ছাত্রজীবনের টুকিটাকি- ১১

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ১৩ জুন, ২০১৫, ০৬:৪৪:১০ সন্ধ্যা

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চেতনা জাগ্রত রাখার জন্য সপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারের বদলে রবিবার করা হয়েছিল। আবার মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না লাগার জন্য ঐ দিন, মানে শুক্রবার মর্ণিং স্কুল করা হলো, যেন স্কুল ছুটির পর জুময়া আদায় করা যায়।

আমরা যারা একটু আড্ডা ও খেলাধুলা প্রিয় ছিলাম তারা স্বাভাবিক ভাবেই ক্লাস শুরু হওয়ার বেশ আগেভাগেই স্কুলে এসে যেতাম। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি, ক্লাস শুরুর প্রায় ঘন্টা দেড় ঘন্টা আগেই স্কুলে এসে গেছি। আমার স্কুলে আসার টাইমিং এর ব্যতিক্রম না হলেও কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করছি, তাহলো- উপস্থিতি একেবারেই কম।

আমি সেই ঐতিহাসিক ১৫ই আগষ্ট’ ১৯৭৫ সালের শুক্রুবারের কথা বলছি। ইতোমধ্যেই যে, দিনটি কারো কাছে ইতিহাসের সোনালী মোড়কে আবার কারো কাছে কালো আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে, সে খবর আমাদের ছিল না তখনো। আমরা যে কয়জন উপস্থিত হয়েছি, আজকের আড্ডার বিষয়ই ছিল, “স্কুলে আজকে উপস্থিতি কম কেন?” এরই মধ্যে দফতরি আব্দুর রহমান এসে বললো, ‘প্রিন্সিপাল স্যার আপনাগোরে ডাকে’।

অধ্যাপক গোলাম রসূল, একাধারে স্কুলেরও প্রিন্সিপ্যল। তিনিও আজ আফিসে যাননি। আমাদের আ্যকাডেমিক বিল্ডিং এর সাথে লাগানো পেছনে তাঁরা বাসা। আমরা কাল বিলম্ব না করে স্যারের বাসায় গেলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন দেশের কোন খবর আমরা জানি কি না। না স্যার, আমরা জবাব দিলাম। অতপর তিনি বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। অবস্থা কোন দিক থেকে কোন দিকে যাচ্ছে বলা যায় না। তোমরা যার যার মতো করে সাবধানে নিজ নিজ বাসায় চলে যাও।

স্যারের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমরা যে যার মতো করে বাসার উদ্যেশ্যে রওনা দিলাম। নিচে নেমে দেখলাম আরেক অবিশ্বাস্য কান্ড। রাস্তায় রাস্তায় আনন্দের ঢেউ। খুশীতে মিস্টি বিতরণ চলছে, হোটেল রেস্টুরেন্টগুলি তাদের তৈরী সিঙ্গারা-সমুচা ফ্রি খাওয়াচ্ছে। এ ছিল চন্দন পুরা সিরাজউদদৌলা রোড এবং চকবাজারের চিত্র। সারা বাংলাদেশের ব্যাপারে আমার কোন ধারণা ছিলনা তখনো।

অথচ গতকাল পর্যন্ত এখানে 'এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ' শ্লোগানে মুখরিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন বাজতো প্রায় প্রতিটি টেপ রেকর্ডারে। আজ বঙ্গবন্ধুর বিদায়ের সাথে সাথে এমন এবাউট টার্ন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল দারুন ভাবে। আমার শৈশবের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে আনন্দ উপভোগ করার মতো জঘন্য কাজকে আমি সহ্য করতে পারছিলামনা, যদিও ১৯৭৪ সালের মারাত্নক দুর্ভিক্ষের সময় আমরাও খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম, ইসলাম বিরোধী কিছু কিছু পদক্ষেপ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল, বাকশাল বিরোধী মনোভাব আমার মধ্যেও দানা বেঁধেছিল আরো অনেক কারণে। তার পরও বঙ্গ বন্ধুকে নিয়ে এমনতরো উপহাস মোটেই সহ্য হচ্ছিল না। তাই এক রকম চোখ বন্ধ করেই বাসায় ফিরে যেতে যেতে অতীত স্মৃতির বাহনে চড়ে রোমন্থন করতে লাগলাম আমার শিশু মনের সেই আকুতির কথাগুলি, যখন আমি আল্লাহর নিকট কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতাম আমার প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচনে বিজয়ী করার জন্য, পরবর্তীতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে তাঁর মুক্তির জন্য। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম, কায়মনোবাক্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করতাম।

বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় ‘এক নেতা এক দেশ’র শ্লোগানে যারা আকাশ বাতাস মুখরিত করতো তারা আজ কোথায়? এমন জঘন্য হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য একটি লোকও বের হলো না কেন? বন্দুকের ভয়ে? তা-ই যদি হয়, লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে কে বন্দুক তাক করেছিল? সেখানে কেন দলের হাই কমান্ডের নেতা আব্দুল মালেক উকিল ‘বাংলাদেশ ফেরাউন মুক্ত হয়েছে’ বলে ঘোষণা দিলেন?

পরে জেনেছি, দলের ভিতরের লোকেরাই বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত ছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির ভাষায়, শেখ হাসিনা বঙ্গ বন্ধুর খুনীদের নিয়ে দল গঠন করেছেন, তাঁদেরকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছেন। একটি চক্র বঙ্গবন্ধুকে ‘এক নেতা এক দেশ’ এর স্বপ্ন দেখিয়ে মিস গাইড করে জনবিচ্ছিন্ন করার ফলে এমন নির্মম হত্যাকান্ডের পর জনগণ শোকের বদলে আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

আজকেও বামপন্থী-নাস্তিকেরা মাননীয় শেখ হাসিনাকে ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূলের মাধ্যমে আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখিয়ে মিস্ গাইড করে চলেছেন। বন্ধুকের নল দিয়ে আর যা-ই হোক, ভালবাসা পাওয়া যায় না- এ কথাটি বুঝার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রী নেওয়ার প্রয়োজন হয়না। ইতিহাস জানতে হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য।

চলবে....

বিষয়: বিবিধ

১০৯৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

325603
১৩ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৫৭
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম!

আপনারা যারা সেইদিনগুলো নিজের চোখে দেখেছেন আশাকরি আমাদের কাছে তা সুস্পষ্ট করে দিবেন! বর্তমান এ যেভাবে উনাদের জয় জয়কার চলছে তাতে সত্যকার ইতিহাস চাপা পড়ে আছে! আপনারা না বললে এক সময় মিথ্যাই সত্যতে পরিনত হবে! হওয়া শুরু হয়ে গেছে অবশ্য!

জাযাকাল্লাহ খাইর!
১৬ জুন ২০১৫ সকাল ১০:৫৬
268341
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনি ঠিক বলেছেন। তাদের মিথ্যাচারের কারণে ইতিহাস বিকৃতি হতে হতে কোন এক ব্যক্তির ভাষায় তা এখন পাতিহাঁস হয়ে গেছে।
325606
১৩ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৩
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহামাতুল্লাহি ওবারাকাতুহু। কিছু কিছু গল্প পড়লে ঐখানেই আমার উপস্থিতি!!! ধন্যবাদ
১৬ জুন ২০১৫ সকাল ১১:২৪
268344
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ, আব্দুর রহিম ভাই।
325607
১৩ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৮
এ,এস,ওসমান লিখেছেন : ওরকম আর একটা ৭৫ আসে না কেন???
আর ক্ত কাল আমরা অপেক্ষা করবো???
১৬ জুন ২০১৫ সকাল ১১:৩৩
268351
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : তখন একটা ৭৫ এর প্রয়োজন ছিল মুজাহিদ তৈরীর জন্য। মুজাহিদ তৈরী হওয়ার পর আর ৭৫ নয়, মুজাজিদদের পরীক্ষা নেবেন আল্লাহ্! এটাই আমার ধারণা। ধন্যবদা আঙ্কেলের সাথে থাকার জন্য।
325618
১৩ জুন ২০১৫ রাত ০৮:১২
শেখের পোলা লিখেছেন : আমি খুলনায় বসেও এ গনেশ উল্টানোর খবরে মানুষকে উল্লাস করতে দেখেছি,দেখেছি সবার মুখে হাসি৷ অবাক হয়েছি একজনকেও দুঃখিত হতে বা ইন্না লিল্লাহ প্রকাশ্যে বলতে না দেখে৷ ঘটনাটির পুনরাবৃত্তির আশংকায় রয়েছি৷
১৬ জুন ২০১৫ সকাল ১১:৫৩
268355
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : যারা জুলুম করেন তাদের শেষ পরিনতি কখনো সুন্দর হয় না, কোন না কোন উপায়ে অপদস্ত হয়েই বিদায় নিতে হয়।
325627
১৩ জুন ২০১৫ রাত ০৮:৪৪
আবু জান্নাত লিখেছেন : দিনটি কারো কাছে ইতিহাসের সোনালী মোড়কে আবার কারো কাছে কালো আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে অতি চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছেন। অনেক অনেক শুকরিয়া। আরো জানতে চাই, লিখতে থাকুন।
১৬ জুন ২০১৫ দুপুর ১২:০৮
268359
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, আবু জান্নাত ভাই।
325640
১৩ জুন ২০১৫ রাত ০৯:২৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : কেউ যথন অতি উচ্চতায় উঠে যায় তখন তার পতন ও ততই কষ্টকর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা কারন কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন করেনা।
১৬ জুন ২০১৫ দুপুর ১২:২২
268361
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলেই বিপদ।
325653
১৩ জুন ২০১৫ রাত ১১:৩১
এস এইচ খান লিখেছেন : চমতকার সাবলীল বর্ণনা। ইতিহাস জানতে পারলে ভুলের পুনরাবৃতি এড়ানো সম্ভব। ইতিহাসের বাঁক গুলো গোচরে আনায় অনেক ধন্যবাদ।
১৬ জুন ২০১৫ দুপুর ০১:৪২
268412
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, খান ভাই।
325747
১৪ জুন ২০১৫ দুপুর ০১:১৯
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আপনার ছাত্রজীবনের ১১ পর্বের আজকেরটা সেরা লেখা..ধন্যবাদ..লিখতে থাকুন,সাথে আছি..
১৬ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫৯
268511
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ধন্যবাদ মাছুম ভাই।
325777
১৪ জুন ২০১৫ বিকাল ০৫:১০
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : তারমানে স্বাধীনের আগে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ছিল ?
১৬ জুন ২০১৫ রাত ০৮:২৭
268520
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : শুক্রুবার নিয়েও রাজনীতি কম হয়নি।
১০
325884
১৫ জুন ২০১৫ রাত ০১:০১
আবু জারীর লিখেছেন : এক নেতার এক দেশ
এক রাতে সব শেষ!
১৬ জুন ২০১৫ রাত ১১:৪২
268569
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : শেষ হইয়াও হইলনা শেষ!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File