প্রবাস কাহিনী- ১
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:৩৩:১৪ দুপুর
বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় প্রবাসী হয়েছিলাম। যন্ত্রনা কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি তখন। জীবনের যত কান্না তখনই মনে হয় কেঁদে ফেলেছিলাম গোপনে, এমনকি প্রকাশ্যেও। আমার কান্নায় বন্ধুরাও কাঁদতো অনেক সময়। গুমরে গুমরে কাঁদতাম, ডান-বাম দেখে নিয়ে আমার স্ত্রীর নাম ডেকে ডেকে কাঁদতাম। যতই গোপন করি না কেন, এক সময় প্রকাশ হয়ে যায় আমার কান্নার মূল উদ্দেশ্য। আমার অগোচরে ‘বউ পাগলা’ বলে কেউ বিদ্রুপ করেছে কিনা জানিনা, তবে আমার তখনকার রুমমেট এবং বন্ধুরা ছিল খুবই ভালো। তারা আমাকে যথেস্ট সহযোগীতা করেছিলে তখন। বলতো; কোন রকম এক বছর পাড় করতে পারলেই ফ্যমিলি ভিসা বের করা যাবে, একটা বছর ধৈর্য্য ধরো, টাকার সমস্যা হলে আমরা দেব, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই সেদিন বন্ধুদের ঐ সহযোগীতাটুকু না পেলে ৭৩০ দিনের দীর্ঘ প্রবাস প্রোগ্রামটি সম্পন্ন করা মোটেই সম্ভব হতো না।
পাসপোর্ট আর টিকেট পেলেই উড়াল দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু প্রবাস নামের যে জালে আটকা পড়েছিলাম তা থেকে ছুটে আসা অতটা সহজ ছিল না। ভাবতাম, যদি কোন দৈব শক্তি আমাকে দেশে পৌঁছে দিতো! অথবা যদি পাখির মতো উড়তে পারতাম!! অনেকবার স্বপ্নের মধ্যে উড়েছিও। কিন্তু সে উড়া কোন কাজে আসেনি, বুকের ধর্কন বৃদ্ধি ছাড়া। হেরি পটারের মতো উড়ে উড়ে যেই না গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, অমনি চোখ মেলে নিজেকে আবিস্কার করেছি বিছানায়। সব আশা ছেড়ে দিয়ে শেষমেস বাকী দিনগুলোর ক্ষণ গণনা শুরু করলাম। একেকটি দিন ছিল একেকটি সমুদ্র পাড়ি দেবার মতো।
অবসরে বন্ধুরা যখন টুয়েন্টি নাইন, ব্রিজ অথবা টেলিভিশনের সামনে বসে সময় কাটাতো আমি তখন বসে যেতাম পত্র রচনায়। তখন টেলিঃ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল আর সীমিত। সপ্তাহে দু’টি ছিঠি ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন। মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখতাম, ওদিক থেকেও পেতাম তেমনি। ডাক বক্সে অন্য কারো চিঠি থাক আর না থাক আমার চিঠি থাকবেই। বাদশা ড্রাইভারকে খুব খাতির করতাম, সপ্তাহে দু’দিন যেন ডাক বক্স খুলে দেখেন।
এভাবে গুনে গুনে দু’টি বছর পাড় করার পর সোজা ভিসা কেন্সেল করে দেশে চলে এলাম। বিয়ে করে আবার মানুষ প্রবাসে থাকে? এর চেয়ে জুলুম আর কি হতে পারে? নিজেকে ধিক্কার দিয়ে আর কোনদিন প্রবাসে না যাওয়ার প্রমিজ করলাম মনে মনে। কিন্তু তখনো আমার জানা ছিলনা দেশের চিটিং বাটপাররা প্রাবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাতের জন্য রাক্ষসের মতো হা করে বসে থাকে।
প্রবাস থেকে আয় করা টাকার সিংহভাগ বিনিয়োগ করেছিলাম কথিত এক লাভজনক ব্যবসায়ে। প্রথম দিকে বেশ লাভও পেয়েছিলাম। লাভ দেখে আরো বিনিয়োগ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত এক রাতেই হাওয়া মিশে গিয়েছিল সেই ব্যবসায়। আর আমি হয়ে গেলাম বেকার।
অতঃপর দ্বিতীয় পর্বের প্রবাসের হাতছানি : ওয়াদা ভঙ্গ করে পূণরায় প্রবাসে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না আমার। আপাতত বেকার হয়েছি তো কী হয়েছে? বিভিন্ন দিকে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিচ্ছি, একটা ব্যবস্থাতো হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া আব্বা যতদিন কর্মক্ষম আছেন ততদিন ঘরে খরছ দেয়ার জন্য কোন চাপ দেবেন না, তা নিশ্চিত। এভাবে কেটে গেলো প্রায় দু’টি বছর।
শেষ পর্যন্ত আমার আওয়ামী বন্ধুদের বদান্যতায় আবারও দেশ ছাড়তে হলো আমাকে। ওরা আমার ঘরে সংবাদ দিতে লাগলো যে, আমাকে কালো তালিকা ভূক্ত (Blacklisted) করা হয়েছে, খুব শীঘ্রই ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হবে- ইত্যাদি ইত্যাদি। আলহামদু লিল্লাহ্! কথিত এ মৃত্যু পরোয়ানা আমাকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। অধিকন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, তখন আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালার প্রতি আমার ঈমান যেন আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। একা একা ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হলো আমার পরিবারের পক্ষ থেকে। এমনকি ফজর, মাগরিব এবং এ’শা নামাযও মসজিদে না গিয়ে ঘরে পড়ার জন্য চাপ দিতে লাগলো। আমি এসবের কোন তোয়াক্কা না করে আমার মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে লাগলাম এই বলে যে, ‘হায়াত এবং মাউতের ফয়সালা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, আমার মৃত্যু যদি কারো বোমা-বুলেট-ধামার আঘাতে নির্ধারিত থাকে, তা রোধ করার শক্তি কারো নেই। সুতরাং মৃত্যু ভয়ে পালিয়ে থাকার মতো কাপুরষতা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’। আমার এহেন আচরণে স্বয়ং মৃত্যু দূতদের(!)ই বিব্রত হওয়ার সংবাদ পেতে থাকলাম।
এসব ঘটনা কিভাবে যেন আবু ধাবিতে আমার আব্বার কানে গিয়ে পৌঁছলো। তিনি কাল বিলম্ব না করে আমার জন্য ভিসা পাঠিয়ে দিলেন। অনিচ্ছা সত্বেও শুভাকাঙ্খিদের পরামর্শে দ্বিতীয় দফা প্রবাসে পাড়ি জমালাম।
এবারের প্রবাস কান্না কিন্তু স্ত্রীর জন্য নয়, কে সে? জানাবো আগামী পর্বে। এবং আরো জানতে পারবেন, কি সে মহা অপরাধ, যার জন্য সন্ত্রাসীরা আমার জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৪ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহু খায়েরান।
সুতরাং বুঝা গেল, বিয়ে করা মাত্রই প্রবাস নয়। বিয়ের আনন্দ তেতো হওয়া অবধি অপেক্ষা করাই উত্তম।
বন্ধু উলট মন্ডল বলেছিলেন:
বিয়ের পরে প্রথমে স্বামী কথা বলে স্ত্রী শুনে,
পরে স্ত্রী বলা শুরু করে আর স্বামী শুনে,
অতঃপর দুইজনই বলা শুরু করে, কথন কেউ শুনেনা।
সেই সময়টাই হল, প্রবাস জীবন শুরুর প্রকৃত সময়।
অনেক ধন্যবাদ
অথবা প্রবাসে ৪ঘন্টা কাজ করলে ১০০ থেকে ১৫০ দিরহাম = ২১০০ থেকে ৩২০০ টাকা মিলে, তাই যেমন মজুরী, তেমনী খাটুনি।
দেশে জান দিয়ে দিলেও দিন শেষে ৩৫০টাকা, বুঝলেন হাজ্বি সাহেব!
তবে প্রবাসে থাকার একটা সীমা নির্ধারণ করা উচিৎ। বউ ছেলে মেয়ে রেখে ম্যারথন প্রবাস উচিৎ নয়।
বিয়ের দু'বছর পর প্রবাসে এসেও অনেক কেদেছি, কিন্তু কারো সামনে নয়, কারণ বউ পাগল বলবে, এজন্য।
লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছি, এখনো মাঝে মাঝে.....
বেশিরভাগ প্রবাসীদের কষ্টে মিল আছে! এক ঘাটের মাঝি বলে কথা!
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সব হাসবেন্ডদের কিছুদিনের জন্য প্রবাস আসা উচিত। বউ এর জন্য মায়া বাড়বে(যারা কথায় কথায় বউ এর এর ঝগড়া করে) আর খেটে খাওয়ার কষ্ট বুঝবে( আলাল দুলাল টাইপ ছেলেরা) ।
আশাকরি বিস্তারিত পড়ার সুযোগ হবে।
যাক, দেরি হলেও শুরু করা গেল.. অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন