প্রবাস কাহিনী- ২
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:০৮:৪১ দুপুর
গত পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রোষাণলে পতিত হয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পূণরায় প্রবাসী হয়েছিলাম। সন্ত্রাসীরা আমার জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল। দেখুন তো কী মহা অপরাধ করেছিলাম! -
স্বৈর শাসক এরশাদ সাহেবের পতনের প্রায় বছর খানেক আগে তিনি তাঁর আওয়ামী দোষরদেরকে খুশী করার জন্য হঠাৎ চট্টগ্রামের ৫দিন ব্যাপী ঐতিহাসিক তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। উক্ত মাহফিলের প্রধান মুফাস্সির থাকতেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব। মূলত মাওলানা সাঈদীর তাফসীর মাহফিলের বদৌলতে আমার জীবনে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর হয়ে ইসলামের বাস্তব রূপ অন্বেষণের পথ উম্মুক্ত হয়েছিল। যে কারণে বলা যায়, মাওলান সাঈদী এবং তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের ভক্ত ছিলাম আমি।
এভাবে মাহফিল বন্ধ করে দেয়ার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে তখন তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের তীব্রতায় শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম পেরেড ময়দানে মাহফিলের অনুমতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। প্যারেড ময়দান আমার এলাকায় হওয়াতে স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলন এবং মাহফিল সফল করার যাবতীয় কর্মকান্ডে আমার কিঞ্চিত ভূমিকা ছিল। আমার উক্ত কিঞ্চিত(!) ভূমিকা তাদের নিকট অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। এটাকে তারা তাদের নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেব গ্রহণ করে। তাছাড়া তাদের নাকের ডগার উপর এতবড় একটি মাহফিল চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তাদের অস্থিত্ব বিলিন হয়ে যাওয়ারও ভয় ছিল। মাহফিলের আকারটা একটু বলে নিলে তাদের গাত্রদাহের যৌক্তিকতা(!) কিছুটা হলেও অনুমান করা যাবে। মাহফিলের মূল কেন্দ্র ছিল প্যারেড ময়দান, কিন্ত লাউড স্পিকার দিয়ে এর বিস্তৃতি করা হয়েছিল- চক বাজার, কাপাশ গোলা, বাকলিয়ার কিয়দাংশ, সমগ্র নবাব সিরাজউদৌলাহ রোড হয়ে দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম কলেজ, মুহসিন কলেজ, ইসলামী ইউনিভার্সিটি(চক বাজার ক্যম্পাস), গনি বেকারী হয়ে প্রেস ক্লাব, চট্টেশ্বরী রোড, মেডিকেল কলেজ এবং পাঁচলাইশ থানার মোড় পর্যন্ত।
এসব দেখে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তারা ওঠে পড়ে লাগে ইসলাম পন্থীদের পেছনে। ভাড়াটিয়াদের মধ্যে যারা ইসলামের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন তাদেরকে নানা ভাবে হয়রানী এবং এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে। সুযোগ বুঝে স্থানীয়দের সাথেও নানা তাল তামাশা করতে থাকে, যেমনটি আমার সাথে করা হয়েছে।
তখন আওয়ামী লীগ উপরে উপরে বিরোধী দল হলেও তলে তলে এরশাদের নিকট থেকে নানা রকম সুবিধা আদায় করে তাকে সহযোগীতা করতো। ফলে প্রশাসন থেকে তারা নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো।
অতপর আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও পারিবারিক চাপে আমাকে দ্বিতীয়বার প্রবাস মুখী হতে হয়। তখন আমার ভালোবাসার কেন্দ্র বিন্দু, একমাত্র মেয়ে তাহমিনা মারিয়ামের বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ মাস।
সকল মায়ার বাঁধন ঢিলে করে আবারও চলেছি প্রবাস পানে। সব মায়ার বন্ধন ঢিলে করার চেষ্টা করেও এক জনের কাছে এসে তা থমকে যায়, সে আমার একমাত্র মেয়ে, জন্মের পর থেকে এক দিনের জন্যও যাকে চোখের আড়াল করিনি, আজ তাকে ছেড়ে পাড়ি জমাতে যাচ্ছি সুদূর প্রবাসে। ভাবতেও কেমন যেন অন্তরাত্মা কেঁদে উঠছে।
ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে আবুধাবির ফ্লাইট। ঝক ঝকা ঝক ট্রেন চলেছে ঢাকার পথে। ট্রেনে আরো অনেক ভ্রমন করেছি, এর ছন্দময় চলার শব্দ আজ আমার নিকট ছন্দ নয়, যেন ব্যাথাতুর হৃদয়ে হাতুড়ি পেটার শব্দ। নিরবে অশ্রু বিসর্জনের সাথে সাথে মেয়েকে নিয়ে ভাবছি-
এই অবুঝ চোট্ট মেয়েটি আব্বুকে অনুভব করতো প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে। করবেই তো! কারণ জন্মেই তার স্থান হয়েছিল আব্বুর কোলে, আর আব্বু কৌশল করে দুই হাঁটুর মাঝখানে লুঙ্গিটাকে টান টান করে রেখে বানাতো তার জন্য দোল চেয়ার। যেকোন কান্না থামানোর জন্য উক্ত কৃত্রিম দোল চেয়ারই ছিল যথেষ্ট। শু’তে গেলে আব্বুর পাশেই তার শোয়া চাই, গরমে ঘামাচির কারণে পিটে কোথাও চুলকানি হলে আব্বুর বাহুতে হাত ঘষে ঘষে ঠোট দু’টো গোল করে বলতো, ‘উহ্ উহ্’। আব্বু বুঝতে পেরে পিটে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। বসতে শেখার পর আব্বুর পুরানো একটি পেন্ট কেটে কাপড় বের করে লাঠি, দড়ি ইত্যাদি দিয়ে বানিয়ে দেয় একটি দোল চেয়ার। ওটাতে দোল খেতে খেতে আব্বুর সাথে পরমানন্দে হাসতো। দেয়াল ধরে ধরে হাঁটাতে শেখার সময় এক রুম থেকে আরেক রুমে আব্বুর সাথে লুকোচুরি করতো। আব্বুর কাঁধে মাথা রেখে আব্বুর সাথে ঘুরতে বের হতো। এসব দৃশ্য মনের পর্দায় ভাসছে আর ভাবছি, আবার কখন দেখা হবে আমার ছোট্ট আম্মুটির সাথে? যখন দেখা হবে তখন কি সে আব্বুকে মনে করতে পারবে? আব্বু বলে ডাকবে, নাকি মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে?
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আমার মেয়েটিকে আল্লাহ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাটি। একরাতে অসুস্থ মেয়েটির জ্বর মেপে দেখছি, এমন সময় একধরনের খিচুনি হয়ে মুখ দিয়ে লালা বের হতে লাগলো। কোলে নিয়ে ডাক্তারের জন্য দৌঁড়াচ্ছি, আমার কোলের মধ্যেই মেয়ের পুরা শরীর শুটকীর মতো শক্ত-নির্জীব হয়ে গেলো। তখন আল্লাহকে বলেছি, “আমার মেয়ে মরে যাচ্ছে, আল্লাহ্ আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও, যদি আমার মেয়ের হায়াত বরাদ্দ না থাকে তাহলে আমার হায়াতের অর্ধেক আমার মেয়েকে দান করে হলেও আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।" বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়ের শরীর স্বাভাবিক হয়ে আসলো এবং চোখ খুলে আব্বুর দিকে তাকানোর পর আলহামদু লিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম। লোকেরা বলাবলি করছিল, এ রোগটি নাকি বাচ্চাদের ৫/৬ বছর বয়স পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভাবছি, আমার অনুপস্থিতিতে যদি আবারও এমন হয়, যদি আমার মেয়ে মরে যায় আমার কি হবে?
প্রবাসে এসে মেয়ের জন্য টুকটাক লেখালেখি এবং ছড়া রচনা করতে গিয়ে বন্ধু মহলে ‘কবি’ বলে পরিচিত হয়েছিলাম। আজকের মতো তখনো যদি এভাবে লেখালেখির সুযোগ থাকতো এবং পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকা দীর্ঘায়িত হতো, তাহলে হয়ত কবি ও লেখক হয়ে যেতাম।
(ডায়রির পাতা থেকে) প্রবাসীর আকুতি
একটুখানি ছোট্র আম্মু নাম তার তামী
সে এখনো জানে কি তার আব্বু যে আমি?
এত্তো কিছু জানবে কিসে বয়স যে তার অল্প,
তারপরেও আম্মু আমার বুদ্ধি রাখে স্বল্প।
তাইতো সে বুদ্ধি করে কথার ফাঁকে ফাঁকে
কান্না মাখা কন্ঠ দিয়ে আব্বু আব্বু ডাকে।
আম্মুমনি যখন আমার হলো চৌদ্দ মাস,
রেজেক দাতার হুকুম হলো তাই এলাম প্রবাস।
এতদিনে আম্মু আমার দু'বছরে রাখলো পা,
আধো আধো হাজার বোলে তাইতে পষ্ট বাবা-মা।
স্বপ্ন ছিল ছোট্র আম্মুর পাশে বসে বলবো কত কথা,
প্রবাস এসে স্বপ্ন ভেঙ্গে বক্ষে দারুন ব্যাথা।
সেদিন মোদের তামী'র মা কেসেট ফিতায় করে
পাঠিয়ে ছিল আমার কাছে তামী'র কথা ধরে।
হাসি-কান্না অনেক কথা বললো ধীরে ধীরে
হঠাৎ তামী'র প্রশ্ন শুনে হৃদয় যেন গেল ছিঁড়ে।
তামী'র কথার মধ্যখানে কেউ যেন বল্ল ডেকে,
"বল, আব্বু আচ্ছালাম, তামী অনেক ভালো আছে।"
তা শুনেই তামী আমার খারাপ যেন করলো মন,
"আব্বু ক-ই" প্রশ্ন করলো কন্ঠ ছিল ভেজা তখন।
আব্বুকে তোমার প্রবাসী করে বাঁচিয়ে রেখেছেন আল্লাহ,
এতীম তোমায় করেননি তিনি, বলো তাই আলহামদু লিল্লাহ।
খেলাধূলা. ছড়া বলা সাঙ্গ হবে যখন,
আব্বুর জন্য দোয়া করো কাতর করে মন।
আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন আসবো আবার ফিরে,
লক্ষ আশা বক্ষে গাঁথা আছে যে তোমায় ঘিরে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৯ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অজান্তেই চোখে পানি চলে আসছে।
প্রবাসের প্রথম দিনগুলোতে জান্নাতের জন্য অনেক কেদেছি।
প্রথমবার যখন বাড়িতে গেলাম জান্নাত তখন ২ বছর ২ মাস। তার মাকে আমার সাথে কথা বলতে দিত না। বলত আম্মু ইনি কে? আপনি ওর সাথে কথা বলবেন না। আমার দিকে ফিরে ঘুমান।
কি যে এক যন্ত্রনায় ছিলাম। সত্যি প্রবাস জিবন মানুষকে প্রকৃত জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
সেই সময় এর কথা মনে আছে যখন এই মাহফিল বন্ধের ষড়যন্ত্রে এরশাদ সরকার মিথ্যা সংবাদ দিয়ে মাসজিদুল হারাম এর সন্মানিত ইমাম সাহেবকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমারও একটি মেয়ে। তাই অনুভুতি একই।
আপনার মেয়ের জন্য দোয় রইলো। তবে আপনি সেরকম অবস্থায় পড়েননি। এজন্য আলহামদু লিল্লাহ্।
লিখাটা খুব ভাল লাগলো, ধন্যবাদ আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন