প্রবাস কাহিনী- ৮
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ০৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৯:৪৭:০৩ রাত
তিন মাসের ব্যাংক স্ট্যটমেন্ট এবং আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র নিয়ে ফ্যামিলি ভিসার ফাইল জমা করতে গিয়ে ‘মোসাম্মৎ’ এর কারণে ফাইল জমা করতে পারলাম না। সংশ্লিষ্ট অফিসার বাঙ্গালীদের উপর বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘সু হাজা! কুল্লু হারীম আল বাঙ্গালী ফি মোসাম্মৎ-মোসাম্মৎ, সু মোসাম্মৎ?’ অর্থাৎ এটা কি! প্রতিটি বাঙ্গালী নারীর নামের সাথে মোসাম্মৎ-মোসাম্মৎ, মোসাম্মৎ কি? আমাকে মন খারাপ করে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অফিসারের এবার শান্ত হয়ে আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘তোমার স্ত্রীর নামের আগে যে মোসাম্মৎ শব্দটি আছে এটা অতিরিক্ত। তোমার ভিসার ফাইল আমি জমা নিতে পারি, কিন্তু ফেরৎ আসবে। তাছাড়া এখান থেকে বে-খেয়ালা ভিসা দিয়ে দিলেও এয়ার পোর্টে আটকাবে। তারচেয়ে ভালো, তুমি এই মোসাম্মৎ শব্দটি কাটিয়ে নিয়ে এসো।’
আমাদের দেশের মৌলভী এবং বিবাহ রেজিষ্টার কাজী সাহেব চোখ বন্ধ করেই প্রতিটি মেয়ের নামের আগে ‘মোসাম্মৎ’ শব্দটি জুড়ে দেন, কারো সাথে কোন পরামর্শ এবং জিজ্ঞাসা ব্যতিরেখেই। এটা যেন তাদের মৌলিক অধীকার মানুষের মেয়েদের নামের আগে মোসাম্মৎ জুড়ে দেয়া। বেক্কেল সব।
বৃটিশ পিরিয়ডে অবশ্য হিন্দু ভদ্র লোকেরা বৃটিশদের সাথে মিলে মুসলমানদেরকে যেসব মানসিক নির্যাতন করতো তার অন্যতম ছিল মুসলমানদের নামের আগে শ্রী ও শ্রীমতি লিখতে বাধ্য করা। এ থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য মুসলিমরা তখন তাদেরকে মোহামেডান, পুরুষদের নামের আগে এভারিজ মোহাম্মদ এবং মুসলিম মেয়েদের নামের আগে মোসাম্মৎ(নাম রাখা হয়েছে) লিখে শ্রী-শ্রীমতির তান্ডব থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের কাজী সাহেবদের জানা থাকা দরকার যে, বর্তমানে এ সমস্যাটি নেই। তাছাড়া মেয়ের অভিভাবকের সাথে কোন পরমর্শ না করে নিজের খুশী মতো মোসাম্মৎ জুড়ে দেয়া একটি বড় অন্যায়।
দেশে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, যে কাজী নিকাহ নামা রেজিষ্ট্রি করেছিলেন তাঁর নিকট গিয়ে এটা সংশোধন করে পূণরায় মিনিষ্ট্রি এবং ইউ এ ই দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করে যেন পাঠানো হয়। যথেষ্ট হয়রানী এবং টাকা খরছে করে প্রায় ১৫দিন পর ‘সোসাম্মৎ’ ছাড়া নিকাহ নামা পেলাম। যথা সময়ে ফাইল জমা করে ভিসা পেয়ে গেলাম এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম চৌদ্দ মাস বয়সে রেখে আসা আমার মেয়েটির মুখ থেকে আব্বু ডাক শোনার।
ভিসা হওয়ার পর যথাসময়ে আমার স্ত্রী ও মেয়েকে আবুধাবী আনার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট আমার চাওয়া এবং সে লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা স্বার্থক হলো, আলহামদু লিল্লাহ্! আমার সেদিনের অনুভূতি ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। আমার স্ত্রী ও ফেলে আসা দুঃখের স্মৃতিগুলো প্রবাসের সুখ সাগরে বিলিন করে দিয়ে স্বস্তি পেল।
আমাদের দেশের অধিকাংশ বিবাহিত মেয়ের একটি মারাত্মক সমস্যা হলো- শ্বশুর বাড়ীতে সে কাজের মেয়ের মতো হয়ে থাকতে পারলে শ্বশুর-শাশুড়ীর নিকট হয় ভালো পুত্র বধূ, দেবর-ননদের সেবা করতে পারলে হয় ভালো ভাবী। কিন্তু স্বামীর সাথে সুসম্পর্ককে দেখা হয় বাঁকা চোখে। এমতাবস্থায় বলতে থাকে- তাদের পুত্রকে/ভাইকে দজ্জাল মেয়েটি হাত করে ফেলেছে। এখন তাদের হবে কি! ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্ত্রীকে বিদেশে স্বামীর নিকট নিয়ে যাওয়াকে আরো মারাত্মক দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেক শ্বশুর-শাশুড়ী আছেন, তারা নিজের মেয়েকে কোন প্রবাসীর নিকট বিয়ে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করে নেন জামাই বাবু তাদের মেয়েকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে তো! পক্ষান্তরে পুত্রবধূর বেলায় চিন্তা করা হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এবং নানা কলা কৌশল আর ছল চাতুরি করতে থাকে পুত্রবধূর বিদেশে স্বামীর নিকট যাওয়া ঠেকাতে।
আমার এক বন্ধুর মা তার পুত্রবধূকে প্রবাসে আনার দিন নাতির শোকে মুর্ছা(বেহুস হয়ে যাওয়া) গিয়েছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত মাকে বাঁচানোর জন্য ছেলে তার স্ত্রীর প্রবাসে আসা বাতিল করেছিল। পরে একসময় প্রমাণিত হয়েছে সেদিনের মুর্ছা যাওয়ার ঘটনা ছিল পুত্রবধূর বিদেশ যাওয়া বন্ধ করার জন্য স্রেফ অভিনয়।
এক্ষেত্রে আমার আব্বা ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি সবসময় আমার সুখ ও কল্যাণ কামনা করতেন। আমার ফ্যামিলি বিদেশে আনতে পারার জন্য তিনি দোয়া এবং উৎসাহিত করতেন। আল্লাহ আমার মরহুম আব্বার প্রতি সেরকম রহম করুন যেমনটি তিনি আমার প্রতি করেছেন। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।
বিষয়: বিবিধ
১৩০৯ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাস্তব লিখা অনেক ভাল লাগল ধন্যবাদ ভাইয়া ।
মোসাম্মতের যুগ এখন আর নাই বললেই চলে! আগে খুব শুনতাম! সাথে বেগম-খাতুনের ব্যবহার!
অনেক প্রবাসী পরিবারের কাছেই শুনেছি বিয়ের পর বউ আনা নিয়ে সমস্যার কথা। খারাপ লাগলে দ্বি-মুখী চরিত্রের কথা জেনে!
শুকরিয়া চমৎকার উপস্থাপনার জন্য!!
সব মা-বাবা অবশ্য এমন নয়, যাদের কপাল খারাপ তারাই এসব তামাশা করে।
যেমন ১৬বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
এদের মধ্যে ঘরের বড় ছেলে
তার পরিবার।
প্রবাস স্বপ্ন শিরোনামে আমি একটি লেখা শুরু করেছিলাম এবং কয়েক পর্ব লিখেওছিলাম। আবার শুরু করবো এবং আপনাদের লেখা থেকে তথ্য উপাত্য নেব। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন