প্রবাস কাহিনী- ৫

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৫০:৫১ সকাল

তখন আবুধাবীতে ভিজিট ভিসায় এসে ইনভেস্টর হিসেবে রেসিডেন্স ভিসা লাগানোর ব্যবস্থা উম্মুক্ত ছিল। (বর্তমানেও ব্যবস্থাটি আছে, তবে খুব সীমিত এবং ব্যয়বহুল) আমার সাথে বাংলাদেশ থেকে এসেছিল মনছুর নামের এক ছেলে। দুজন মিলে ব্যবসায় করার কথা। মনছুরের পক্ষ থেকে ওর বড় ভাই এবং আমার পক্ষে আমার আব্বা পুঁজি যোগান দেওয়ার কথা থাকলেও বাবার সমস্যার কারণে পুঁজি জোগান দিতে অপারগ হলেন।

শেষপর্যন্ত আমার পার্টনারের সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হলাম যে, আমাদের দু’জনের নামে ট্রেড লাইসেন্স করা হবে, আমি যখনই প্রয়োজনীয় পুঁজি যোগান দিতে পারবো তখন ব্যবসায়ে সক্রিয় হবো অথবা লাইসেন্স থেকে আলাদা হয়ে আমার সুবিধা মতো ব্যবসায় করবো। আপাতত তাকে একটি ভিসার নুন্যতম যে দাম তা পরিশোধ করা হবে এবং তত দিন আমি অন্যত্র চাকুরী করবো।

প্রবাস জীবনে যে বিষয়টি আমাকে খুব ব্যথিত করে তা হলো- স্ত্রী এবং পরিবার পরিজন থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা। অনেক প্রবাসী আছেন যারা বাধ্য হয়েই এক, দুই বা তিন বছর পর এক, দুই বা তিন মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। অর্থাৎ বছরে একমাস মাত্র পরিবারের সাথে সময় দিতে পারছেন। কেউ যদি ১২ বছর প্রবাসে থাকেন সেই ১২ বছরে পরিবারে সময় দিচ্ছেন মাত্র এক বছর। বিষয়টি অত্যন্তু অমানবিক। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রবাসের শুরুতে আমি এমন অমানবিক পরিস্থিতি থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চেয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে থাকি।

আমার সিদ্ধান্ত ছিল- যদি ২/৩ বছর সময়ের মধ্যে ফ্যামিলি আনার মতো তাওফিক আল্লাহ দান করেন তাহলে প্রবাস জীবন দীর্ঘ করবো, আর যদি তার কোন সম্ভাবনা পরিলক্ষিত না হয়, তাহলে দুই আড়াই বছরের মধ্যে প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে চলে গিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো কিছু করবো। গতবার অন্যের মাধ্যমে টাকা কামাতে গিয়ে যে প্রতারণার খপ্পরে পড়েছিলাম সে বিষয়টিও মাথায় থাকবে। বাড়ি-গাড়ির চেয়ে পারিবারিক সুখ-শান্তির মুল্য অনেক বেশী। সিদ্ধান্তের পক্ষে কঠিন অবস্থান নিয়ে আল্লাহর নিকট সর্বদা দোয় করতে থাকতাম, দুয়েরে মধ্যে যেটি আমার জন্য কল্যাণকর সেটি যেন আমার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দয়া করে বরাদ্ধ করেন।

প্রবাসে এসে এমন প্রবাসী দেখার দুর্ভাগ্যও হয়েছে; দেশ থেকে আসার সময় একটি নবজাতক সন্তান রেখে এসেছেন, দেখতে দেখতে ছেলেটি বা মেয়েটি বিবাহের বয়সে পৌঁছে গেছে কিন্তু বাবার সাথে দেখা হয়নি একটি বারের জন্যও। এদের কেউ ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার আবার কেউ কেউ ডিস্কো বার, মদ-জুয়া সহ নানাবিধ অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।

আরেক শ্রেনীর প্রবাসী দেখেছি, যারা টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেন না। বছরে ২/৪ বার পরিবারের সাথে সময় দেওয়ার সূযোগ আছে। এমনকি বিদেশে পরিবার রাখারও সামর্থ্য আছে। কিন্তু ঐ দিকে সময় দিতে গেলে ব্যবসায়ে লাভ কম হতে পারে, পরিবার সাথে রাখলে খরছ বেশী হতে পারে ইত্যাদি বিবেচনায় এনে পরিবার পরিজনকে সময় দেয়া থেকে বিরত থাকেন। দেশে বিল্ডিং, জায়গা-জমি ও ব্যাংক ব্যালেন্স করেন প্রচুর। আমার এ টাইপের একজন সিনিয়ার প্রবাসী বন্ধু তাঁর স্ত্রীর দীর্ঘশ্বাস যুক্ত কমেন্ট আমার সাথে শেয়ার করেছিলেন- “তোমার গাড়ি-বাড়ি থাক বা না থাক, তোমাকে আমার দরকার ছিল আরো ২০ বছর আগে। এখন এই গাড়ি বাড়ি দিয়ে আমি কী করব?” ছেলে বড় হয়েছে ছেলেকে বিদেশের ব্যবসায় বসিয়ে তিনি দেশে সময় দিচ্ছেন প্রচুর। লেটেস্ট মডেলের নিজস্ব গাড়ীতে চড়ে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু হারিয়েছেন যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু যা এখন দুনিয়া পরিমান মম্পদ ঢেলে দিলেও পাওয়া সম্ভব নয়।

আমরা দেখেছি অধিকাংশ প্রবাসী বন্ধু অপরিকল্পিত প্রবাস জীবন যাপন করেন, এটা মোটেই ঠিক নয়। সুন্দর পরিকল্পনা ছাড়া কোন কাজই সুন্দর হয়না, কাকতালীয় ব্যাপারটি অবশ্য ভিন্ন কথা। সুতরাং প্রবাসীদেরও একটি পরিকল্পনা থাকা চাই। প্রবাসে টাকার জন্য অনেক সময় অনাকাঙ্খিত কাজও করতে হয়। কিন্ত দেশে তার চেয়ে আরো ভালো কাজ করতে বললেও প্রেস্টিজ খুঁজতে থাকেন। আমি যখন প্রবাসী হয়েছি ঠিক তার কাছাকাছি সময়ে আমাদের গলির মুখে বাবুল মিয়া ডাল-চাল-তেল-নুনের একটি ছোট্ট দোকান খুলে বসেছিল। আজ সে বাবুল সওদাগর, সেও জায়াগা জমিনের মালিক হয়েছে, ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। বোনাস হিসেবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সার্বক্ষনিক সাথে পেয়েছে। এবং বলবো, সে একজন প্রবাসীর তুলনায় অধীক সুখী।

সুতরাং প্রবাসী বন্ধুগণ, জীবন যৌবন প্রবাসে ঢেলে না দিয়ে ২/৪/৬ বছরের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। এর মধ্যে পরিবার সাথে রাখার ব্যবস্থা হলে তো ভালো। নাহয় ঐসময়ের জমানো টাকা দিয়ে দেশে কিছু করার নিয়্যাত করে প্রবাসকে ছালাম বলুন। মানুষ যা চায় তাই সে পায়।

আমার ছোট বেলার একটি ঘটনা : আমাদের পাশের একজন লোক সৌদি আরব গিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে এসেছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো কেন সে এতটাকা খরছ করে গিয়ে ফিরে আসলো। সে জবাবে জানালো- “আমি সৌদি আরব গিয়ে মানুষের টয়লেট পরিস্কার করার চেয়ে চকবাজারে বসে তরকারী বিক্রয় করাকে ভালো মনে করি”। লোকটি এখনো বেঁচে আছেন এবং চকবাজারে তরি তরকারী বিক্রয় করে সুন্দর জীবন যাবন করছেন।

বিষয়: বিবিধ

১৬৭০ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

342453
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:০৩
আফরা লিখেছেন : লিখাটা পড়ে অনেক প্রবাসী জীবন নিয়ে সুন্দর পরিকল্পনা নিতে পারবে ।ধন্যবাদ ভাইয়া ।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৪
285143
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
342473
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:৩৮
ব্লগার সাজিদ আল সাহাফ লিখেছেন : প্রবাসী জীবনের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন! আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন। আমিন।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৪
285144
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সাজিদ ভাই।
342506
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:৩০
আবু জান্নাত লিখেছেন : আপনার এ পোষ্টে আমার শিখার মত অনেক কিছু পেলাম।
১।
কেউ যদি ১২ বছর প্রবাসে থাকেন সেই ১২ বছরে পরিবারে সময় দিচ্ছেন মাত্র এক বছর। বিষয়টি অত্যন্তু অমানবিক।

২।
তোমার গাড়ি-বাড়ি থাক বা না থাক, তোমাকে আমার দরকার ছিল আরো ২০ বছর আগে। এখন এই গাড়ি বাড়ি দিয়ে আমি কী করব?

৩।
সুতরাং প্রবাসীদেরও একটি পরিকল্পনা থাকা চাই।
৪।
জীবন যৌবন প্রবাসে ঢেলে না দিয়ে ২/৪/৬ বছরের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। এর মধ্যে পরিবার সাথে রাখার ব্যবস্থা হলে তো ভালো। নাহয় ঐসময়ের জমানো টাকা দিয়ে দেশে কিছু করার নিয়্যাত করে প্রবাসকে ছালাম বলুন। মানুষ যা চায় তাই সে পায়।
৫।
আমি সৌদি আরব গিয়ে মানুষের টয়লেট পরিস্কার করার চেয়ে চকবাজারে বসে তরকারী বিক্রয় করাকে ভালো মনে করি।

৬।
যদি ২/৩ বছর সময়ের মধ্যে ফ্যামিলি আনার মতো তাওফিক আল্লাহ দান করেন তাহলে প্রবাস জীবন দীর্ঘ করবো, আর যদি তার কোন সম্ভাবনা পরিলক্ষিত না হয়, তাহলে দুই আড়াই বছরের মধ্যে প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে চলে গিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো কিছু করবো।


আপনার এ সমস্ত কথাগুলো আমার হৃদয়ে আকড়িয়ে রাখলাম।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহ খাইর
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৬
285145
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : অসাধারণ মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, ভাই।
343597
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:৫২
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় শেয়ার করলেন যা প্রবাসীদের পরিকল্পনা তৈরিতে দারুণ কাজে দিবে। জাযাকাল্লাহ খাইরান।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৭
285146
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমাদের বেশীর ভাগ প্রবাসী ভাইয়েরা অপরিকল্পিত প্রবাস জীবন যাপন করে থাকেন।
344449
০৫ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১২:৩৬
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : লিখাটা পড়ে অনেক প্রবাসী জীবন নিয়ে সুন্দর পরিকল্পনা নিতে পারবে ।
ভাল লাগল ধন্যবাদ ।
০৫ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:০৩
285871
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ মিয়াজী ভাই।
346130
১৮ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ১১:৫৭
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, দোয়া করবেন যেন "সুতরাং প্রবাসী বন্ধুগণ, জীবন যৌবন প্রবাসে ঢেলে না দিয়ে ২/৪/৬ বছরের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। এর মধ্যে পরিবার সাথে রাখার ব্যবস্থা হলে তো ভালো। নাহয় ঐসময়ের জমানো টাকা দিয়ে দেশে কিছু করার নিয়্যাত করে প্রবাসকে ছালাম বলুন। মানুষ যা চায় তাই সে পায়।"
আপনার এই কথাটা আমল করতে পারি। লিখাটা অনেক ভাল লাগলো, ধন্যবাদ আপনাকে
১৯ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ০২:০৭
287411
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ধন্যবাদ, মামুন ভাই। একমাত্র প্রবাসীরাই প্রবাসীর দরদ বুঝে, সে আলোকেই এ লেখা।
349233
১০ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:৫২
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : প্রবাসের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা বেশ বুঝতে পারছি। যেহেতু এ পর্যন্ত কয়েকবার বাইরে যাওয়ার সৌভা্গ্য হয়েছে। সকল প্রবাসীদের জন্য সহানুভুতি এবং দোয়া রইলো...ধন্যবাদ..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File