প্রবাস কাহিনী- ৭

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ০৪ অক্টোবর, ২০১৫, ১০:৩৩:১৯ সকাল

সবদিক বিবেচনা করে ইলেক্ট্রোনিক্স রিলেটেড ব্যবসায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আবুধাবীতে তখন মার্কেট বলতে ওল্ড সেন্ট্রাল মার্কেট এবং নিউ সেন্ট্রাল মার্কেটকেই বোঝানো হতো। ওল্ড মার্কেটের অবস্থান ছিল হামদান এবং খলিফা স্ট্রিটের মাঝ খানে আর নিউ মার্কেট ছিল খলিফা এবং করনিশ স্ট্রিটের মাঝখানে। খলিফা স্ট্রিটে ওভার ব্রিজ দিয়ে মার্কেট দু’টোকে সংযুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে মার্কেটদ্বয় ভেঙ্গে সেন্ট্রাল মার্কেট নাম দিয়ে বহুতল বিশষ্ট দুটি নান্দনিক মার্কেট বানানো হয়েছে। আরবীতে বলা হতো ছুক, ছুক বলতেই ঐ মার্কেটদ্বয় ছাড়া আর কিছুই বোঝানো হতো না। অন্যান্য পয়েন্ট থেকে আবুধাবী শহরে আসার জন্য টেক্সি ওয়ালারা ‘ছুক - ছুক বলে হাঁক দিতো।

বর্তমান এবং সেই পুরানো সময়ের মার্কেটের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তারপরও সেই পুরানো মার্কেট ছিল বাঙ্গালি, পাকিস্তানী এবং ভারতীয়দের অর্থোপার্জনের প্রাণ কেন্দ্র। আরবীদের নিকট থেকে একেকেকটি বড়সর দোকান নামমাত্র ভাড়ায় দীর্ঘ মেয়াদী লিজ নিয়ে ছোট ছোট করে ভাড়া দিয়ে অনেক উপার্জন করতো বুদ্ধিমানরা। বাঙ্গালীরা ছিল এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে।

আমার প্রস্তাবিত ইলেক্ট্রোনিক্স দোকানগুলোর সিংহ ভাগই ছিল ওল্ড মার্কেটে। এখানে ছোট ছোট দোকানের এতবেশী ভাড়া, ভয় হচ্ছিল আবার ক্ষতির সম্মুখিন হই কি না। তাই দোকান খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম মোসাফ্ফাহ শিল্প নগরীতে। আবুধাবী সিটি থেকে প্রায় ৪০ কি.মি দূরে এ শিল্প নগরী। এর আয়তন আবুধাবী সিটির চেয়েও বড়, তবে তখনো পঞ্চাশ শতাংশের বেশী উন্নয়ন হয়নি।

মোসাফ্ফাহর প্রায় প্রতিটি অলি-গলি ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং অবাক হলাম, একটিও ইলেক্ট্রোনিক্স (রিপেয়ারিং, এক্সেসারিজ, এপ্লায়েন্সেস) এর দোকান চোখে পড়লো না। অথচ এখানে আবুধাবীর সমস্ত গাড়ী মেরামতের কাজ করা হয়। আবুধাবী সিটিতে কাজ করার জন্য গাড়ির বনেট খোলাও বে-আইনী। আর যাহাই হোক গাড়ির রেডিও এন্টেনা, স্পিকার, রেডিও এবং কেসেট প্লেয়ারের রিপেয়ারিং এবং সেলস এখানে বেশ ভালো চলার কথা। পুরা মোসাফ্ফাহ জরিপ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, এখানেই আমার ব্যবসায় ভালো চলবে- ইনশাআল্লাহ। শুধু একটু প্রচার করতে হব।

তখন মোসাফ্ফাহ ৮,৭ এবং ৬ নাম্বার সেক্টরেই ভালো ব্যবসায় চলতো। আমার আব্বার কোম্পানীর ওয়ার্কসপও ছিল মোসাফ্ফায়। আমি এবং আব্বা মিলে আত্মীয়, বন্ধু এবং পরিচিত জনদেরকে বলে রাখলাম- এসব এলাকায় কোন দোকান খালি হলে যেন আমাদেরকে জানানো হয়।

কয়েকদিন পর জসিম ভাই নামে আমার এক আত্মীয় সংবাদ দিল তার দোকানের পাশে একটি দোকান খালি হবে, নিতে চাইলে যেন দ্রুত সাক্ষাত করি। আব্বা আর আমি বিলম্ব না করেই চলে গেলাম দোকান নেয়ার জন্য। যে লোকটি দোকান ছেড়ে যাবে তাকে দিতে হবে কী-মানি হিসেবে ৩০০০ দিরহাম। ভাড়া বার্ষিক ৬০০০ দিরহাম, দু্ই টার্মে পরিশোধ যোগ্য।

কী-মানি এবং ছয় মাসের ভাড়া বাবৎ মোট ছয় হাজার দিরহাম পরিশোধ করে দোকানের দখল সত্ত পেয়ে গেলাম। বর্তমানে অবশ্য এসব দোকানের কী-মানি লাখ দিরহামের উপর আর ভাড়াও ৫০ থেকে ৭০ হাজার দিরহামের কম নয়। আবুধাবী সিটি থেকে পেপসি কোলা (আবুধাবী আর মোসাফ্ফাহর মাঝা মাঝি একটি এলাকা) হয়ে মাত্র দু’তিন বছর হলো এ নতুন ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এলাকাটির গোড়াপত্তন হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এলাকাটি এখনো বেশ অনুন্নত। রাস্তা ঘাট প্রায় কাঁচা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং পানি সাপ্লাইও ছিল না। দৈনিক শত শত মিস্টিপানি বহনকারী এবং ময়লা পানি বহনকারী ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে ট্যাঙ্কি লোড-আনলোডের কাজ চালানো হতো। এসব কারণেই তখন দোকান ভাড়া কম ছিল। বর্তমানে এ ইন্ড্রস্ট্রিয়াল এলাকাটি বিশ্বের উন্নততম শিল্প নগরীর অন্যতম। এখানে যায়গার ভ্যালু সিটির চেয়ে কোন অংশে কম নয়, তাই ভাড়া এবঙ মূল্য পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী। মাঝে মধ্যে গুজব শোনা যায়, এলাকাটি উন্নত হওয়ার কারণে শেখদের দৃষ্টি পড়েছে, শিল্প এলাকাটি অন্যকোন মুরুভূমিতে স্থানান্তর করে এখানে শেখদের জন্য বহুতল বিশিষ্ট টাওয়ার বানানো হবে। প্রবাসীদের ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে গড়ে ওঠা এ শিল্প অঞ্চলটি থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করার গুজবটি যেন বাস্তবায়ন না হয় সে প্রত্যাশা করি।

যাই হোক, এগ্রিমেন্ট পাওয়ার পর দুবাই থেকে কিছু মালপত্র এনে দোকান চালু করলাম এবং একই সাথে ট্রেড লাইসেন্সের কাজে হাত দিলাম। এখানে ব্যবসায়ীদের জন্য মিউনিসিপ্যালিটির ট্রেড লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। এর উপরই ব্যবসায় পরিচালনা, চেম্বার অব কমার্স এর সদস্য হওয়া, ভিসা বের করা, ইলেকট্রিসিটি এবং টেলিফেোনের লাইন পাওয়া, ব্যাংক একাউন্ট খোলা সহ যাবতীয় কার্যক্রম নির্ভর করে। প্রতিবছর ট্রেড লাইসেন্স রিনিও করতে হয়।

আলহামদু লিল্লাহ্! ব্যবসায় শুরুর প্রথম মাসেই যথেস্ট সাড়া পেলাম। এজাতীয় ব্যবসায় (Car audiovisual) মুসাফ্ফাহ্ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটিতে আমিই প্রথম শুরু করেছি। অন্য কোন দোকান না থাকাতে বলতে গেলে প্রায় একচেটিয় ব্যবসায় করছি আমি। ব্যবসায় শুরুর দ্বিতীয় মাসেই ফ্যামিলি ভিসা জমা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের ফ্যামিলি ভিসার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একাউন্টে ৮০ হাজার দিরহাম সার্বক্ষণিক ডিপোজিট রাখতে হয় অথবা ব্যবসায়কে এল এল সি’তে রূপান্তরিত করতে হয়। তখন তিন মাসের ব্যাংক স্ট্যটমেন্টে উল্লেখযোগ্য লেনদেন থাকলেই ভিসা দেয়া হতো। আমার ফ্যামিলি ভিসা বের করার সুবিধার জন্য তিন মাস পর্যন্তু বন্ধুরা অনেক টাকা জমা রেখেছিলেন আমার একাউন্টে। এসব উপকারী বন্ধুদেরকে এখনো কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।

চলবে.....

বিষয়: বিবিধ

১২১৬ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

344324
০৪ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ১১:৩৭
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : আপনার গুরুত্বপূর্ন, তথ্য বহুল ও অভিজ্ঞতা লব্দ জ্ঞানটি অনেকের কাজে আসতে পারে। আপনার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানটি আমি নিজে দেখেছি, আপনাকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেতে দেখেছি। আপনার শিক্ষাগত জীবনে ইলেকট্রনিক্স এর ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় আপনার জন্য ব্যবসাটি শাপে বর হয়েছে। বাংলাদেশে প্রচুর সম্ভাবনা ময় যুবক আছে যারা কিছু করতে চায়, একটু বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে হাত বাড়ালে তারা অনেক কিছু করতে পারবে। আশা করি সে ব্যাপারটি ভাববেন।

আপনার লিখাটি পড়ার পর আমিও আমার ব্যক্তিগত কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য-উপাত্ত হাজির করব, হয়ত অনেকে উপকার হতে পারে। ধন্যবাদ
০৪ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ১১:৪৮
285641
আবু জান্নাত লিখেছেন : জ্বি টিপু ভাই, এখন থেকে লিখা শুরু করেন। পড়ার অপেক্ষায় রইলাম....
০৫ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২২
285876
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : সুন্দর মন্তব্য দিয়ে ধন্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ টিপু ভাই। আপনার অভিজ্ঞতার শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।
344325
০৪ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ১১:৪৭
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ লোকমান ভাই। আপনার অভিজ্ঞতা ও অতীত জেনে অনেক ভালো লাগছে। বর্তমানে প্রবাসীরা কিছু করতে পারে, এমন কিছু আলোচনাও যদি আপনার বিবরণীতে লিখতেন, আমরা উপকৃত হতাম। জাযাকাল্লাহ খাইর
০৫ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৮
285877
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : সচেতন প্রবাসী বন্ধুরা তাদের অর্জিত সমস্ত টাকা দেশে স্ত্রী, বাবা আর ভাইয়ের নিকট পাঠিয়ে না দিয়ে নিজের হাতে রাখতে হবে, যাতে কোন সুজোগ সামনে আসলে তা কাজে লাগানো ‍যায়। দেশে পাঠাতে হবে শুধু খরচ পরিমান। আপনার নিকট গচ্ছিত অর্থ প্রবাসে কোন কাজে লাগাতে না পারলেও আপনার সাথে থাকার কারণে ওসব আপনারেই থাকবে। টাকা অন্যের হাতে গেলে তা আর আপনার থাকবে না। এভাবে অতিরিক্ত টাকা পাঠালে দেশের লোক মনে করে বসে ওর নিকট অনেক আছে তাই পাঠাচ্ছে। লে- হালুয়া বলে শুরু করে দেয় অতিরিক্ত খরছ। ধন্যবাদ।
০৫ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:২০
285899
আবু জান্নাত লিখেছেন : বিবেচনার মত একটা পরামর্শ পেলাম। শুকরিয়া ভাই।
344394
০৪ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ। আমরা যদি শ্রমিকদের একটু দক্ষ করে মিডল ইস্ট এ পাঠাতাম আমাদের অনেক বেশি উন্নতি হত। সেই সঙ্গে নৈতিক প্রশিক্ষন ও দেওয়া জরুরি। তবে আমাদের দেশের বেশিরাগ মানুষই ব্যবসায় এর ঝুঁকিনিতে চায়না। আত্মিয়স্বজন রাও সাহাজ্য না করে বাধা দেয়।
০৫ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৯
285878
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ধন্যবাদ সবুজ ভাই।
344450
০৫ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১২:৪৪
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ।
০৫ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩০
285879
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, মিয়াজী ভাই।
344595
০৫ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:৫৬
আফরা লিখেছেন : ভাল লাগল ধন্যবাদ ভাইয়া ।
০৯ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ১১:৩৯
286374
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
346133
১৮ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ১২:৪০
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : লিখাটা পড়ে আপনার ব্যবসায়ের অনেক কিছুই জানতে পারলাম, ধন্যবাদ আপনাকে।
১৯ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ০২:০৯
287413
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : সাথে থাকার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, মামুন ভাই।
349689
১৪ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৫৩
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ..অনেক অনেক ধন্যবাদ..
১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ১১:৩৯
294287
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, ভাই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File