ইতেকাফ এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা- ৫

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ২৫ জুলাই, ২০১৫, ১০:২৯:২০ সকাল

মসজিদের হুজুররা ঘুমাতেন দোতলায় আর আমাদের অবস্থান ছিল নিচে। ফজরের নামায শেষে দুয়েক ঘন্টা ঘুমাতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই হুজুরদের কোন না কোন মক্কেলের ডাকা ডাকিতে আগে ভাগে জাগতে হতো আমাদের। দোয়া প্রার্থনা, খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, খতমে খাজেগান, খতমে গাউসিয়া সহ আরো নানা রকমের খতমের ক্রেতা হয়ে আসতেন মক্কেলরা। অচেনা কেউ আমাদেরকে হুজুর মনে করে টাকা এবং একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে একটু ভালো করে দোয়া করার আর্জি পেশ করতেন। আবার অনেকে চিরকুট এবং কুরআন খাতমের টাকাটা দিয়ে বলতেন- একটু অমুক হুজুরকে দেবেন আর বলবেন দোয়ার আগে যেন আমাকে ফোন করে।

দোয়া এবং খতমের ব্যবসায় এত জমজমাট যে, তলে তলে এটি একটি বড়সড় “দোয়া-খতম ব্যবস্থাপনা কোম্পানী”র মতোই চলছে। ‍বাকী শুধু চেম্বার অব কমার্স থেকে নামটা পাশ করে ট্রেড লাইসেন্স নেয়া। মসজিদ এবং হুজুরা খানা তো অফিস হিসেবে আছেই।

স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এসব খতমের আবার ভিন্ন ভিন্ন রেইট আছে। যেমন; মসজিদে পড়লে এক রেইট, ক্লায়েন্টের ঘরে পড় দিয়ে আসলে আরেক রেইট এবং ক্লায়েন্টের অনুরোধে কোন মাজারে গিয়ে পড়ে দিয়ে আসলে ভিন্ন রেইট। এক একটি খতমের মূল্য ৪/৫ হাজার থেকে ১০/১২ হাজার টাকাও হয়ে থাকে। তেলাওয়াত তথা খতমের ‍সুবিধার জন্য কুরআন শরীফের এক একটি পারা আলাদা করে করে বাইন্ডিং করা আছে। বুখারী শরীফের অনুরূপ অনেকগুলো খন্ড দেখলাম। ৬০/৬০ সে.মি. সাইজের সবগুলো খন্ড প্রায় ১৫/১৬ কেজি ওজন হবে।

অত্র এলাকায় হুজুরদের ২০/৩০ জনের একটি সিন্ডিকেট দেখলাম। ক্লায়েন্টের সাথে দোয়া/খতমের চুক্তি যার সাথে হয়ে থাকে তিনি সেদিন কন্ট্রাক্টর/পরিচালক/নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। এবং স্বাভাবিক ভাবেই আয়ের একটি বড় অংশ তিনিই হাতিয়ে নেন। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে গুঞ্জন ও শোনা যায়, তবে সিন্ডিকেট থেকে বাদ পড়ার ভয়ে রয়ে সয়ে। যারা ঠকলেন তাদের কারো মাধ্যমে কাজ পেলে তারাও সেই একই কায়দায় কাজটা সেড়ে নেন।

২৬ রমাদানের দিন বেশ সকালেই মোরগ-মুরগী নিয়ে লোকজনের জটলা দেখলাম মসজিদ প্রাঙ্গনে। কারণ রাত্রে লাইলাতুল কদর। হুজুরদের প্ররোচণায় কিছু লোকের বদ্ধমূল ধারণা, আজকে হুজুরকে দিয়ে মুরগী জবেহ করতেই হবে, নাহলে ফাতেহা কবুল হবেনা। ‍হুজুররা উপরের তলায় ঘুমাচ্ছেন, যত ঝক্কি ঝামেলা আমাদের উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে একজন বলে ওঠে, ‘হুজুর, কুরাউয়া জরাই দঅন’। আমি বলাম, ‘আঁই হুজুর নঅ, থিয়াই থাক্, হুজুর আইলে জরাইবো’।

ঘন্টা খানেক পর হুজুর এসে একে একে সব মুরগী জবেহ করে দিলেন কিন্তু কোন টাকা নিলেন না। হুজুর মুরগী জবেহ করার কোন টাকা না নেয়াতে বিষ্মিত হলাম কিন্তু আছরের পর যে আরো বিষ্ময় অপেক্ষা করছে তা তখনো জানা ছিলনা। আছরের পর দেখলাম, মসজিদের বারান্দায় অনেকগুলো ছোট ছোট পানির বোতল সাড়িবদ্ধভাবে রাখা। হুজুর কি কি যেন পড়ে বোতর গুলোতে ফুক মারলেন। তার পর বোতলের মালিকেরা একেকটি বোতল তুলে নিচ্ছেন আর হুজুরর হাতে ১০/২০/৩০ টাকা গুঁজে দিচ্ছে আর হুজুর পকেটে ঢুকাচ্ছেন।

সকালের মুরগী জবেহ এবং এখন ফাতেহার নামে বোতলে ফুঁক মারা একই সূত্রে গ্রথিত। সকালে জবেহ করা মুরগী পাক করার পর ফাতেহা তথা হুজুরের ফুঁক ছাড়া তা আবার খাওয়াও জায়েয হবে না, এমন ধারণা/প্ররোচনাও দেয়া আছে হুজুরদের পক্ষ থেকে।

আমার এক পরিচিত হুজুরের নিটক জানতে চাইলাম, তারা টাকা রোজগারের জন্য এমন অপকর্মগুলো কেন করছেন? জবাবে জানালেন তাদের বেতন খুবই কম, এসব না করলে তাদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে। তবে আমার জানা মতে অনেক সামর্থবানরাও অতি লোভে এসব কর্ম করে যাচ্ছেন দেদারছে। যেমন; আমার উক্ত মসজিদের খতিব কাম ইমাম একটি মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। কথা প্রসঙ্গে জানালেন তিনি ৫তলা বিল্ডিং বানানোর জন্য প্লান পাশ করতে দিয়েছেন, ছেলেকে ডাক্তারী পড়ানোর প্রস্ততি নিচ্ছেন। অথচ তিনি এসব কর্মের অত্র এলাকার বড় ওস্তাদ।

চলবে....

বিষয়: বিবিধ

১৪২৫ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

331485
২৫ জুলাই ২০১৫ সকাল ১১:৫০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : খতম ব্যবসারও সিন্ডিকেট!!
না হুজুর ব্যবসা তে নেমে পড়লে এই কষ্ট আর করতে হবেনা। পরশুরাম এর "শ্রি শ্রি সিদ্ধেস্বরি লিমিটেড" এর মতন "গাউসিয়া লিমিটেড" তৈরি করা যায়। মুরগি গুলি জবাই করে দিলেই পরতেন!! কিছু উপড়ি...
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:১৬
274001
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : খুবই মজার ব্যবসায় এটি।
331489
২৫ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০১:৪৯
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:১৭
274002
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ভাই।
331491
২৫ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০১:৫৬
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহামাতুল্লাহি ওবারাকাতুহু। সিন্ডিকেট অনেক জায়গায় শুনলেও এই বিষয়টি প্রথম শুনলাম!!!
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:১৮
274003
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : শুনেন নি একারনে যে, এখানে কোন সাইন বোর্ড লাগানো হয় না।
331497
২৫ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০৩:১১
হতভাগা লিখেছেন : সরকারে তরফ থেকে মাসজিদের হুজুর , ইমাম , খতিবের বেতন একটা ভাল পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত । কারণ ধর্মীয় শিক্ষা ও কার্যাবলী সঠিকভাবে না হলে তা সমাজের বিশৃঙ্খলাকে বাড়িয়ে দেবে ।
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:১৯
274004
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সাথে যোগ করতে হয় যে, শুধুমাত্র বেতন-ভাতা বাড়লে হবে না, চরিত্র সংশোধনের কর্মসূচী ও থাকতে হবে।
331499
২৫ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০৩:২১
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, জায়েয ও নাজায়েয সব একসাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। আসলে তারাও অনেকটা অপারগ। এই সব মসজিদে চাকরি নিতে হয়তো কোন নেতাকেও দিতে হয়েছে অগণিত টাকা।
আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক। সঠিক পথে পরিচালিত করুক।
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:২০
274005
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমীন।
331505
২৫ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০৩:৩৬
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : আমি ভাবছি এসব লিখার কারণে মহল্লার মসজিদে আপনাকে আবার বাঁকা চোঁখে দেখে কিনা ..
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:২১
274007
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ওনারা সোজা বিষয় সোজা চোখে দেখেন খুবই কম।
331507
২৫ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০৩:৩৮
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : আপনার পড়া পড়ে রাসুল (সাঃ) সেই হাদিসের কথা মনে পড়ে গেল, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা দুই প্রকারের মানুষকে গায়ে পড়ে সাহায্যা করবে।

১। সেই ব্যক্তিকে যারা অতীতে ধনী ও সম্ভান্ত ছিল, লজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাততে পারেনা।

২। সেই আলেম কে, যারা অর্থের অভাবে দ্বীনকে মামুলী মূল্যে জনগণের কাছে বিক্রী করে দিবে।

অনেক ধন্যবাদ
২৫ জুলাই ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৪৩
273835
শেখের পোলা লিখেছেন : দ্বিতীয় শ্রেনীর মধ্যে বেশীর ভাগ আছেন যারা লোভে পড়ে আরও বেশী কামাইয়ের পথ বার করবেন৷
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:২৩
274008
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : জ্বি, টিপু ভাই।
331526
২৫ জুলাই ২০১৫ বিকাল ০৫:১২
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আগেই বলেছিলাম, লালসালুর কথা..আরেকটি উক্তি নিন লোকমান ভাই, আপনার মনে না থাকলে মনে পড়বে। ‍শস্যের চেয়ে টুপি বেশি ধর্মের আগাছা বেশি..
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:২৩
274009
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ধন্যবাদ মাছুম ভাই।
331558
২৫ জুলাই ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫১
শেখের পোলা লিখেছেন : হুজুরদের নতুন কিছু উপায়ে আমদানির কথা জানলাম৷ যে হুজুররা বলেন যে, কম বতন চলে না৷ আমার মতে ইনাদের পিছনে নামাজ হবেনা কারণ ইনারা মুছলমানই নন, মুসলীম তারাই যারা আল্লহতে আত্মসমর্পণ করেছে৷আর যারা আল্লাহে আত্ম সমর্পণ করেছে তাদের সব দায় দায়িত্ব আল্লাহর উপর৷ আস্থা থাকলে অবশ্যই আল্লাহ চালাবেন৷বেতন কম তিনি অন্য কাজও অবসরে করতে পারেন,তা না করে আল্লাহর কালাম বেচে খাচ্ছেন, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন৷
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:৫৮
274012
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই। আসলে আমাদের সমাজে বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ লোকেদের অনেকেই ধরে নেন- ওনাদের বেতন কম তাই এসব জায়েয।
১০
331686
২৬ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০২:৩৭
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : আপনি যেভাবে শব্দ চয়ন করেছেন তাতে আপত্তি আছে। আজ এই কাজটা এলাকা ভেদে আছে। সব জায়গায় নয়।
তাই সাধারণ ভাবে সব আলেম ওলামাদের নিয়ে এমন লিখা ঠিক নয়।
অথবা সাথে সঠিক ভাবে প্রায় ৮০ ভাগের উপর যারা সৎ ভাবে চলেন তাদের কথা লিখা উচিত।
তারপরও আপনাকে ধন্যবাদ।
২৬ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:০৩
274000
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : প্রিয় ইবনে আহমাদ ভাই, সিরিয়াসলি বলছি- ১।আমি সংশোধনে বিশ্বাসী। সুতরাং আপত্তিকর অশোভন শব্দগুলো চিহ্নিত করে দিলে ‍উপকৃত হবো। ২। সব যায়গা এবং সব আলেমের কথাতো আমি বলিনি ভাই। আরেকবার চোখ বুলালে হয়ত নজরে আসবে, আমি একটি মসজিদ এবং আমার উক্ত এলাকার অবস্থা বর্ণনা করেছি। এমন আর কোথাও থাকলে লোকেরা বুঝে নিয়ে সংশোধন করে নিতে পারেন নিজেদেরকে। ৩। আপনি যদি মনে করেন বাংলাদেরশের আলেম সমাজের ৮০% এর উপরে সঠিক পথে আছেন, তাহলে আমার আর কিছু বলার থাকবে না, শুধু থাকবে এতটুকু যে তাহলে ইসলামী বিপ্লব বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপর মাত্র! ৪। নিজেও একজন লেখক হিসেবে ভালো করেই বুঝেন যে একজন লেখকের সামনে যখন যেটা আসে সেটাই লিখেন তিনি। হ্যাঁ, যারা সৎভাবে চলেন তাদেরকে নিয়েও লিখার ইচ্ছে আছে, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File