের কথাটি তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, “হিসাব করার কারণে তুমি আমার সাথে হয়ত অভিমান করেছ, বাস্তবে তোমার স্বার্থেই আমি হিসেবটা করেছি। তুমি প্রবাসে নতুন এসেছো, আল্লাহ চাহেনতো একদিন বেশ টাকা কড়ির মালিক হবে। তোমার মা নেই, অন্যরা মনে করে বসবে আমার সব টাকা তোমাকে দিয়েছি, তখন তোমার সাথে হাছদ করতে পারে। হিসাবটা পরিস্কার থাকলে কেউ এমন সুযোগ পাবে না।” বাবার এ বক্তব্য শুনে মন থেকে দুঃখের মেঘ সরে গেলো।
হিসাব সংক্রান্ত বাবার দূরদর্শী এ শিক্ষা থেকে বেশ উপকৃত হয়েছি এবং বাস্তবে দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আশপাশের প্রাবাসীদের এ সংক্রান্ত অনেক বিচার ফয়সালাও করতে হয়েছে।
অনেক প্রবাসী ব্যবসায়ীকে দেখেছি নিজেরা একটু প্রতিষ্ঠিত হলে দেশ থেকে ভাই, শ্যালক এবং আরো নিকটাত্মীয়দেরকে নিয়ে আসেন এবং তাদের সাথে বেতন-ভাতা ইত্যাদির কোন হিসাব নিকাশ না করেই সাধারণ ভাবে প্রয়োজন পূরণের জন্য কিছু টাকা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় দেশে জমি কেনার সময় তাদেরকেও শরীক করে নেন।
ভিসা দিয়ে নিয়ে আসা লোকটি মনে করতে থাকে বড়ভাই/দুলাভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে তাকে হয়ত অংশীদারিত্ব দেবে। আবার নিয়োগকর্তা মনে করে, তাকে এত টাকা দিয়েছি, অমুক জমি কেনার সময় তাকেও শরীক করেছি, বাহিরে কাজ করলে এর অর্ধেকও পেতোনা। একসময় এ নিয়ে প্রিয় মানুষটির সাথে লড়াই-ঝগড়া, শালিশ-বিচার এবং মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে হয়।
প্রত্যেক প্রবাসীর উচিৎ, যারা নিকটাত্মীয়দেরকে প্রবাসে এনে সহযোগিতা করতে চান, তারা নিজের প্রতিষ্ঠানে তাদেরকে না রেখে অন্যত্র কাজ ঠিক করে দিলেই ভালো। আর যদি একান্ত সাথে রাখতেই হয় তাহলে বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধাদি পরিস্কার করা উচিৎ। তাহলেই কেবল ঝামেলামুক্ত থাকা যাবে।
চলবে.....
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৪ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রথমে পড়তে গিয়ে আপনার মন খারাপের মতো আমার নিজেরও কপাল কুঁচককে উঠছিলো শেষটুকু পড়ে তা মৃদু হাসিতে রুপান্তরিত হলো! আপনার আব্বা সঠিক কথাই বলেছেন।
আমাদের এখানে দুটো অবস্থা দেখি- আপন শ্যালক অনেক টাকা খরচ করে এনেছেন দুলাভাই - পুরো টাকা দুলাভাইকে শোধ দিয়েছেন এজন্য বোনের মনোকষ্ট দুলাভাই কেনো শ্যালক কে ফ্রীতে আনলেন না!
আবার শ্যালক ফ্রী আসেন কিন্তু দেবর ফুল টাকা দিয়ে আসেন এজন্য বোন খুশী থাকেন!
শুকরিয়া আপনাকে!
আপনার বাবা সঠিক কাজটিই করেছিল। আমার মনমানসিকতাও এমন। শিক্ষকতার জীবনেও এমন ছিলাম। সহশিক্ষকদের সাথে বন্ধুর মত অনেক টাকা খরচ করতাম, কিন্তু কোন লেনদের এর ব্যপারে এক টাকা পর্যন্ত ছাড় দিইনি ও নেইনি। কারণ কোন সময় যেন কারো ইহসান এর নিচে পড়ে থাকতে না হয়। এখনও এমনই।
আপনার উপদেশগুলো দারুন কাজ দেবে আশাকরি। । শুকরিয়া।
আবার আমার ভায়ের টাকা লাগলে শুধু মায়ের মাধ্যমে একবার শুনি,আর সেদিন ব্যাংক খোলা থাকলে উঠে গিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দেই। দেশে থাকতেও সেটা করেছি।
আমাদের সব ভাই বোন আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তির ব্যাপারে বলেছে...এর উপর কোনো দাবী নেই...সবাই আমার ভাইকে দিয়ে দিয়েছে। আমরা একে অপরের জন্যে চোখ বন্ধ করে সাহায্য করি, না চাইলেও করি। এবং জীবনেও এর হিসাব করিনা। আমার আব্বাও কখনও হিসাব করেনি। দেদারছে পয়সা উড়িয়েছে। কারো পয়সা দরকার হলে কেন লাগবে তা জিজ্ঞেস করত না,তবে বুঝে নিত কেন লাগছে। আর আমার মাকে আমরা অনেকে সম্মানী স্বরূপ নগদ টাকা দেই। আমি তাকে বলি যা দিলাম তা অবশ্যই ১ মাসে শেষ করতে হবে। মা দান সদাকাহ করে শেষ করে। আমাদের সম্পর্কগুলো এরকম....বেহিসেবী...
মন্দ হোক ভাল হোক, বাবা আমার বাবা
পৃথিবীতে তার মত আর আছে কে বা?
-অনেক ধন্যবাদ ...
মন্দ হোক ভাল হোক, বাবা আমার বাবা
পৃথিবীতে তার মত আর আছে কে বা?
-অনেক ধন্যবাদ ...
মন্তব্য করতে লগইন করুন